শিবলী নোমান

জাতীয়তাবাদ: বাংলাদেশের অগ্নি অথবা জল

শিবলী নোমান

[সার-সংক্ষেপ: বাংলাদেশের ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদ একটি অমীমাংসিত কিন্তু সুদূরপ্রসারী ইস্যু। স্বাধীনতার ৫১ বছর পরও রাষ্ট্রটি তার জাতীয়তাবাদী চেতনা কী হবে তা নির্ধারণে ঐকমত্যে আসতে পারে নি। একদিকে বাংলা ভাষাভাষী ও বাঙালি জাতিকে ভিত্তি করে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, অন্যদিকে ইসলামী ভাবধারা ও সেক্যুলারিজমের মিশ্রণে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ নিয়ে বিতর্কের বিস্তৃত পরিসরে কোন গঠনমূলকতাও দৃশ্যমান নয়। অন্যদিকে বিবাদমান এই দুই জাতীয়তাবাদী চেতনা নিয়েও রয়েছে বিভিন্ন অগ্নিময় ধোঁয়াশা। বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী চেতনা সংজ্ঞায়নের পূর্বে তাই প্রয়োজন কতিপয় প্রশ্নের উত্তর। এই প্রবন্ধে সেই প্রশ্নগুলোই অনুসন্ধানের চেষ্টা করা হয়েছে।]

 

ফরাসি বিপ্লবের পর থেকে আধুনিক জাতিরাষ্ট্রে জাতীয়তাবাদ একটি বহুল আলোচিত ইস্যু। যদিও ২৫০০ বিসিইতে সুমেরীয় সভ্যতার সময়েও জাতীয়তার আলোকে ‘আমরা’ (Us) ও ‘অন্যরা’ (Others)-র ভেতর বিভাজন তৈরির প্রবণতার প্রমাণ রয়েছে, একই সাক্ষ্য রয়েছে প্রাচীন গ্রিক ও চৈনিক সভ্যতাতেও (Grosby, 2005)। অন্যদিকে, সাধারণ অর্থে কোন জাতির সদস্যদের সাধারণ বিশ্বাসের সমষ্টিকে জাতীয়তাবাদ বলা হয় বিধায় এই লেখায় সচেতনভাবেই ফরাসী বিপ্লবকে জাতীয়তাবাদ নিয়ে চিন্তার শুরু বলা হচ্ছে, এর কারণ কতিপয় পন্ডিত ফরাসি বিপ্লবের চেতনায় জাতীয়তাবাদের কতিপয় বৈশিষ্ট্য নিহিত ছিল, এই বক্তব্যের পক্ষে তাঁদের অবস্থান প্রকাশ করেছেন (Karim, 1992)। ১৭৫৭ সাল থেকে প্রায় ১৯০ বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন এবং তার ফলাফল হিসেবে ভারত বিভাগের মাধ্যমে পুনরায় ২৪ বছর পাকিস্তানের শাসকদের শোষণের পর বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করে আজকের বাংলাদেশ। গত ৫১ বছরে রাজনৈতিক বিষয়ের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা যেমন দ্বিধাবিভক্ত হয়েছি, তেমনি জাতীয়তাবাদের মত মৌলিক ইস্যুতেও আমরা কোন ধরণের ঐক্যবদ্ধতা বা ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারি নি। বরং ‘বাঙালি’ না ‘বাংলাদেশি’, কোন জাতীয়তাবাদকে গ্রহণ করা হবে তা নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক এতটাই বেড়েছে যে এখন শুধু বিতর্কের পক্ষগুলোর হুঙ্কার শোনা যায়, কিন্তু দুই ধরণের জাতীয়তাবাদের তাত্ত্বিক আলোচনা দুই পক্ষের কাউকেই খুব একটা করতে দেখা যায় না।

এমতাবস্থায় বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে জাতীয়তাবাদী চেতনার সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করা দুরূহ। জাতীয়তাবাদ মূলত এমন এক রাজনৈতিক আদর্শ যা সম্প্রদায়গত স্বশাসন, সার্বভৌমত্ব, এবং সংস্কৃতি, ভাষা ও রাজনৈতিক লক্ষ্যের সাধারণ প্রকাশভঙ্গি হিসেবে বিবেচিত হয় (Nationalism, 2016)। জাতীয়তাবাদকে কোন জাতির একগুচ্ছ বিশ্বাসের একটি সেটও বলা যেতে পারে (Grosby, 2005)। যদি জনগণের হাতে স্বশাসনের অধিকার না থাকে তাহলে জাতীয়তাবাদ হলো সেই অনুভূতি যার ফলে জনগণ ঐক্যবদ্ধ থাকে এবং স্বশাসনের রাজনৈতিক ইচ্ছা পোষণ করে। অন্যদিকে, যদি কোন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠীকে নিয়ে আলোচনা করা হয়, তাহলে জাতীয়তাবাদ হলো একটি শক্তিশালী জাতিরাষ্ট্র গঠনের জন্য শক্তিশালী রাজনৈতিক ইচ্ছার অনুভূতি। এই অনুভূতি একই ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ভৌগলিক এলাকা প্রভৃতির সাধারণ সদস্যদের ভেতর গড়ে ওঠে (Karim, 1992)। এ প্রসঙ্গে কে. কে. আজিজ বলেন,

nationalism can be a sentiment or a policy, or a myth or a dogma, or a doctrine. It is a sentiment when it is the love of a common soil, race, language or culture. It is a policy when it is a desire for independence, security or prestige. It is a myth when it is a mystical devotion to a vague social whole. (উদ্ধৃতি Karim, 1992, P- 10)

মূলত তিনটি পৃথক প্যারডাইম থেকে আমরা জাতীয়তাবাদ নিয়ে আলোচনা হতে দেখে থাকি। প্রথমত, Primordialism, এতে জাতীয়তাবাদকে আদি ধারণা হিসেবে গ্রহণ করা হয়; বলা হয় রাষ্ট্রের উদ্ভব হওয়ার আগে থেকেই জাতীয়তাবাদের অস্তিত্ব ছিল। দ্বিতীয়ত, Ethnosymbolism, এতে ইতিহাসের আলোকে জাতীয়তাবাদসমূহকে সংজ্ঞায়নের চেষ্টা করা হয়ে থাকে। তৃতীয়ত, Modernism, এখানে ধরে নেয়া হয় যে, যে কোন রাষ্ট্রের টিকে থাকার জন্য জাতীয়তাবাদ অপরিহার্য বিষয় (Nationalism, 2016)।

