শিবলী নোমান

সমকালীন বিজ্ঞাপনে আমাদের নারী

শিবলী নোমান

করপোরেট পুঁজি আর বিনিয়োগের যুগে নিজ পণ্যের সর্বাধিক প্রচারের অন্যতম হাতিয়ার হল বিজ্ঞাপন। মোট বিনিয়োগের উপর যত বেশি বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে বা নতুন পণ্য বাজারজাতকরনের আগে যতটা সম্ভব বিজ্ঞাপন করে নেয়া যাবে তার উপরই অনেকাংশে নির্ভর করবে ঐ পণ্যের বাজার কাটতির পরিমাণ বা পরিমাপ। তাই বিজ্ঞাপন এখন শুধু প্রচারণা নয়, প্রতিযোগিতার যুগে বিজ্ঞাপন হল শিল্প। আর বিজ্ঞাপন শিল্পকে চালিয়ে নিতেই তাই হাজার হাজার অ্যাড ফার্ম গজিয়ে উঠেছে আজ চারিদিকে। সবখানে আজ তাই বিজ্ঞাপনের জয়-জয়কার। পায়ের লোম পরিষ্কার থেকে চুল পড়া বন্ধ কিংবা রিক্সার স্পোক থেকে মার্সেডিজের মোবিল, সব ব্যবসায় আজ বিজ্ঞাপন অপরিহার্য। বিজ্ঞাপন না হলে হবে না প্রচারনা আর প্রচারনা ছাড়া বাজারে পণ্য ছাড়াই বৃথা; সে পণ্যের কথা কেউ জানবে না তাই কিনবে না তাই হবে না ব্যবসা। বিজ্ঞাপন তাই শুধু শিল্প নয়, বিজ্ঞাপন হল বার্তা। বার্তা হিসেবে বিজ্ঞাপনের ভূমিকা নিয়েই আজকের কথা।

অন্যদিকে নারী হল সমাজের সেই অংশ যার আর পুরুষের মিলিত পরিশ্রমে সমাজ আজকের রূপধারন করেছে। যদিও কারো মতে নারী হল ‘সেকেন্ড সেক্স’ আবার কারো মতে ‘অর্ধেক কল্পনা’ আবার কারো মতে শুধুই ‘সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র’। আবার নারীর পক্ষে যে কেউ বলেন নি এমনও তো নয়, বলাই হয়েছে যা কিছু কল্যানকর তার অর্ধের করেছে নারী আর অর্ধেক পুরুষ। কিন্তু সবকিছুর পরও নারীর উপর বিদ্বেষটা কেন যেন আমাদের একটু বেশিই। তাই নারীকে আমরা পিঁছিয়ে রাখতে চাই, নারীকে রাখতে চাই ঘরে বা বাইরে ঘেরাটোপ বা পর্দার ভিতর। নারীকে প্রতিনিয়ত এই বার্তাই দিয়ে যাই, তুমি নারী, তোমার স্থান নীচে। তোমার স্থান নির্দিষ্ট, যতই চেষ্টা কর তুমি পারবে না পুরুষের মত হতে। তুমি দুর্বল, তুমি ঘৃণীত।

কনজিউমারিজমের যুগে বিজ্ঞাপনও পারেনি নারীকে তার মর্যাদা দিতে। বরং এক ধরনের ছাঁচিকৃত ধারণা ছড়িয়ে যায় নারীর বিষয়ে। নারীকে একদম চিরাচরিত একটি রূপদান যেন সম্পন্ন হয়েছে কোথাও, যে রূপের বাইরে নারী যেতে পারবে না। আমাদের সাম্প্রতিক বিজ্ঞাপন নারী বা পুরুষ বা জেন্ডার সংবেদশীলতার প্রতি কী বার্তা প্রদান করে? নারীর প্রতি কি আমাদের বিজ্ঞাপন কিছুটা হলেও সংবেদনশীল? নাকি আর সবার মত বিজ্ঞাপনও নারীকে আর তার শরীর আর তার মনকে নিয়ে খেলছে নারীর অজান্তেই?

ঘরের কাজই যেখানে নারীর কাজ!

