শিবলী নোমান

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দর্শনগত সঙ্কট: একটি হাইপোথিটিক্যাল আলোচনা

শিবলী নোমান

লেখার শিরোনামে থাকার পরও মূল লেখার প্রথমেই আরও একবার স্মরণ করিয়ে দেয়া ভালো হবে যে, এই লেখাটি প্রকৃতিগতভাবে অনেক বেশি হাইপোথিটিক্যাল বা অনুমাননির্ভর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই দিনশেষে পুরো লেখাটি পড়ে এ বিষয়ে যেন অযাচিত বিতর্ক তৈরি না হয়, তাই আবারও তা স্মরণ করিয়ে দেয়া প্রয়োজনীয় মনে হয়। আরেকটি বিষয় স্মরণে রাখা জরুরি, আর তা হলো, এই লেখার মেরুদণ্ড হিসেবে স্যামুয়েল পি. হান্টিংটনের কিছু আলোচনাকে গ্রহণ করা হয়েছে, যেখানে পাশ্চাত্য রাষ্ট্রগুলোর কতিপয় চর্চা বা ঘটনাকে পাশ্চাত্য ব্যতীত অন্যান্য অঞ্চলের রাষ্ট্রসমূহের অনুকরণ প্রবণতা ও এর ফলাফলে আলোকপাত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে হান্টিংটনের অবস্থানকে ধ্রুব হিসেবে নয়, বরং ব্যাখ্যার নিমিত্তে একটি কাঠামো হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে মাত্র।

১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শগুলোর আলোকেই বাংলাদেশের সংবিধানের মূলিনীতিগুলো প্রণীত। বহুল আলোচিত এই মূলনীতিগুলো হলো গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা। যদিও পিনাকী ভট্টাচার্য তাঁর একটি গ্রন্থে দাবি করেছেন যে, ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের আগে এই চারটি মূলনীতির কোন অস্তিত্ব ছিল না, বরং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভারতের প্রত্যক্ষ সমর্থন পাওয়ার জন্যই এই মূলনীতিসমূহ, বিশেষত ধর্মনিরপেক্ষতার আগমন ঘটে। এক্ষেত্রে পিনাকী বলতে চাচ্ছেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রে উল্লেখকৃত সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের আলোকে। আবার মওদুদ আহমদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরর রহমানের শাসনকাল নিয়ে তাঁর রচিত গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পেছনের আদর্শগত ও দার্শনিক ভিত্তি স্পষ্ট ছিল না। একই গ্রন্থে তিনি এ কথাও মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, ১৯৬৯ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানের সংবিধান সংশোধনী বিলের খসড়া প্রণয়নের সময়, যখন ৬ দফা ছিল আওয়ামী লীগের প্রধান দাবি, সেই খসড়ায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব পাকিস্তানের ১৯৬২ সালের সংবিধানের রাষ্ট্রীয় নীতিসমূহে কোন ধরণের সংশোধনের প্রস্তাব আনে নি। সংশোধনী প্রস্তাব না আনার বিষয়টিকে আবার সেই সময়ের বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন অর্জনের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে খারিজও করে দেয়া যায়। তবে, ২০১৮ সালে প্রণীত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সংজ্ঞায়ন করা হয়েছে পূর্বোল্লিখিত মুক্তিযুদ্ধের চারটি আদর্শকে কেন্দ্র করেই। এতে বলা হয়েছে,

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অর্থ যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্ধুদ্ধ করিয়াছিল জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ;

আবার ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের গণপরিষদে আমাদের চার জাতীয় নেতার অন্যতম সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেছিলেন,

…এক্ষণে এই পরিষদ বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার সেই সব মূর্তপ্রতীক ও আদর্শ, তথা, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা, যা শহীদান ও বীরদের স্বাধীনতা সংগ্রামে ও আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ করেছিলো, তার ভিত্তিতে দেশের জন্য একটি উপযুক্ত সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্ব গ্রহণ করছে।

তাই ভিন্নমতের উপস্থিতি জানান দেয়ার জন্য পিনাকী ভট্টাচার্য কিংবা মওদুদ আহমদের অবস্থানকে লেখার শুরুতে উল্লেখ করা হলেও, সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দর্শনগত ভিত্তি তথা মূলনীতি হিসেবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে গ্রহণ করেই এই লেখার এগিয়ে যাওয়া উচিত বলে মনে হয়। একই সাথে রাষ্ট্রের দর্শনগত ভিত্তির আলোচনাটিও আপাতত এখানেই মুলতবি থাক।

 

বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ঠিক পেছনের ইতিহাসেই যেহেতু ১৯০ বছরের ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসন এবং ২৩ বছরের পাকিস্তানি পরোক্ষ-ঔপনিবেশিক শাসনের ক্ষত রয়েছে, তাই বাংলাদেশের মানুষের আধুনিকায়নের প্রবণতাকে স্যামুয়েল পি. হান্টিংটনের মতামতের সাথে মিলিয়ে নেয়া যেতে পারে। যেহেতু তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহ, অর্থাৎ শেষ বিচারে যারা অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া, তা যে কারণেই হোক, সেসব দেশে আধুনিকতার একটি সূচক হলো পশ্চিমায়ন, তাই হান্টিংটন বলতে চান যে, একটি রাষ্ট্র যখন আধুনিকতার দিকে এগিয়ে যাবে তখন তার একটি ফলাফল হলো দেশটিতে পশ্চিমায়ন ঘটবে। এক্ষেত্রে তাঁর বিখ্যাত দ্য ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশনস্‌ অ্যান্ড দ্য রিমেকিং অব ওয়ার্ল্ড অর্ডার গ্রন্থে তিনি যে লেখচিত্র উপস্থাপন করেন তা নিম্নরূপ,

এক্ষেত্রে A অবস্থানে আছে আধুনিকায়ন এবং পশ্চিমায়নের বিপক্ষে অনড় একটি অবস্থান, একে বলা হচ্ছে বাতিলকরণ মতবাদ; এর উদাহরণ হল সিনিক সভ্যতার রাষ্ট্র চীন। D ও C  অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে আধুনিকায়ন ছাড়া অন্ধ পশ্চিমায়ন এবং পশ্চিমায়ন ছাড়া আধুনিকায়ন। D অবস্থানের দেশ হিসেবে হান্টিংটন মিশর ও আফ্রিকার কথা বলেছেন এবং একে তিনি বেদনাদায়ক অবস্থান বলে মনে করেন, কারণ এখানে পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ থাকলেও আধুনিকায়ন আর হয় না। অন্যদিকে C অবস্থানকে বলা হচ্ছে সংস্কারবাদী অবস্থান। অর্থাৎ আধুনিকায়নের সঙ্গে সঙ্গে নিজস্ব অর্থাৎ দেশজ সংস্কৃতির মিশ্রণ, এবং সচেতনভাবে পাশ্চাত্যকরণকে নিরুৎসাহিতকরণ; হান্টিংটনের মতে এ ধরনের রাষ্ট্র হলো জাপান।

আলোচনার এ পর্যায়ে আধুনিকায়ন বলতে কী বুঝানো হচ্ছে তা কিছুটা পরিস্কার করে নেয়া প্রয়োজন। অ্যাকাডেমিশিয়ানরা মনে করেন এর উত্তর দেয়া সহজ নয়। তবে অনেকে বলতে চান প্রাচীন ও মধ্যযুগের পর আধুনিকায়নের যুগকে চিহ্নিত করে ব্যাপক হারে উৎপাদন বৃদ্ধি ও শিল্পে মেকানাইজেশনের ধারণা। আবার আধুনিকতা বলতে অনেকে ধর্মের প্রতি বিশ্বাস হ্রাস, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উত্তরোত্তর নির্ভরতা বৃদ্ধি, বাজার সম্প্ররসারণ ও ভোগ বৃদ্ধি, আমলাতন্ত্রের বিস্তার, লিঙ্গসম্পর্কের ধারণার পরিবর্তনকে নির্দেশ করেন। অর্থাৎ এই আধুনিকায়ন অনেকাংশেই বর্তমান সময়ে প্রচলিত সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারণার সাথে সম্পর্কিত। আর এই লেখাতেও আধুনিকায়ন বলতে তাই নির্দেশ করা হচ্ছে। এ পর্যায়ে আবারও ফিরে যেতে হয় আলোচ্য লেখচিত্রটিতে।

লেখচিত্রে B হলো এমন একটি অবস্থান, যেখানে পশ্চিমায়ন ও আধুনিকায়নকে একসাথে গ্রহণ করা হয়েছে। দুইটি বিষয়কে মেনে নেয়া হয়েছে কাঙ্ক্ষিত হিসেবে এবং এরা হাতে হাত ধরে এগিয়ে যায় যা লেখচিত্রটি থেকে সহজেই বুঝতে পারা যায়। হান্টিংটন বলছেন, কামাল আতাতুর্কের সময়ের তুরস্ক হলো এমন একটি রাষ্ট্র যা এই অবস্থানটি গ্রহণ করেছিল। আর এই যে, পশ্চিমায়ন ও আধুনিকায়নের একসাথে এগিয়ে যাওয়ার পস্থা অবলম্বন করা, একে বলা হচ্ছে কেমালিজম (কামাল আতাতুর্ককে পশ্চিমে কেমাল বলা হয়, সেই কেমালের তুরস্কের গৃহীত পন্থাকে বলা হচ্ছে কেমালিজম)। আতাতুর্ক তাঁর মূলনীতিগুলো ১৯৩১ সালে প্রথম প্রকাশ করেন, যা ১৯৩৭ সালে তুরস্কের সংবিধানে যুক্ত হয়। কামাল আতাতুর্কের অধীনে তুরস্কে যে কেমালিজম দেখা যায় তার মূলনীতি ছিল ছয়টি। এগুলো হলো, Republicanism (অটোমান সাম্রাজ্যের স্থলাভিষিক্ত), Populism (কৃষকদের দেশের মূল শক্তি ধরা হয়), Secularism (রাষ্ট্রের সাথে ধর্মের বিচ্ছেদ না হলেও শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিচার বিভাগ থেকে ধর্মকে আলাদা করা হয়), Reformism (চিরাচরিত আচার-অভ্যাস থেকে আধুনিকতায় গমন), Nationalism (তুর্কি জাতীয়তাবাদ), Statism (অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ)।