জাতীয়তাবাদসমূহের প্রধান দুইটি বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিশ্বাস বা আদর্শ নয়, বরং ভাষা, রক্ত ও ভৌগলিক এলাকাকে এর প্রধান ভিত্তি হিসেবে গণ্য করা এবং মাতৃভূমির প্রতি সর্বোচ্চ মাত্রার আনুগত্যের কথাও বলা হয়ে থাকে (Naqvi, 1985)। হানস কোহন জাতিরাষ্ট্রের প্রতি ‘supreme secular loyality’-কে জাতীয়তাবাদের প্রধান উপাদান হিসেবে উল্লেখ করেছেন (উদ্ধৃত Karim, 1992)। এছাড়া অন্যান্য বৈশিষ্ট্য হিসেবে জাতীয় বীরদের প্রতি পরম শ্রদ্ধা, পূর্ব ঐতিহ্যের পুনর্জাগরণ, নিজ জাতিকে বড় দেখাতে ইতিহাস বিকৃতি এবং জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত ও জাতীয় প্রতীকসমূহকে পবিত্র ও জীবনদানতূল্য গণ্য করার কথাও বলা হয় (Naqvi, 1985)। অন্যদিকে সি. জে. এ. হায়েস জাতিসত্বাগত ও ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যাবলিকে এশিয়ার জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হিসেবে উল্লেখ করে জাতীয়তাবাদকে মূলত ‘অসহিষ্ণু’ ও ‘আদর্শিক’, এই দুইভাগে ভাগ করেছেন (চৌধুরী, ১৯৯১)।

বিভিন্ন ধরণের জাতীয়তাবাদসমূহের ভেতর মূলত পাঁচ ধরণের জাতীয়তাবাদকে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী চেতনা নিয়ে আলোচনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা প্রয়োজন। এই পাঁচ ধরণের জাতীয়তাবাদ হলো জাতিগত জাতীয়তাবাদ, ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ, ভাষাগত জাতীয়তাবাদ, উপনিবেশ-বিরোধী জাতীয়তাবাদ এবং সিভিক জাতীয়তাবাদ। বলে নেয়া ভালো যে, একই জাতিরাষ্ট্রের বিকাশের একেক পর্যায়ে একেক ধরণের জাতীয়তাবাদ দেখা যেতে পারে (Karim, 1992)। ভারতীয় উপমহাদেশে উপনিবেশ-বিরোধী জাতীয়তাবাদের শুরু হয়েছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে। মোটাদাগে উপনিবেশ-বিরোধী সকল আন্দোলনই এই ধরণের জাতীয়তাবাদী চেতনা থেকে উদ্বুদ্ধ। তবে ভারতবর্ষ থেকে আলোচনাকে সীমিত করে বাংলাদেশের গণ্ডিতে রাখতে চাইলে বলতে হয় যে, ভারতবর্ষের হিন্দুদের জন্যে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন উপনিবেশ-বিরোধী জাতীয়তাবাদী চেতনা হলেও মুসলমানদের ক্ষেত্রে তা ছিল একই সাথে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী চেতনাও। একে বলা যেতে পারে মুসলিম জাতীয়তাবাদী চেতনা। পাকিস্তানকে উপনিবেশ-বিরোধী জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ‘বাইপ্রোডাক্ট’ হিসেবেও উল্লেখ করা হয়েছে কোন কোন লেখায় (প্রজন্ম৮৬, ২০১৬)। উপরন্তু বের্নার অঁরি লেভি বলতে চান যে ব্রিটিশ শাসকদের বিভিন্ন কৌশলের ফলেই ভারতীয় মুসলিমদের ভেতর ইসলামি জাতীয়তাবাদের উদ্ভব সম্ভব হয়েছিল, যা ছিল অস্বাভাবিক, প্রকৃতিবিরোধী এবং অত্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল (লেভি, ২০১৭)। ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পর এই জাতীয়তাবাদী চেতনাগুলো স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) আর কাজ করে নি। পাকিস্তান আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ ধরে নিয়েছিলেন ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী চেতনার মাধ্যমে পাকিস্তানের দুই অংশের ভৌগলিক দূরত্ব, ভাষাগত অমিল ও সাংস্কৃতিক পার্থক্য দূর করা যাবে। কিন্তু অবিভক্ত পাকিস্তানের ২৪ বছরের ইতিহাস প্রমাণ করেছে যে, জাতীয়তাবাদ কোন আবেগের বিষয় নয় (Karim, 1992)।

উপরন্তু এ সময়ের ভেতর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের বিরূপ মনোভাব ও বৈষম্যের কারণে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার নব-উদ্ভব ঘটে। ১৯৫০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের উপর পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্য, রাজনৈতিক বলপ্রয়োগ ও বঞ্চনা এবং সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টার ফলেই বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটে। এছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের বাঙালি পরিচয় গোপন করে পাকিস্তানি চেতনা বিকাশের চেষ্টা, পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং পশ্চিমের ন্যায় পূর্বে শক্তিশালী পুঁজিবাদী বুর্জোয়া শ্রেণি সৃষ্টি হতে না দেয়াও বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকাশে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে (Karim, 1992)। এই বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার উপর ভর করেই বাংলাদেশের মানুষ ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তান নামক ধর্মের সুতায় বাঁধা অদ্ভুত রাষ্ট্র থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। এর ফলে বাঙালি জাতীয়তাবাদকেই বাংলাদেশের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা হলো। কিন্তু বাঙালি জাতীয়তাবাদ ছিল ভাষাগত ও জাতিগত জাতীয়তাবাদের মিশ্রণ যেখানে বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতিকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানি বৈষম্যের বিপরীতে, একে জি. ডব্লিউ. চৌধুরী ‘উপ-জাতীয়তাবাদ’ এবং মূলত ‘আঞ্চলিকতাবাদ’ হিসেবেও অভিহিত করেছেন (চৌধুরী, ১৯৯১)। এর ফলে স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলাভাষী ও জাতিগতভাবে বাঙালি মানুষ ছাড়া অন্যান্য মানুষ ও সম্প্রদায়গুলো এক ধরণের জাতীয়তাবাদী পরিচয়হীনতায় পড়ে যায়।