হালের জনপ্রিয় তারকা মিথিলার (রাফিয়াথ রশিদ মিথিলা) করা একটি গুঁড়ো দুধের বিজ্ঞাপনের শুরুটাই হয় এমনভাবে যে মিথিলা তার পরিবার নিয়ে থাকে, যেখানে স্বামী-সন্তানের সাথে তার শাশুড়ীও আছে। বিজ্ঞাপনের শুরুতেই দেখানো হয় মিথিলার স্বামী বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় বই পড়ছে আর মিথিলা শাড়ি পরিহিত অবস্থায় এক গ্লাস পানি এনে স্বামীর পাশের টেবিলে রাখছে। এই কাজটি করার মূহুর্তেই তার শাশুড়ী তার কাছে একটু চিৎকার করেই বললেন, “বৌমা, আমার ওষুধটা!” আর মিথিলার নম্র জবাব, “দিচ্ছি মা!”

বিজ্ঞাপনের এই অংশের পর সেটি তার মূল বিজ্ঞাপনে প্রবেশ করে। কিন্তু শুরুর এই অংশটুকু আমাদের কী বার্তা দিয়ে যায়? বার্তাটি কি এমন নয় যে রাতে যখন পরিবারের সবার বিশ্রাম বা অবসর কাটানোর সময় তখনও আমাদের ঘরের নারীদের কাজ করতে হয় বা হচ্ছে বা হবে? নাকি বার্তাটি এমন যে আমাদের ঘরে ছেলের স্ত্রীদের দিয়ে সব কাজ করানোটাই নিয়মের অপর নাম হয়ে গিয়েছে? অর্থাৎ যেখানে আর যত কাজই নারী করুক না কেন দিনভর বা দিনশেষে বাড়িতে এসে ঘরের কাজ যেমন স্বামীকে পানি খাওয়ানো বা শাশুড়ীকে ওষুধ খাওয়ানোটা নারীর বাধ্যতামূলক কাজ। অত্যন্ত সনাতন একটি চিন্তাধারা নিয়ে এখনো আমাদের বিজ্ঞাপন শিল্প চলছে তা বলতেই হচ্ছে এই চিত্রের পর।

নারীর পোশাক যখন বুদ্ধির মাপকাঠি!

মিথিলার ঐ একই বিজ্ঞাপনের পরের অংশে তাদের বাড়িতে ডাকাতদল হামলা করে সব টাকা-পয়সা দিয়ে দিতে বলে। অন্যদিকে মিথিলা নাছোড়বান্দার মত ডাকাতদলকে অতথি বলে তাদেরকে মিষ্টি জাতীয় খাবার খাওয়াতে চায়। বারবার বলতে থাকে একটু হলেও মিষ্টি খেয়ে তারপর যেতে। মিথিলার শাশুড়ীও ব্যর্থ হয় মিথিলাকে বুঝাতে। পুরো বিজ্ঞাপনটিকে হাস্যরসাত্মক করতেই হয়ত এমন চিত্রকল্প তৈরি করা হয়েছে কিন্তু পুরো বিষয়টিতে মিথিলাকে অত্যন্ত বোকা একজন নারী হিসেবে উপস্থাপনের জন্যে তা যথেষ্ট। মিথিলার কথা বলার স্টাইল আর কথার বিষয়বস্তু সবকিছুতেই তাকে বোকা, অতি সরল-সাধারন, স্বামী ও ঘরসোহাগী বৌমা উপস্থাপনের একটা তোড়জোড় দেখা যায় সর্বত্র।