অন্যদিকে লেখচিত্রে E হলো এমন এক অবস্থান, যেখানে হান্টিংটন বলতে চাচ্ছেন একটি রাষ্ট্র আধুনিকায়িত হতে হতে এক পর্যায়ে আর নিজের পশ্চিমায়ন মেনে নেয় না বরং তখন আধুনিকায়ন ধনাত্মক দিকে চলতে থাকলেও পশ্চিমায়ন হয়ে যায় ঋণাত্মক। এর পেছনে তিনি দুইটি কারণ উল্লেখ করেছেন। প্রথমত, অর্থনৈতিক, সামরিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে রাষ্ট্র যত এগিয়ে যায়, তার সাথে সাথে রাষ্ট্রের ভেতর নিজেদের নিয়ে এক ধরনের অহমিকা তৈরি হয়। আর এর ফলে রাষ্ট্র তার নিজের সংস্কৃতিগত ঐতিহ্যকে আপন করে নেয়। দ্বিতীয়ত, আধুনিকায়নের পেছনে থাকা প্রাযুক্তিক উৎকর্ষের ফলে মানুষ পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এই সদাবিচ্ছিন্ন নাগরিক সমাজকে ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্য কিছু সাধারণ ঐতিহ্যের প্রয়োজনীয়তা দেখা যেয়, যার ভিত্তিতে সবাইকে এক ছাতার নিচে নিয়ে আসা যায়। হান্টিংটন মনে করেন, কামাল আতাতুর্কের তুরস্কে যে কেমালিজম দেখা দিয়েছিল, পরিণততে এসে তার ফলাফল ছিল এমন একটি অবস্থান; অর্থাৎ আধুনিকায়নের একটি পর্যায় পর্যন্ত পশ্চিমায়ন, কিন্তু এরপর থেকে পশ্চিমায়নের ঋণাত্মক অভুমুখীনতা।

অর্থাৎ, লেখচিত্রে নির্দেশিত প্রতিটি অবস্থানের পেছনে কোন না কোন আদর্শিক বা দর্শনগত ভিত্তি কাজ করেছে। কোন কোন রাষ্ট্র শুধু পশ্চিমায়নের দিকে ঝুঁকেছে, কোনটি শুধু আধুনিকায়নের দিকে, আবার কোন কোন রাষ্ট্র উভয়ের দিকেই ঝুঁকেছে। এই অবস্থান থেকে আমরা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দর্শনগত অবস্থান নিয়ে আলোচনা করবো, কারণ বাংলাদেশের চার মূলনীতি তথা গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা, সবগুলো নীতিই দিনশেষে পশ্চিম থেকেই আগত।

 

লেখার শুরুতেই এই আলোচনায় পিনাকী ভট্টাচার্য ও মওদুদ আহমদের বক্তব্য দিয়ে আমাদের সংবিধানের চার মূলনীতি নিয়ে একটি ব্যতিক্রমী ডিসকোর্সে আলোকপাত করা হয়েছিল। ঠিক এ ধরনের না হলেও আরেকটি ভিন্ন ডিসকোর্স নিয়ে আলোচনা করেছেন সেলিম রেজা নিউটন। নিউটন বলতে চাচ্ছেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মূলত কোন মৌলিক রূপকল্প ছিল না। এই মৌলিক রূপকল্প থাকলেও থাকতে পারতো এমন তিনটি ভিন্ন অংশের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন। প্রথমত, দেশীয় বুর্জোয়া শ্রেণি; এদের কোন মৌলিক রূপকল্প ছিল না কারণ রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে তারা মূলত পশ্চিম পাকিস্তানি তথা পাঞ্জাবি বুর্জোয়াদের স্থলাভিষিক্ত হয়ে পাঞ্জাবিদের দখলে থাকা অর্থনৈতিক ও ব্যবসায়িক সুবিধাগুলো কুক্ষিগত করতে চেয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, বামপন্থিগণ; তাদের মৌলিক রূপকল্প ছিল না কারণ স্বাধীনতার প্রশ্নে তারা অন্য সব ইস্যুর মতোই মস্কো-পিকিং দ্বন্দ্বে রত ছিলেন এবং যার যার অবস্থান অনুযায়ী মস্কো বা পিকিং-এর রাজনৈতিক অবস্থানের অন্ধ অনুকরণ করেছেন মাত্র। তৃতীয়ত, দেশীয় কৃষক শ্রেণি; নিউটন বলতে চাচ্ছেন এই শ্রেণিটির আসলে বাস্তবতাই ছিল না তাদের রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার রূপকল্প নিয়ে ভাবার, যদিও তারা ছিলেন রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান অংশীজন।