অন্যদিকে সিভিক জাতীয়তাবাদ হিসেবে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়, যেখানে স্বজাত্যবোধ, দেশকে ঐক্যবদ্ধ করার কতিপয় প্রতীকে জোরপ্রদানের মাধ্যমে রাষ্ট্রের সীমানার ভেতর সবাইকে বাংলাদেশি হিসেবে গ্রহণ করে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের চেতনা ধারণ করে কাজ করার কথা বলা হয় (Franda, 1981)। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের বাঙালিদের সাথে পশ্চিমবঙ্গের জীবনাচরণ, প্রচলিত প্রথা, ভাষাগত পার্থক্য, উৎসব ও উদযাপনের পার্থক্যগুলো নির্দেশ করে বাংলাদেশের মানুষের স্বকীয় ও মুসলিম সংস্কৃতির প্রতি আলোকপাত করা হয় (Franda, 1981)। তবে অনেকে মনে করেন জাতীয়তাবাদের এই ধারাটি এখন পর্যন্ত সুষ্ঠুভাবে সংজ্ঞায়িত নয় (Franda, 1981)। তবে রাষ্ট্রের ভেতর বিভিন্ন পক্ষের ‘বাঙালি’ ও ‘বাংলাদেশি’ জাতীয়তাবাদ নিয়ে বিতর্ক এখনো চলমান। যদিও পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি ও বাংলা ভাষাভাষীদের বাদ দিয়ে কীভাবে ও কোন বৈশিষ্ট্যের আলোকে বাংলাদেশে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা বর্তমান থাকবে তা নিয়েও কোন স্পষ্ট আলোচনা নেই।

 

২.

এক্ষেত্রে প্রশ্ন চলে আসে, আমরা তাহলে কোন জাতীয়তাবাদী চেতনাকে গ্রহণ করবো? ‘বাঙালি’ না ‘বাংলাদেশি’ জাতীয়তাবাদ? বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে গ্রহণ করতে হলে বাংলাভাষী ও জাতিগতভাবে যারা বাঙালি নয় কিন্তু বাংলাদেশের ভৌগলিক সীমার ভিতর বসবাস করছেন, তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনা লালন করলে সোজা বাংলায় তাদেরকে বাংলাভাষী বাঙালি বানাতে হবে, অথবা দেশ থেকে বিদায় করতে হবে। নিদেনপক্ষে তাদেরকে বাঙালি পরিচয় গ্রহণে বাধ্য করতে হবে।

এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের সময় দেশের নাগরিকদের বাঙালি হিসেবে চিহ্নিত করার বিধান বিষয়ক আলোচনার এক পর্যায়ে দেশে বিদ্যমান আদিবাসীদেরকে বাঙালি পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার আহ্বানও জানানো হয় যা খুব স্বাভাবিকভাবেই আদিবাসী প্রতিনিধিদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয় (আহমদ, ২০২০)। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গে অবস্থানরত বাংলাভাষী বাঙালিদের সাথে কোন্‌ কোন্‌ বৈশিষ্ট্যের কারণে বাংলাদেশের বাঙালিদের এই বাঙালি জাতীয়তাবাদ আলাদা হবে, তাও সংজ্ঞায়িত করতে হবে। তবে, শুধুমাত্র ধর্মীয় পার্থক্যকে বৈশিষ্ট্য ধরে নিলে তা গ্রহণযোগ্যতা হারাতে পারে, ঠিক আদিবাসীদের নিয়ে তৈরি সঙ্কটের মতোই।

পুনরায় যদি দেশের ভেতরে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা হয়, তাহলে সহজেই দেখা যাবে যে, বাঙালি ও বাংলাভাষী ছাড়া অন্য দলগুলোর ক্ষেত্রে এই জাতীয়তাবাদী চেতনার ফলে হীনমন্যতা থেকে সময়ের সাথে সাথে তাদের নিজস্ব জাতীয়তাবাদের উত্থান হতে পারে, যা নিঃসন্দেহেই ‘অ্যানার্কি’-র জন্ম দিবে। বর্তমান বাস্তবতায় সে ধরণের অ্যানার্কি কোনভাবেই মুক্তিপরায়ণ সমাজতন্ত্র থেকে উদ্ভূত হয়ে নৈরাজ্য তৈরি করা অ্যানার্কি নয়, বরং সরল অরাজকতা অর্থেই বেশি প্রযোজ্য হবে। আর এসব জাতিসত্তা যে নিজস্ব জাতীয়তাবাদী চেতনার উদ্ভব ঘটাতে পারে, উপমহাদেশ ও বাংলাদেশের ইতিহাসের আলোকেই তা বলা যায়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ভারতেও সংখ্যাগুরু হিন্দু ও সংখ্যালঘু মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণির দ্বন্দ্বে একটি সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদের স্থলে যথাক্রমে হিন্দু ও মুসলিম জাতীয়তাবাদের উদ্ভব হতে দেখা গিয়েছে (সাজ্জাদ, ২০১১)। ইংরেজ শাসনকে গ্রহণ করতে না পারায় উপমহাদেশের মুসলমানগণ ওয়াহাবি, ফরায়েজি আন্দোলন করেছে; অন্যদিকে ইংরেজ শাসন ও ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করে মুসলমানদের আগেই হিন্দু শ্রেণি জাতীয়তাবাদী চেতনা অর্জন করেছে। এর সাথে ধর্মীয় ভেদবুদ্ধি যোগ হয়ে যাওয়ায় জাতীয়তাবাদী চেতনাটি মূলত হিন্দু জাতীয়তাবাদে পরিণত হয়েছিল। অন্যদিকে মুসলমান মধ্যবিত্ত এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রতি-অবস্থান হিসেবে প্রতি-প্রতিষ্ঠান, প্রতি-পত্রিকা, প্রতি-ধর্মসংঘ, প্রতি-জাতীয়তাবাদ তৈরি করে (সাজ্জাদ, ২০১১)। এ প্রসঙ্গে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “পরাধীন বঙ্গে জাতীয়তাবাদীরা আন্তরিক ছিলেন। কিন্তু জাতীয় ছিলেন না, তাঁরা সাম্প্রদায়িক হয়ে পড়েছিলেন। তাঁদের কাছে জাতি হয়ে দাঁড়িয়েছিল এক অংশের জন্য হিন্দু জাতি, আরেক অংশের জন্য মুসলিম জাতি” (চৌধুরী, ১৯৯৩, পৃ-৩১)। আবার বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের গঠন নিয়ে আলোচনাতেও কোন সাধারণ ঘটনার চেয়ে কোন কোন বিশেষ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় এর প্রভাব বিস্তার অনেক বেশি সাধিত হয়েছে বলে উল্লেখ পাওয়া যায় (ওসমানী, ২০০৪)।