এখানে খেয়াল করার মত আরেকটি বিষয় হল মিথিলার পরনে থাকে শাড়ি। বাংলাদেশের বিজ্ঞাপনের বর্তমান ট্রেন্ডে শাড়ির আরেকটি ব্যবহার চোখে পড়ার মত। বাংলাদেশে বহুল প্রচলিত বিজ্ঞাপন হল হরলিক্স খেয়ে লম্বা, শক্তিশালী ও বুদ্ধিমান হওয়ার বিজ্ঞাপন। সাম্প্রতিক হরলিক্সের এক বিজ্ঞাপনে দেখা যায় দুই মা তাদের দুই ছেলেকে নিয়ে কোন এক সুপার শপে গিয়েছে। একজন হরলিক্স কিনলেন একজন কিনলেন না। এখানে মজার বিষয় হল যিনি হরলিক্স কিনলেন না তার পরনে থাকে শাড়ি আর যিনি কিনে নিলেন তার পরনে থাকে সালোয়ার কামিজ। আরো মজার বিষয় হল যখন ডাক্তারের(!) পরামর্শে অপর মা নিজের ছেলেকও হরলিক্স খাওয়ানো শুরু করেন তখন তার পরনে থাকে সালোয়ার কামিজ। অর্থাৎ সন্তানকে হরলিক্স খাওয়ানোর বুদ্ধি সৃষ্টির সাথে সাথে তিনি নিজেও একটু ‘স্মার্টার’ হয়ে গেলেন কি? বার্তাটি কি এমন যে শাড়ির চেয়ে সালোয়ার কামিজ মডার্ন বলে বোকা নারীগন শাড়ি পরেন আর বুদ্ধিমান হরলিক্স খাওয়া বা খাওয়ানো নারীগন পরবেন সালোয়ার কামিজ! অর্থাৎ দুইটি বিজ্ঞাপনেই শাড়ি পরিহিত নারীদের ভূমিকা দেখানো হল একটু পিঁছিয়ে পড়া। যদিও মিথিলার শাশুড়ীও শাড়িই পরেছিলেন, তবে তার চরিত্রটি ছিল একদমই ছাঁচিকৃত। এক্ষত্রে আরেকটি মজার ঘটনা দেখা যায়, মিথিলা যে গুঁড়ো দুধের বিজ্ঞাপনে শাড়ি পরেছিলেন সেই একই পণ্যের আরেকটি বিজ্ঞাপন করা হয় সিক্যুয়াল হিসেবে। সেখানে পুরনো যুগের ডাকাতের স্থলে বাড়িতে হামলা করে ডন ও তার দল। যেহেতু ডন হামলা করেছে সে অনুযায়ী ডনের পোষাক থাকে আধুনিক, এবার মিথিলার স্থলে যে মডেলকে দেখা যায় সেও কিন্তু সালোয়ার কামিজ পরা চটপটে বুদ্ধিদীপ্ত এক নারী। ডাকাতের প্রকৃতি পরিবর্তনের সাথে সাথে নারীর চরিত্রও কিন্তু বদলে গেলো!

হরলিক্স বা এমন সব মল্টেড ড্রিংকের বিজ্ঞাপনের আরেকটি দিক হল তারা সব সময় মায়েদেরকে বুঝাতে চায় সন্তানকে এসব খাওয়াতে কিন্তু বিজ্ঞাপনে সন্তানের চিত্রায়নে সবসময় ছেলে সন্তান দেখায়। কেন তারা মনে করেন যে এসব মেয়ে সন্তানদের খেতে বলা দেখানো যাবে না নাকি তারা মনে করেন যে মেয়েদের টলার, স্ট্রঙ্গার বা শার্পার হওয়ার প্রয়োজন নেই তা নিয়ে আলাদা কথা হতেই পারে।