কিন্তু বাস্তবতা হলো, এতসব ভিন্ন ডিসকোর্স কিংবা না থাকার ভেতরও আমাদের সংবিধানের চারটি মূলনীতিকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, এটিই আমাদের প্রভাবশালী ডিসকোর্স। তাহলে সেই চার মূলনীতির সাপেক্ষে বিদ্যমান সংকট নিয়েই এই আলোচনাটির এগিয়ে যাওয়া উচিত।

ক) গণতন্ত্র: প্রাচীন গ্রিস থেকে গণতন্ত্রের ধারণার সূত্রপাত হলেও, বর্তমান সময়ে আমরা যে গণতন্ত্রের পূজায় ব্যস্ত থাকি তা মূলত পশ্চিমা তথা মার্কিন ধাঁচের গণতন্ত্র, অর্থাৎ ‘Check and balance’ ভিত্তিক গণতন্ত্র। বাংলাদেশ রাষ্ট্রে এই গণতন্ত্রের ইতিহাস বেশ নাজুক। স্বাধীনতার তিন বছরের মাথায় একটি মাত্র দলকে জাতীয় দল (বাকশাল) আখ্যা দিয়ে ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’-এর কর্মসূচিকে দেশের অনেক পক্ষই গণতন্ত্রের প্রতি আঘাত হিসেবে চিহ্নিত করে থকেন। একই বছর বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশটির গণতন্ত্র সেই সময়েই মূল হোঁচট খায় বলে প্রতীয়মান হয়, যার ফল দাঁড়ায় ১৫ বছরের সেনাশাসন; যদিও এই সময়কালে তিনটি সাধারণ নির্বাচন, দুইটি রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ও দুইটি গণভোটের আয়োজন হলেও তা গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি কোন অর্থেই। এরশাদের নয় বছরের স্বৈরশাসনের পর বাংলাদেশ মূলত দ্বি-দলীয় গণতন্ত্রে পদার্পণ করে। কিন্তু ১৯৯১ সাল থেকে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতর আস্থার সঙ্কট গণতন্ত্রকে পুনরায় হুমকির মুখে ফেলে। এর ফলে সামনে আসে নিরপেক্ষ (?) তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা, যা কোনভাবেই গণতান্ত্রিক নয়, নিরপেক্ষ যে নয় তা আমাদেরে ইতিহাস ও রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকাণ্ডই বলে দেয়। স্মরণকালের ভেতর ১৯৯১ সালের পঞ্চম ও ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ব্যতীত অন্য কোন জাতীয় নির্বাচন প্রকৃতপক্ষেই সুষ্ঠু হয়েছে, এমনটা বলতে নারাজ দেশের কোন না কোন পক্ষের অংশীজনেরা। ১৯৯১ সালের নির্বাচনটি হয়েছিল বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের অরাজনৈতিক সরকারের অধীনে। ২০০৮ সালের নির্বাচনটিও হয়েছিল দুই বছরের একটি অগণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় থাকার পর, সেই অগণতান্ত্রিক সরকারেরই অধীনে, বেশ ভালো পরিহাস! আর আমাদের সাধারণ নির্বাচনগুলো আসলে কীভাবে হবে, কার অধীনে হবে তা নিয়ে কোন নিশ্চিত অবস্থান এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রটি তৈরি করতে পারেনি।