অর্থাৎ একই ভৌগলিক অঞ্চলে দুইটি আলাদা জাতীয়তাবাদী চেতনার জন্ম আমরা বহু আগেই প্রত্যক্ষ করেছি। প্রশ্ন আসতে পারে, বাংলাদেশে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় এই সমস্যা তো নাও হতে পারে, যেহেতু এখানে সিংহভাগ মানুষই বাংলাভাষী ও বাঙালি। বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে হায়াৎ মামুদ বলেন, “বাঙালি জাতীয়তাবাদের এই হল মূল উপাদান: এক-ভাষা, এক-জীবনধারাপদ্ধতি, হৃদয়জাত ধর্মবুদ্ধি এবং মানস-সংলগ্নতা…এই অন্তর্গত উপাদানাবলির শক্তিই তার জাতিসত্তা তাকে চিনিয়ে দিয়েছিল এবং ঐ জাতিসত্তার নিয়ামক চারিত্র্যগুনের সম্মিলনে গঠিত তার বাঙালি জাতীয়তাবাদ শিরোধার্য করে সে জাতির স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল” (মামুদ, ২০০০, পৃ-৪১)।

কিন্তু এই একই ভাষা, জীবনধারা পদ্ধতি ও মানস সংলগ্নতা কিন্তু আমরা আমাদের দেশে বসবাসরত আদিবাসী ও অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভ্রতর পাচ্ছি না। ফলে তারা স্বাভাবিকভাবেই বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় ‘ব্রাত্যজন’-এ পরিণত হয়। অন্যদিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা তাদেরকে যে শূন্যতায় ফেলে দেয়, বা তারা বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা গ্রহণ না করায় যে ‘ভ্যাকুয়াম’ সৃষ্টি হয় সেখান থেকেই তাদের নিজস্ব জাতীয়তাবাদী চেতনার উদ্ভব হওয়া স্বাভাবিক। আর এহেন প্রেক্ষাপটে অনেকেই বাংলাদেশের পরিসীমায় অবস্থান করা সবাই বাঙালি, এমন উপলব্ধিতেই জাতির বিকাশ ও অগ্রগতি সহজ হবে বলে মত দিয়েছেন। তবে তাঁরা অন্যান্য ‘জাতিসত্তার স্বীকৃতি’-র ক্ষেত্রেও গুরুত্বারোপ করেছেন (সাজ্জাদ, ২০১১)।

এক্ষেত্রে, সবার জন্য বাঙালি পরিচয় ধারণ করে অন্য জাতিসত্তাগুলোকে স্বীকৃতি দেয়া তাদেরকে ২য় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করার সমতুল্য কিনা, সেটি নিয়ে একটি প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাচ্ছে।

অন্যদিকে, বাংলাদেশের ভৌগলিক সীমার ভিতর বসবাসকারী সবাইকে নিয়ে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী চেতনার কথা বলা হয়। এ প্রসঙ্গে খোন্দকার আবদুল হামিদ বলেন,

এই জাতির রয়েছে গৌরবময় আত্মপরিচয়, নাম-নিশানা, ওয়ারিসী-উত্তরাধিকার, ঐতিহ্য-ইতিহাস, ঈমান-আমান, যবন-লিসান, শিল্প-সাহিত্য-স্থাপত্য, সংগীত সবকিছু। বাংলাদেশি জাতির আছে নিজস্ব জীবনবোধ, জীবনধারা, মনস্তাত্ত্বিক গড়ন-গঠন, ভাবধারা। আছে সমষ্টিগত বিশেষ মনোভংগী, আবেগ-আকাঙ্খা ও হৃদয়ানুভূতির বন্ধন। এদের হৃদয়তন্ত্রীতে বাজে একই সুখ-দুঃখের সুর, একই আবেগ-অনুভূতির ঝঙ্কার। এদের জীবনে ও মনোজগতে রয়েছে এমন অসংখ্য বৈশিষ্ট্য, যা সারা পৃথিবী থেকে এদের স্বাতন্ত্র্য দান করেছে- এমনকি অন্যান্য দেশের বা অঞ্চলের বাংলাভাষী ও ইসলাম-অনুসারীদের থেকেও। (উদ্ধৃতি সাজ্জাদ, ২০১১, পৃ-১১১)

এক্ষেত্রে, অনেকে এই বক্তব্যের দু’টি অসঙ্গতি তুলে ধরেছেন। প্রথমত, এখানে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির জাতিসত্তাগত অভিন্নতাকে অস্বীকার করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, এই জাতীয়তাবাদের মূলকথা হিসেবে বাংলা ভাষাভাষী ও মুসলমান, এই দুই পরিচয়ের কথা বলা হয়েছে। তাই এই জাতীয়তাবাদী তত্ত্বকে বর্ণবাদী ও সাম্প্রদায়িক হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন অনেকে (সাজ্জাদ, ২০১১)।

তাহলে প্রশ্ন আসে, সিভিক জাতীয়তাবাদ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী চেতনা কি আসলে ভাষাগত ও ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের মিশ্রণ?

 

৩.

১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গই পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের ভেতর বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের বীজ বপন করেছিল বলে অনেকে মত প্রকাশ করেন (Karim, 1992)। এদিকে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে শক্তিশালী সেক্যুলার ও ইসলামী ভাবধারার এক জটিল ও সংমিশ্রিত রূপ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়। পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে এই দুই বিপরীতমুখী চেতনা সংমিশ্রিত হয়ে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ধারণায় অবস্থান করছে (ওসমানী, ২০০৪)। এক্ষেত্রে বাংলাদেশি মুসলমানদের ইসলামী নববর্ষ পালনের পাশাপাশি বাংলা নববর্ষ পালনকে অনেকে এই সংমিশ্রিত চেতনার একটি উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু মজার বিষয় হলো, বাংলাদেশের মুসলমানদের কত শতাংশ বাংলা নববর্ষ ও ইসলামী নববর্ষ উভয়ই উদযাপন করেন, তার কোন তুলনামূলক চিত্র নেই। যদি ধরেও নেয়া হয় যে, যারা ইসলামী নববর্ষ পালন করেন তারা সকলেই বাংলা নববর্ষও পালন করেন, কিংবা যারা বাংলা নববর্ষ পালন করেন তারা সবাই ইসলামী নববর্ষও পালন করেন, এর ফলেই কি সেক্যুলার ও ইসলামী ভাবধারার মিশ্রণ প্রমাণিত হয়? এক্ষেত্রে বাংলাদেশের ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের বাইরে অন্য ধর্মে বিশ্বাসীদের অবস্থান তাহলে কোথায় হবে? নাকি এই জাতীয়তাবাদী চেতনায় ইসলাম ধর্মাবলম্বী ছাড়া বাকি সবাইকেই ২য় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে গণ্য করার প্রয়াস রয়ে গিয়েছে?

অন্যদিকে, অনেকে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে সেক্যুলার ও ইসলামী উপাদানকে এক করতে গিয়ে আরেকটি ভ্রান্তিময় বর্ণনা করেছেন। এক্ষেত্রে বলা হয়, বাংলা অঞ্চলে ইসলামের আগমণের মাধ্যমে এই অঞ্চলের মানুষের ভেতর পুরনো চিন্তা-চেতনা, সংস্কারের সাথে সাথে নতুন ধ্যান-ধারণা যুক্ত হয়ে নতুন এক বাঙালি চরিত্র সৃষ্টি করেছে। এর ফলে পূর্ব বাংলার মুসলিম সমাজে বাংলাভাষীদের সাথে অন্য ভাষাভাষী অভিজাতদের মেরুকরণ, এই মেরুকরণের ফলে বাংলা ভাষার মর্যাদার প্রশ্নে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী চেতনার নবতর সংহতি অর্জন এবং হিন্দু-প্রধান পশ্চিমবঙ্গ থেকে মুসলিম প্রধান পূর্ববাংলার পৃথক সত্তা অর্জিত হয় (ওসমানী, ২০০৪)।

এক্ষেত্রে যে ভ্রান্তিটি পরিলক্ষিত হয় তা হলো, অভিজাত উর্দুভাষী ‘আশরাফ’ শ্রেণির মুসলমানদের সাথে বাংলাভাষী ‘আতরাফ’ শ্রেণির মুসলমানদের মেরুকরণে যে জাতীয়তাবাদী চেতনাকে এখানে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ বলা হচ্ছে, সেটিই কিন্তু বাঙালি জাতীয়তাবাদের অন্যতম প্রধান ভিত্তি হিসেবে পরিগণিত হয়ে এসেছে। আবার, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে পশ্চিমবঙ্গ থেকে পূর্ব বাংলার মানুষের যে আলাদা ধর্মীয় সত্তা তৈরি হয়, সেটি কীভাবে ইসলামী ভাবাদর্শ ও সেক্যুলার চেতনার মিশ্রণে সৃষ্ট ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী চেতনা’ গঠনে কাজ করে তা বোধগম্য হওয়ার মতো পর্যাপ্ত ব্যাখ্যাও এখানে খুব একটা পাওয়া যায় না।

অন্যদিকে, ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের ফলে বাংলা অঞ্চল থেকেই প্রবল জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বিস্ফোরণ ঘটেছিল বলে মনে করেন আরেকদল তাত্ত্বিক। বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রধান ভিত্তি হিসেবে বাংলা ভাষাকে স্থাপনের প্রয়াসে বলা হয়, জাতীয়তাবাদের বস্তুগত ভিত্তির উপাদানসমূহ যেমন ভাষা, স্থান, ধর্ম ও অর্থনৈতিক জীবনের ঐক্যের ভেতর প্রধানতম হলো ভাষা। এক্ষেত্রে ধর্মান্তরিত হওয়ার চেয়ে ভাষান্তরিত হওয়া কঠিন এবং কোন জনগোষ্ঠীর ভাষা ঐ জনগোষ্ঠীর ধর্ম ও শ্রেণিগত বিভাজন অতিক্রম করে যেতে পারে বলে তাত্ত্বিকগণ মনে করেন (চৌধুরী, ২০১৫)।

এক্ষেত্রে এটি স্পষ্ট যে, এই তাত্ত্বিকগণ বাংলা ভাষাভাষীদের নিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছেন। বাসভূমির পরিচয়ে জাতীয়তাবাদ সংজ্ঞায়িত হলে প্রবাসীরা বাঙালি হিসেবে পরিচিতি পাবে না এই মর্মে ভৌগলিক এলাকার ভিত্তিতে জাতীয়তাবাদ, তথা সিভিক জাতীয়তাবাদকে বাতিল করেছেন তাঁরা। অন্যদিকে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রাচীন ভারতের ব্রাহ্মণ তথা আর্যদের শ্রেষ্ঠ জাতি মনে করাকে বর্ণবাদী ও বিপজ্জনক চেতনা হিসেবে আখ্যায়িত করে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদকেও তাঁরা বাদ দিয়েছেন। মীর মশাররফ হোসেনের হিন্দু-মুসলিম উভয় জাতিই প্রধান, তারা একে অপরকে ‘ভাই’ না বলে থাকতে পার না, এই বক্তব্যকে গ্রহণযোগ্য মনে করলেও পরবর্তী বিভাজন ধারায় এই ‘ভাই-ভাই’ মৈত্রী না থাকার জন্যই ভারত দুই ভাগ হয়েছিল বলে মত দিয়েছেন এই ধারার তাত্ত্বিক ও পণ্ডিতগণ (চৌধুরী, ২০১৫)।

এক্ষেত্রে সবচেয়ে যৌক্তিক ও কল্যাণকর হিসেবে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের কথা বলা হয়েছে। ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের মূল বক্তব্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে নূরন্নেছা খাতুন বিদ্যাবিনোদিনীর এই বক্তব্য,