খ) সমাজতন্ত্র: বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আদর্শ হিসেবে ‘সমাজতন্ত্র’ প্রত্যয়টি বেশ আগ্রহোদ্দীপক। কারণ জনপ্রিয় ডিসকোর্সে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এনে দেয়া দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ পাকিস্তান আমলে কখনো ‘সমাজতান্ত্রিক’ আদর্শ প্রচার করেছে, এমন দৃষ্টান্ত খুব একটা দেখা যায় না। বরং দলটি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যবিত্ত ও উঠতি বুর্জোয়াদের সমর্থনপুষ্ট এবং কমিউনিস্ট বিরোধী। বঙ্গবন্ধু নিজে যে কমিউনিস্ট ভাবধারার পক্ষে ছিলেন না, তা একাধিকবার তাঁর নিজের লেখা গণচীন ভ্রমণের স্মৃতিকথায় উঠে এসেছে। যত দূর বোঝা যায়, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বৈশ্বিক রাজনীতিতে চলমান ঠাণ্ডা যুদ্ধের উত্তাপেই সমাজতন্ত্র বাংলাদেশ রাষ্ট্রে তার অবস্থান তৈরি করে নেয়, সাথে তরুণ ছাত্রনেতাদের সমাজতন্ত্রের প্রতি রোমান্টিসিজম এই পালে জোর হাওয়া দিয়েছিল বলেই মনে হয়। অথবা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি হয়তো বুঝতে পেরেছিল যে, সমাজতন্ত্রে গমনই তার জন্য অপেক্ষাকৃত উত্তম। ঘটনা যাই হোক না কেন, এই যে রাষ্ট্রের আদর্শ হিসেবে সমাজতন্ত্রকে গ্রহণ করা, তার ছিল নানামুখী সীমাবদ্ধতা। ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ যুদ্ধের আগে পর্যন্ত পশ্চিমা ধাঁচের গণতান্ত্রিক দল হিসেবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে এসেছে, যুদ্ধের পর গণতন্ত্রের সাথে সাথে বলেছে সমাজতন্ত্রের কথা। কিন্তু দলের ভেতর কোন র‍্যাডিকেল পরিবর্তন আসেনি, কিংবা দলের কর্মীরাও র‍্যাডিকেল হয়ে ওঠেনি। পশ্চিম পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া শিল্প কারখানাগুলোর জাতীয়করণ ছাড়া আর কোন সমাজতান্ত্রিক ধারার কার্যক্রমও সেই সময়ে দেখা যায় নি, যদি এই জাতীয়করণকে ‘সমাজতান্ত্রিক’ বলা যায়। মূলত দৃশ্যমান কোন সমাজতান্ত্রিক রূপরেখা আমাদের সামনে ছিল না। এভাবে শুধুমাত্র ঘোষণা দিয়ে হুট করে সমাজতান্ত্রিক হয়ে ওঠা যায় কিনা, তা নিয়েও তো রয়েছে তাত্ত্বিক বিতর্ক। লেনিন তাঁর বলশেভিক বিপ্লবটি হুট করে মঞ্চায়ন করলেও, এর পেছনে সমাজতান্ত্রিক চর্চা ও আন্দোলন তো অল্প দিনের নয়, পথটাও ছিল দীর্ঘ চড়াই-উৎড়াই পেরুনো। আবার, সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাস থেকেও দেখা যায়, অন্তত ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত রষ্ট্রটি সমাজতন্ত্রে উত্তরণের কার্যক্রম গ্রহণ করে তা বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে গিয়েছে। ১৯৫৯ সালে ঘোষিত সোভিয়েত ইউনিয়নের সাতসালা পরিকল্পনাতেই প্রথম দেখা গিয়েছিল সমাজতন্ত্র থেকে সাম্যবাদ বা কমিউনিজমে উত্তরণের লক্ষ্যে ঘোষিত কর্মসূচি। অর্থাৎ, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর রাশিয়া তথা সোভিয়েত ইউনিয়নের চার দশকের বেশি সময় লেগেছিল প্রকৃত সমাজতন্ত্রে উত্তরণে, সেটিও অত্যন্ত পরিকল্পিত ও ধাপে ধাপে গৃহীত লক্ষ্য বাস্তবায়নের মাধ্যমে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যার অভাব এখনো চোখে পড়ার মতো। যদিও ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মতো মর্মান্তিক ঘটনার ফলে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন না ঘটলে এবং বাকশাল কার্যক্রম বাস্তবায়িত হলে কী হতো, তা নিয়ে পুরোপুরি ভিন্ন একটি আলোচনার সুযোগ রয়ে গিয়েছে। কিন্তু আহমদ ছফাকে স্মরণ করে তাঁর ভাষায় এটুকু বলি যে ‘যদি বা কিন্তু’ দিয়ে ইতিহাস হয় না, যা ঘটেছে তাই ইতিহাস। তাই বাংলাদেশে এভাবে সমাজতন্ত্র আমদানির চেয়ে সংবিধানে উল্লেখকৃত সমবায় মালিকানার দিকে জোর দেয়া হলে তা বেশি ফলপ্রসূ হতো বলে মনে হয়। আর এটিও মনে রাখা উচিত যে, সোভিয়েত ইউনিয়নেরও সমাজতন্ত্রে উত্তরণের একটি বিশেষ কার্যক্রম ছিল যৌথখামার ব্যবস্থা, যা একধরনের সমবায় কার্যক্রম। আর বঙ্গবন্ধু হত্যার পরের সরকারগুলো সমাজতন্ত্রের সংজ্ঞা পাল্টে সমাজতন্ত্র নামে যে তামাশা সংবিধানে রেখেছিল, তা নিয়ে কিছু বলার থাকে না। শেষ বিচারে এটি এখনও অনেকটাই অস্পষ্ট যে, আমাদের সংবিধানের উল্লেখকৃত সমাজতন্ত্রের মূল কথা আসলে কী, তবে সেই অস্পষ্টতাকে অনেকে ব্যক্তিগত ব্যর্থতা বলতেই পারেন! তাছাড়া সোভিয়েত ধাঁচের কার্যক্রমকেই একমাত্র সমাজতান্ত্রিক কার্যক্রম ধরে নেয়া এই ব্যাখ্যার বিরোধিতাও আসতে পারে, সেক্ষেত্রে আলোচনায় স্বাগতম!