পুরুষানুক্রমে যুগ যুগান্তর ধরে বাঙ্গালী দেশের গন্ডীর মধ্যে বাস করি, আর এই বাঙ্গালা ভাষাতেই সর্বক্ষণ মনের ভাব ব্যক্ত করেও যদি বাঙ্গালী না হয়ে আমরা অপর কোন একটি জাতি সেজে বেঁচে থাকতে চাই, তাহলে আমাদের তো আর কখনও উত্থান নাই-ই, অধিকন্তু চিরতমসাচ্ছন্ন গহ্বরে পতনই অবশ্যম্ভাবী। (উদ্ধৃতি চৌধুরী, ২০১৫, পৃ-৩৭)

এই প্রেক্ষিতে ভারতকে এক জাতির কিংবা হিন্দু-মুসলিম দুই জাতির দেশ নয়, বরং বহু ভাষাভাষী জাতির সমন্বয়ে এক বহুজাতিক দেশ আখ্যায়িত করা হয়েছে। একইসাথে ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে দুই দেশ নয়, বরং ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনই কার্যকর সমাধান ছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পাকিস্তান ও ভারতের আভ্যন্তরীণ জাতিগত বিচ্ছিন্নতা আন্দোলনসমূহকেও ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্রসমূহ গঠন না করার ফলাফল হিসেবে ব্যক্ত করা হয় (চৌধুরী, ২০১৫)।

এখন যদি শুধুমাত্র বাংলা ভাষাভাষী মানুষদের নিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে গ্রহণ করা হয়, তাহলে কি এই জাতীয়তাবাদী চেতনা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অন্য ভাষাভাষীদের বাদ দিয়ে বাংলা ভাষাভাষীদের ‘ভাষিক-বর্ণবাদ’-এ দুষ্ট নয়?

 

৪.

এসব আলোচনা থেকে এই বিষয়টি স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী চেতনা কী হবে তা নির্ধারণ করার আগে কতিপয় প্রশ্নের উত্তরের ক্ষেত্রে ঐকমত্যে পৌঁছানো জরুরি। প্রথমত, প্রচলিত অর্থে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলা হয়, সেটিকে গ্রহণ করলে বাংলাদেশে অবস্থানরত বাংলা ভিন্ন অন্য ভাষাভাষীদেরকে কীভাবে মূল্যায়ন করা হবে? বাংলা ভাষাভিত্তিক ও বাঙালি জাতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনার জাতিরাষ্ট্রে তাদের অবস্থান কোথায় হবে? এই প্রশ্নের উত্তরে যদি আমরা তাদেরকে রাষ্ট্রের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করি, তাহলে আমাদেরকে এর প্রতিক্রিয়ার জন্যও প্রস্তুত থাকতে হবে। এর একটি ফলাফল হতে পারে বাংলাদেশ একটি ‘ফাটলরেখার রাষ্ট্র’ (Fault Line State)-তে পরিণত হতে পারে। স্যামুয়েল পি. হান্টিংটন বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোকে চারভাগে ভাগ করেছেন, যার একটি হলো ফাটলরেখার রাষ্ট্র। এগুলো হলো এমন রাষ্ট্র, যেগুলো আপাত ঐক্যবদ্ধ থাকলেও, এতে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান, যার ফলে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে যে কোন সময় সংঘাত শুরু হতে পারে (হান্টিংটন, ২০১০)। দ্বিতীয়ত, পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষী বাঙালিদের বাদ দিয়ে কীভাবে এই ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’-কে সংজ্ঞায়িত করা হবে? তৃতীয়ত, পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের কোন্‌ কোন্‌ বৈশিষ্ট্যগত ভিন্নতার কারণে বাংলাদেশের বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা থেকে পৃথক করা হবে? এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পর থেকেই বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের একত্রীকরণ প্রশ্নে উভয় রাষ্ট্রের এক ধরনের ‘মিউচুয়াল’ নেতিবাচক মনোভাব ছিল (Franda, 1981)।

অন্যদিকে, প্রচলিত অর্থে যে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের কথা বলা হয়, সেটি গ্রহণ করলে বাংলাদেশে অবস্থানরত ইসলাম ধর্মাবলম্বী ছাড়া অন্য ধর্মানুসারীদের অবস্থান জাতিরাষ্ট্রের কোথায় হবে? এক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে যে, অন্য ধর্মাবলম্বীদের রাষ্ট্রের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করার ফলাফল হিসেবে অন্য রাষ্ট্রের মুসলিমদের পরিণতির বিষয়েও খেয়াল রাখা এক্ষেত্রে জরুরি হয়ে পড়ে, কারণ এখানে জাতীয়তাবাদ নির্ধারণে আমরা ধর্মকে প্রাধান্য দিচ্ছি। এক্ষেত্রে পাকিস্তানের ভাঙনের পূর্বে পাকিস্তানের হিন্দুদের প্রতি আচরণের প্রভাবক হিসেবে ডেবিড মেক্কাচ্চন দুইটি শর্তের কথা বলেছিলেন; একটি হলো এই ইস্যুতে পাকিস্তানের সরকারি নীতি এবং অপরটি হলো ভারতের সাম্প্রদায়িকতা (মেক্কাচ্চন, ২০১৩)। আশা করছি ইঙ্গিতটি পরিস্কার। দ্বিতীয়ত, সেক্যুলার ও ইসলামি ভাবধারার একটি মিশ্রণ আদৌ সম্ভব কিনা? যদি সম্ভব হয়, তাহলে কীভাবে সম্ভব? যদি না হয়, তাহলে কোনটিকে বাদ দেয়া হবে, এবং কেন? তবে উভয় ধরণের জাতীয়তাবাদই যেহেতু দেশে অবস্থানরত কোন না কোন পক্ষকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করার সম্ভাবনা রাখে, তাই এ ধরনের জাতীয়তাবাদী পরিচয়ের নির্মিতি বাতিলকৃত পক্ষ বা পক্ষসমূহকে সন্ত্রাসবাদের দিকেও ঠেলে দিতে পারে। কারণ বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে উদ্ভূত সন্ত্রাসবাদের পেছনের কারণগুলোর অন্যতম হলো রাগ-ক্রোধ, অসহায় ও একাকীত্বের বোধ, বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হওয়ার অনুভূতি কিংবা সন্ত্রাসী কার্যক্রমের মাধ্যমে নিজেদের উপস্থিতি জানান দেয়ার চেষ্টা (Ahmad, 2001)।

এসব প্রশ্নের বিপরীতে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক থেকে কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। সেটি হলো, প্রচলিত অর্থে যে বাঙালি ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের কথা বলা হয়, বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী চেতনা হিসেবে এর কোন একটিকে গ্রহণ না করে সম্পূর্ণ নতুনভাবে বিদ্যমান প্রশ্নগুলোর উত্তর নির্দিষ্টকরণের মাধ্যমে চেতনাটিকে নির্ধারণ করা যায় কি?

আবার, আমরা চাইলে এর চেয়েও অধিকতর বিস্ফোরক একটি প্রশ্নের সামনে দাঁড়াতে পারি। প্রশ্নটি হলো, মানবিক আন্তর্জাতিকতাবাদকে সামনে রেখে বর্তমানে আমাদের কি আদৌ কোন জাতীয়তাবাদ বা জাতীয়তাবাদী চর্চার প্রয়োজন রয়েছে? কারণ আমাদের চোখের সামনে রয়েছে কাশ্মীর বনাম ভারত/পাকিস্তান/চীন আর ফিলিস্তিন বনাম ইজরায়েলের উদাহরণ। আমরা ভুলে যাইনি কীভাবে জাতীয়তাবাদের নামে আফজাল গুরুর জীবনের সমাপ্তি হয়েছিল দিল্লীর তিহার জেলের ফাঁসিকাষ্ঠে। আমাদের জনপ্রিয় উদারতাবাদী ডিসকোর্সে আমরা যতই কাশ্মীর বা ফিলিস্তিনের মুক্তির কথা বলি না কেন, এই সমাধানের পেছনে লুকিয়ে থাকা সংকটগুলোর কথা ভুলে গিয়ে জাতীয়তাবাদ নিয়ে উত্থাপিত শেষ প্রশ্নের উত্তর দিলে তা সঠিক নাও হতে পারে।

এক্ষেত্রে মনে রাখা প্রয়োজন, নিজেদের আজাদির জন্য দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করা কাশ্মীরের পাকিস্তান অধ্যুষিত অংশ নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে গিলগিট বালতিস্তানকে, এই অঞ্চলটিও কাশ্মীরের মতোই স্বশাসন চাইলেও আজাদ কাশ্মীর মনে করে এই অঞ্চল তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকাই শ্রেয় (পারভেজ, ২০১৯)। আবার শ্রীলঙ্কার সিংহলিদের বিপক্ষে তামিল জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ফলে সেদেশে কম রক্তপাত হয় নি। কিন্তু তামিল হিন্দুদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের কারণে তামিল মুসলমানদের ভীত হয়ে পড়াও তো আরেকটি বাস্তবতাই (পারভেজ, ২০১৭)। অন্যদিকে, জাতীয়তাবাদের বাতাবরণে রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতার বয়ানের পেছনে ইস্ট তুর্কিস্তান আন্দোলনকে দমিয়ে রাখাও কি অমানবিক নয়? যেখানে এই আন্দোলনের মাধ্যমে চীনের জিংজিয়াং অঞ্চলের উইঘুর সম্প্রদায়ের মানুষ নিজেদের স্বাধীনতা দাবি করে আসছে, আর চীন তাদের হান সম্প্রদায়ের বাফার জোন হিসেবে সমাজতন্ত্র কায়েমের আগে-পরে অঞ্চলটিকে এক ধরনের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে (Marshall, 2015)। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির ফলে পার্বত্য এলাকাগুলো প্রথমে জুম্মল্যান্ড এবং পরে চাকমাল্যান্ডে পরিণত হবে (রহমান, ২০১৮), অনেকের দ্বারা কথিত অতীতের এই আশঙ্কাগুলো আসলে কোন্‌ দিকে নির্দেশ করে?

এগুলো হাতে গোনা কয়েকটি উদাহরণ মাত্র। তাই বলতেই হয়, জাতীয়তাবাদের ফলে মানব সম্প্রদায়ের ভেতর বিভেদ, বিবাদ ও বিদ্বেষের আগুন জ্বলে উঠেছে অহরহই (Grosby, 2005)। আবার, এই যে বিশেষ কৌম বা সংস্কৃতি বা অন্য কোন বিশেষ বৈশিষ্ট্যের আলোকে আমাদের জাতিসত্তার ধারণা, আর সেই ধারণা থেকে বিশেষ বিশেষ জাতীয়িতাবাদী চিন্তার উদ্ভব, সেটিও কি অনেকটাই ত্রুটিপূর্ণ নয়? যেখানে আমরা একইসাথে অনেক বিষয়ে পরিচিত হই সবসময়? যেমন একজন মুসলমান মধ্যবিত্ত পেটিবুর্জোয়া কিন্তু মুক্তমনা প্রগতিশীল বাংলাভাষী ব্যক্তির জাতীয়তাবাদী চেতনা আসলে কী হওয়া উচিত? এসব কারণেই বিশেষ এক বা একাধিক বৈশিষ্ট্যের আলোকে জাতি ও জাতীয়তাবাদে বিভক্ত হয়ে যাওয়ার বিষয়টিকে অনেকে নিজ দৃষ্টিভঙ্গি ‘সীমিত’ করা এক ভাবনার তো বটেই, একই সাথে সাথে নিজ দৃষ্টিভঙ্গি ‘সীমাবদ্ধকারী’-ও মনে করেন; এই ধরণের চিন্তাগুলোকে আমাদের ‘উপরে চাপানো ক্ষুদ্রতা’-ও বলা হয়েছে কোন কোন আলোচনায় (সেন, ২০১৭)। তাই শেষ প্রশ্নটির উত্তর দেয়ার আগে এসব বাস্তবতা আমাদের ধর্তব্যে নেয়া সমীচীন হবে বলে মনে হয়। একই সাথে মনে রাখা দরকার যে, অ্যানার্কিস্ট রুডলফ রকার যে কোন জাতীয়তাবাদকেই আদতে প্রতিক্রিয়াশীল এবং এক ধরনের রোমান্টিকতা হিসেবে উল্লেখ করেছেন বহুদিন আগেই (রকি, ২০২০) ।