গ) জাতীয়তাবাদ: জাতীয়তাবাদ নিয়ে আমাদের দেশের প্রধান দুই দলের বচসা বেশ উপভোগ্য। কিন্তু দিন শেষে এই ঝগড়া-ঝাটি তাত্ত্বিক দিক থেকে ফাঁপাই মনে হয়। বাঙালি বা বাংলাদেশি কোন ধরণের জাতীয়তাবাদ নিয়েই দেশে কোন ধরনের গঠনমূলক বিতর্ক নেই। আলোচনা না বলে বিতর্ক বলার কারণ বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষের মানুষেরা নানা সময় বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাংলাদেশে এর গুরুত্ব নিয়ে লেখালেখি করেছেন। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ সংবিধানে বহুদিন অবস্থান করলেও তা নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা খুব বেশি দেখি নি। আর দুই ধরণের জাতীয়তাবাদকেই কিছু প্রশ্নের সামনে অসহায় মনে হয়। যেমন, আদিবাসীদের জাতীয়তাবাদ বাঙালি না বাংলাদেশি, ধর্মের ভিত্তিতে জাতীয়তাবাদের কোন সিদ্ধ অবস্থান রাষ্ট্রে আছে কিনা ইত্যাদি। এই লেখার উদ্দেশ্য শুধুমাত্র দর্শনগত সঙ্কটের দিকে আলোকপাত করা বিধায় বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদের সঙ্কট নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা এখানে সম্ভব নয়। কিন্তু এক্ষেত্রে মূল কথা হলো, আমরা যে ধরনের জাতীয়তাবাদের কথাই বলি না কেন তা স্পষ্ট হতে হবে, যা এখন পর্যন্ত স্পষ্ট নয়। বর্তমানে আমরা বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে বলছি, বাংলা ভাষার উপর গুরুত্ব দেয়া এই জাতীয়তাবাদী চেতনায় পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষী এবং আমাদের পার্বত্য ও অন্যান্য অঞ্চলে অ-বাংলাভাষীদের অবস্থান কোথায় হবে তার উত্তর না থাকা একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় সঙ্কট হিসেবেই সামনে চলে আসে বারংবার।

ঘ) ধর্মনিরপেক্ষতা: বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা মূলত অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে নির্দেশ করে বলে ধরে নেয়া হয়। আর এই মূলনীতিটিই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভবের সময় ও স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে ব্যাপকভাবে আঘাতের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। স্বাধীনতার পূর্বে আওয়ামী লীগ মানেই বিধর্মী তথা হিন্দু, হিন্দু মানেই ভারতের এজেন্ট, বাঙালি মানে অবিশুদ্ধ বা আংশিক মুসলমান প্রভৃতি ডিসকোর্স যেমন ছিল, তেমনি স্বাধীনতার পর এই ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধান তথা রাষ্ট্রের মূলনীতি করায় অনেক ইসলামি রাষ্ট্রের নেতিবাচক দৃষ্টিতে পড়তে হয়েছিল বাংলাদেশকে। এমনকি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রাথমিক ফলাফল ছিল বাংলাদেশকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করা। এরপর সংবিধানে যুক্ত হয়েছে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’, মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতার স্থলে এসেছে আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস (৫ম সংশোধনী); ইসলাম ধর্মকে করা হয়েছে রাষ্ট্রধর্ম (৮ম সংশোধনী)। উচ্চ আদালতের রায়ে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষিত এবং বিভিন্ন সময় রাষ্ট্রধর্ম প্রবর্তনের বিষয়ে রাজনীতিকদের নেতিবাচক অবস্থান ও বক্তব্য দেখা গেলেও, সংবিধানে এই পরিবর্তনগুলো এখনো বহাল রয়েছে (তবে মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরে এসেছে)। অর্থাৎ সংবিধান তার অসাম্প্রদায়িক তথা ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থানে নেই দীর্ঘদিন ধরে, অথচ সংবিধানের মূলনীতিতে রয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতা। বড়ই আজব এক অবস্থা!

এক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য দিক হলো, সোভিয়েত ইউনিয়নের ১৯৩৬ সালের সংবিধান, যা স্ট্যালিন সংবিধান নামে খ্যাত, সেই সংবিধানে রাষ্ট্র ও জনগণের জন্য যেসব নীতি ও অধিকার স্বীকার করে নেয়া হয়েছিল, সেগুলো সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার পূর্বেই বাস্তবায়িত অবস্থায় ছিল। অর্থাৎ সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে বিষয়গুলোকে চর্চার সাথে সাথে বিধিবদ্ধ করা হয়েছিল মাত্র। বিপরীত দিকে আমাদের দেশের রাষ্ট্রীয় মূলনীতিগুলো অনেকটাই চাপিয়ে দেয়া বিষয়ের মতো হয়ে গিয়েছে। দেখা যায় নি, বা যাচ্ছে না কোন নির্দিষ্ট নীতিমালা, কর্মসূচি ও চর্চার মাধ্যমে অর্জন করার কোন বিষয়।