গত ৫১ বছরে বাংলাদেশের নিজস্ব কোন একক জাতীয়তাবাদী চেতনা বা ভাবধারা গড়ে উঠে নি। ফলে জাতীয়তাবাদ ইস্যুটি যে কোন সময় অগ্নিরূপে সব পুড়িয়ে দিতে পারে। সেক্ষেত্রে ভারত বিভাগের ফলাফল হিসেবে ভারত ও পাকিস্তান এখনও যেসব বিচ্ছিন্নতা আন্দোলনের মুখোমুখি হচ্ছে, বাংলাদেশও তার স্বীকার হতে পারে। সেটি হতে পারে কোন ধর্মাবলম্বী বা প্রধানতম ধর্মের বিশেষ কোন অংশের দ্বারা; হতে পারে বাঙালি জাতিসত্তার বাইরের কোন জাতিসত্তার সদস্যদের দ্বারা। এর বিপরীতে বিদ্যমান প্রশ্নগুলোর উত্তর নির্ধারণের মাধ্যমে নিজস্ব জাতীয়তাবাদী চেতনা নির্মাণের ফলে জাতীয়তাবাদী চেতনার অগ্নিনির্বাপক জলের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। জাতীয়তাবাদ প্রশ্নে আমরা অগ্নি বা জল কোনটিকে গ্রহণ করবো, সেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমাদেরকে, যতটা দ্রুত সম্ভব।

 

তথ্যসূত্র:

আহমদ, মহিউদ্দিন। (২০২০)। বেলা-অবেলা: বাংলাদেশ ১৯৭২-১৯৭৫। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাতিঘর।

ওসমানী, শিরীন হাসান। (২০০৪)। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলা একাডেমী।

চৌধুরী, জি. ডব্লিউ.। (১৯৯১)। অখণ্ড পাকিস্তানের শেষ দিনগুলি (সিদ্দীক সালাম অনূদিত)। ঢাকা, বাংলাদেশ: হক কথা প্রকাশনী।

চৌধুরী, সিরাজুল ইসলাম। (১৯৯৩)। দ্বি-জাতি তত্ত্বের সত্য-মিথ্যা। ঢাকা, বাংলাদেশ: বিদ্যাপ্রকাশ।

চৌধুরী, সিরাজুল ইসলাম। (২০১৫)। জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও জনগণের মুক্তি ১৯০৫-৪৭। ঢাকা, বাংলাদেশ: সংহতি।

পারভেজ, আলতাফ। (২০১৭)। শ্রী লঙ্কার তামিল ইলম্‌: দক্ষিণ এশিয়ায় ‘জাতি-রাষ্ট্র’-এর সংকট। ঢাকা, বাংলাদেশ: ঐতিহ্য।

পারভেজ, আলতাফ। (২০১৯)। কাশ্মীর ও আজাদির লড়াই। ঢাকা, বাংলাদেশ: ঐতিহ্য।

প্রজন্ম৮৬। (২০১৩, জুন ২৪)। জাতীয়তাবাদ কি? কোন জাতীয়তাবাদ গ্রহণ করবো? [ব্লগ পোস্ট]। সূত্র http://www.somewhereinblog.net/blog/generation86/29845815

মামুদ, হায়াৎ। (২০০০)। সুস্থিরতার খোঁজে। ঢাকা, বাংলাদেশ: আফসার ব্রাদার্স।

মেক্কাচ্চন, ডেবিড। (২০১৩)। পূর্ব পাকিস্তানের অন্তরে (সলিমুল্লাহ খান অনূদিত)। সূত্র সলিমুল্লাহ খান, স্বাধীনতা ব্যবসায় (পৃ. ৪০৮-৪২২)। ঢাকা, বাংলাদেশ: আগামী।

রকি, রোকন। (২০২০)। দেশাত্ববাদ: রাষ্ট্র-কর্তৃত্বের মতাদর্শিক দ্বেষপ্রেম। ঢাকা, বাংলাদেশ: দ্যু।

রহমান, জিবলু। (২০১৮)। পার্বত্য চট্টগ্রাম: সমস্যা ও সমাধান (১৯৭২-১৯৯৮)। সলেট, বাংলাদেশ: শ্রীহট্ট প্রকাশ।

লেভি, বের্নার অরি। (২০১৭)। অবিকশিত জাতীয়তাবাদ ও অঙ্কুরে বিনষ্ট বিপ্লবের পটভূমিতে বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হচ্ছিল (শিশির ভট্টাচার্য্য অনূদিত)। ঢাকা, বাংলাদেশ: আদর্শ।

সাজ্জাদ, সুমন। (২০১১)। প্রকৃতি, প্রান্তিকতা ও জাতিসত্তার সাহিত্য। ঢাকা, বাংলাদেশ: আবহমান।

সেন, অমর্ত্য। (২০১৭)। আমাদের উপরে চাপানো ক্ষুদ্রতা। সূত্র অমর্ত্য সেন, ফার্স্ট বয়দের দেশ এবং অন্যান্য প্রবন্ধ (পৃ. ৪৩-৬২)। কলকাতা, ভারত: আনন্দ।

হান্টিংটন, স্যামুয়েল পি.। (২০১০)। দ্য ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশনস্‌ অ্যান্ড দ্য রিমেকিং অব ওয়ার্ল্ড অর্ডার (ড. মোহাম্মদ আবদুর রশীদ অনূদিত)। ঢাকা, বাংলাদেশ: অনিন্দ্য।

Ahmad, E. (2001). Terrorism theirs and ours. New York, NY: Seven Stories Press.

Franda, M. (1981). Ziaur Rahman and Bangladeshi Nationalism. Economic and Political Weekly, 16 (10/12), 357-359+361+363+365+367-369+371+373+375+377+379-380. Retrieved from https://www.jstor.org/stable/pdf/4369609.pdf

Grosby, S. (2005). Nationalism: A very short introduction. Oxford, NY: Oxford University Press.

Karim, N. (1992). The emergence of nationalism in Bangladesh. Dhaka, Bangladesh: University of Dhaka.

Marshall, Tim. (2015). Prisoners of geography: Ten maps that tell you everything you need to know about global politics. London, England: Elliott & Thompson.

Naqvi, A. N. (1985). Islam nad nationalism (Trans. Dr. Alaedin Pazargadi). Tehran, Iran: Islamic Propagation Organization.

Nationalism. (2016). Retrieved December 30, 2016, from Wikipedia: https://en.wikipedia.org/wiki/Nationalism

 

(রচনাকাল: জানুয়ারি, ২০১৭-সেপ্টেম্বর, ২০২২)

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।