 

সংবিধানের মূলনীতিসমূহ, যেগুলোকে কোন কোন আইনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলা হয়েছে, সেসব প্রশ্নে দর্শনগত সঙ্কট থাকার ফলাফল দাঁড়াচ্ছে রাষ্ট্রের নাগরিকদের ভেতর বিভাজন। এক্ষেত্রে কোনভাবেই এমনটি বলা হচ্ছে না যে সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ কিংবা রাষ্ট্রধর্মের অবস্থানই এসব বিভাজনের জন্য দায়ী; আবার এর মানে এটিও নয় যে এই বিষয়গুলোর সংবিধানে থাকা অকাট্য যুক্তিযুক্ত। এখানে আলোচনাটি লেখকের পক্ষে-বিপক্ষে থাকার নয়, বরং এটি অনেক বেশি নৈর্ব্যক্তিক একটি বিষয়। তুরস্কের কেমালিজম নিয়ে আলোচনার সময় আমরা দেখেছি কেমালিজমের ভেতর ইসলাম ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয় নি; বরং শিক্ষা, সংস্কৃতি, আইনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো থেকে ধর্মকে আলাদা করা হয়েছে ন্যায়বিচারের স্বার্থে, বৈষম্য দূর করতে। ধর্ম প্রশ্নে তুরস্কের এই অবস্থান সঠিক না ভুল, সেটিও কিন্তু এই আলোচ.নার মূল বিষয় নয়। মূল বিষয় হলো তুরস্ক অন্তত নির্ধারণ করতে পেরেছে তাদের রাষ্ট্রটিতে ধর্মের অবস্থান কোথায় ও কেমন হবে। বর্তমান লেখায় এটিই বলতে চাওয়া হচ্ছে যে, কোন বিষয়ে নির্দিষ্ট একটি অবস্থান, একটি দর্শনগত ভিত্তি, এই ভিত্তিটা জরুরি কারণ এর ফলেই দিনশেষে একটি রাষ্ট্র গড়ে ওঠে, যা একীভূত রাখে নানা ধরণের বৈশিষ্ট্যের বৈচিত্র্যপূর্ণ নাগরিকদের।

দুর্ভাগ্যজনক হলো বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি জন্মের ৫১ বছরে এসেও এমন কোন দর্শনগত ভিত্তি তৈরি করতে পারেনি যা দিনশেষে রাষ্ট্র তথা এর নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ রাখবে। হান্টিংটন বলেছিলেন উন্নয়নের একটি ফলাফল হিসেবে নাগরিকরা যখন পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তখন অনেক ক্ষেত্রেই ধর্মের ভেতর তারা ঐক্যের সূত্র খুঁজে পায়। কিন্তু বর্তমান সময়ে ধর্ম নিয়ে আমরা যে বাইনারির ভেতর থাকি, সেখানে ধর্মের মাধ্যমে ঐক্যের পক্ষের লোকেরা সাধারণত ‘মৌলবাদী’ ও বিপক্ষের লোকেরা মূলত ‘নাস্তিক’ বলে পরিচিতি পাচ্ছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আন্তর্জাতিক প্রপঞ্চ যেখানে ইসলাম ধর্ম প্রধানতম একটি ফ্যাক্টর, এই মুদ্রার অপর পিঠেই রয়েছে মতাদর্শ হিসেবে কট্টর সুন্নি তথা সালাফিবাদের উত্থান।

এসব বিষয় ছাড়াও আরও মৌলিক বিষয় হলো, একটি রাষ্ট্রের দর্শনগত ভিত্তি বা অবস্থানগুলো এমন সময় নির্ধারণ করে ফেলতে হয়, যে সময় রাষ্ট্রের সকল অংশের নাগরিকদের ভেতর সাধারণ ঐকমত্য থাকার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই ঐকমত্য ১৯৭১ সালের পর আর কখনো আসেনি, নিকট ভবিষ্যতে আবার তা উদ্ভূত হওয়ার কোন লক্ষণ দেখাও যাচ্ছে না। ফলে নাগরিকদের একেকটি অংশ নিজেদের মতো কখনো পশ্চিমায়ন, আলোকায়নের পিছে ছুটছেন; আরেকটি অংশ ধর্মকে আঁকড়ে ধরেছেন। বিপজ্জনক বিষয় হলো এই মূল পক্ষগুলো একে অপরকে খারিজ করে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। ফলে রাষ্ট্রের নাগরিকদের ভেতর ঐকমত্যের ভিত্তি ভয়াবহ দুর্বল অবস্থায় থেকে যাচ্ছে, যে কোন ইস্যুতে সাইবার জগতে সহজেই বিভক্ত হয়ে যাওয়া এর একটি ফলাফল হিসেবে সামনে আসছে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দর্শনগত সঙ্কটগুলোই রাষ্ট্রের মূল সংকট ও ভবিষ্যত সময়ে নাগরিকদের ভেতর ভয়াবহ বিভাজনের দিকেই ইঙ্গিত করে না কি?

 

তথ্য ও সহায়ক সূত্র:

আহমদ, মওদুদ। (১৯৮৭)। বাংলাদেশ: শেখ মুজিবর রহমানের শাসনকাল (জগলুল আলম অনূদিত)। ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড।

আহমদ, মহিউদ্দিন। (২০১৬)। বিএনপি: সময়-অসময়। প্রথমা।

আহমদ, মহিউদ্দিন। (২০১৯)। এক-এগারো: বাংলাদেশ ২০০৭-২০০৮। প্রথমা।

জালাল, এম এম আর, এবং দে, বিদ্যুৎ। (২০২০, মার্চ ৭)। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। বিডিনিউজ২৪.কম। https://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/59825

নিউটন, সেলিম রেজা। (২০১৫)। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট: কর্তৃত্বপরায়ণ সমাজতন্ত্রের প্রচ্ছন্ন রূপকল্প। সূত্র অচেনা দাগ: সম্পর্ক স্বাধীনতা সংগঠন, পৃ. ১৩৯-১৬৪। আগামী।

পনমারেভ, ব. ন.। (১৯৭৬)। সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস (বিষ্ণু মুখোপাধ্যায় অনূদিত)। প্রগতি প্রকাশন।

ভট্টাচার্য, পিনাকী। (২০১৭)। মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে ইসলাম। গার্ডিয়ান।

মুহাম্মদ, আনু। (২০১৯)। সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতান্ত্রিক রূপান্তর: বিতর্ক ও প্রচেষ্টা (১৯১৭-১৯৪৫)। সূত্র অনুন্নত দেশে সমাজতন্ত্র, পৃ. ৩৫-৭১। সংহতি।

রশীদ, মামুন অর। (২০১৯)। উত্তর-আধুনিকতা। সংবেদ।

রহমান, শেখ মুজিবুর। (২০২০)। আমার দেখা নয়াচীন। বাংলা একাডেমি।

রীড, জন। (২০১৮)। দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন। মাটিগন্ধা।

হান্টিংটন, স্যামুয়েল পি.। (২০১০)। দ্য ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশনস্‌ অ্যান্ড দ্য রিমেকিং অব ওয়ার্ল্ড অর্ডার (ড. মোহাম্মদ আবদুর রশীদ অনূদিত)। অনিন্দ্য।

Butler, C. (2010). Modernism: A very short introduction. Oxford University Press.

Dewdney, J. C., & Yapp, M. E. (2020, May 10). Turkey. Encyclopedia Britannica. https://www.britannica.com/place/Turkey

Kemalism: Ataturk’s principles. (n.d.). AllAboutTurkey.com. https://www.allaboutturkey.com/ataturk-principles.html

Durgaraju. N. (2016, September 13). Clash of Civilizations and the losing battle of Indian liberalism and secularism. Medium. https://medium.com/@naveend23/clash-of-civilizations-and-the-losing-battle-of-indian-liberalism-and-secularism-8473f69b0cf5

 

(রচনাকাল: ১৬.০৫.২০২০-৩০.০৯.২০২২)

২ thoughts on “বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দর্শনগত সঙ্কট: একটি হাইপোথিটিক্যাল আলোচনা”

  1. আপনার সাথে পুরোপুরি একমত তিনটি বিষয়ে। ধর্মনিরপেক্ষতা , সমাজতন্ত্র আর আমাদের ঐক্যের মূলনীতি। আমাদের যে রাষ্ট্র ব্যবস্থা, আমারা আসলে কিসের ভিত্তিতে সকলে এক কাতারে এসে একত্র হব তা স্পষ্ট নয়। সবাধীনতার ৫১ বছরেও আমরা এই ঐক্যের জায়গায় না আসতে পারাটা চরম ব্যর্থতার। এই ঐক্য বা চেতনার বিষয়টা আগে এভাবে চিন্তা করিনি। আপনার আলোচনা থেকে মাথায় আসল। সমাজতন্ত্র আর ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টি বেশ আগেই ধরতে পেরেছিলাম যে, আসলে কী সেই সমাজতন্ত্র যা আমাদের সংবিধানের মূলনীতি, আর কীভাবে এই একটি ধর্মকে হাইলাইটস করে ধর্মনিরপেক্ষতা! সবইতো জনসমর্থন পাওয়ার জন্য একটা একটা করে টার্ম জুড়ে দেওয়া। দেশের যে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল তাদের মধ্যেও বা কতখানি এই বিষয়ে সচেতনতা আছে? কতখানি ভেবেছে? তারা তো এইগুলোর চর্চা একেক ভাবে করে তাদের নির্বাচনী সবার্থে!

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।