রান্নাঘর = নারীর ঘর আর সেখানে নারীর সৌন্দর্য

এবার চলে যাই সাবানের বিজ্ঞাপনে। একটি বিজ্ঞাপনে দেখানো হয় রোযার মাসে ইফতারের আগ মূহুর্তে একজন মা ইফতার তৈরি করছেন আর তার সন্তান এসে জানতে চাইছে এখন ইফতারের সময় কিনা। একটু পর সন্তানের বাবা বাসায় ফিরে আসে এবং পোষাক দেখে মনে হয় তিনি একজন ডাক্তার এবং কর্মস্থল থেকে ফিরে আসলেন। আর এসে তিনি সন্তানকে এও বললেন যে আর পাঁচ মিনিট পর ইফতার করা যাবে। বিজ্ঞাপনের অংশটি আমাদের কী বার্তা দিল? প্রথমত, নারীকে এখনো অর্থাৎ ২০১৫ সালের বিজ্ঞাপনেও আমরা দেখাচ্ছি রান্না ঘরে কাজ করতে, অন্যদিকে ইফতারের পাঁচ মিনিট আগে কর্মস্থল থেকে ফিরছেন তার স্বামী। কিন্তু একই পরিস্থিতি কেন নারীর হতে পারে না? নারী কি তার কর্মস্থল থেকে কখনো ইফতারের পাঁচ মিনিট আগে ঘরে ফিরে আসেন না আমাদের সমাজে? তাহলে আমাদের বিজ্ঞাপনে কেন এখনো নারীদেরকে সেই রান্নাঘরেই দেখাতে হবে! নাকি বার্তাটি এমন যে, হ্যা, নারী অবশ্যই বাইরে কাজ করবে কিন্তু সঠিক সময়ে ঘরে ফিরে সবার জন্যে ইফতারও তৈরি করবে? এই প্রশ্নটিই আসলে বৃথা কারন এর আগে আমরা এমন বিজ্ঞাপনও দেখেছি যেখানে নারী সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরেই রান্নাঘরে চলে যান রান্না করতে এবং একটি সয়াবিন তেল ব্যবহারে তার রান্না অনেক গুন ভালো হয়ে যায় এবং তিনি স্বামীর মন জয় করেন। আবার সম্প্রতি একটি টাইলসের বিজ্ঞাপনে একজন পুরুষ, একটি শিশু ও একজন নারীকে দেখানো হয় যেখানে তারা সবাই অবাক হয়ে টাইলসের দিকে তাকিয়ে থাকে। শিশু বা পুরুষের ক্ষেত্রে আলাদা কিছু দেখানো না হলেও নারীর ক্ষেত্রে দেখানো হয় যে নারীটি রান্নাঘরে বরবটি কাটছেন এবং টাইলসের সৌন্দর্যে তিনি বরবটি কাটতে গিয়ে আঙুল কেটে ফেলেছেন কিন্তু সেদিকে তার তেমন কোন চিন্তা নেই। কথা হল পুরুষ বা শিশু যদি যে কোন স্থানে থেকে টাইলস দেখে মুগ্ধ হতে পারে তাহলে নারীর কেন রান্নাঘরে কাজ করার সময় টাইলস দেখে মুগ্ধ হওয়ার দৃশ্য দেখাতে হবে? নারী কি আর কোথাও থাকতে পারে না?

আর এই টাইলসের বিজ্ঞাপন বা সাবানের বিজ্ঞাপনে যে নারীদের রান্নাঘরে দেখানো হয় সেখানে তাদের যে পরিমাণ মেক-আপ ও যে জামা-কাপড়ে দেখানো হয় তাও যে বাস্তবতাবর্জিত তা বুঝতে বেশি খেয়াল করা লাগে না। কিন্তু তারপরও এমন দেখানো হচ্ছে। যেন নারী রান্নাঘরেই থাকবে কিন্তু সর্বদা সুন্দর থাকবে। সুন্দর দেখা না গেলে নারীর চাহিদা কমে যাবে, ঘরে, বাইরে, বিজ্ঞাপনেও!

 সাম্প্রতিক বিজ্ঞাপনে এই হল আমাদের নারীসমাজের চিত্রায়ন। এখানে মাত্র তিন-চারটি বিজ্ঞাপনের কিছু অংশের প্রতি আলোকপাত করা হল যেগুলো খুব সহজেই চোখে পড়ে। কিন্তু আরো অনেক সূক্ষ্ম বিষয়াদি থেকে যায় যেখানে নারীকে, নারীসমাজকে প্রতিনিয়ত বৈষম্য করা হচ্ছে, ছাঁচিকরনের মাধ্যমে নারীর সনাতন প্রতিচ্ছবি আমাদেরকে অর্থাৎ সাধারন দর্শকদের দেখানো হচ্ছে আর তার সাথে সাথে মাথায় গেঁথে দেয়া হচ্ছে। এসব বিজ্ঞাপন নারীর প্রতি কোনভাবেই সংবেদনশীল আচরণ করতে পারছে না বা করতে দেয়া হচ্ছে না। বিজ্ঞাপনের সাথে যুক্ত নারীদের ভিতরেও এই পুরুষতান্ত্রিক বা নারীর প্রতি অবমাননাকর মনোভাবটি তৈরি হয়ে গিয়েছে তাদের অজান্তেই, এজন্যেই তারা নিজেরাও বুঝতে পারছনে না তারা কী করছেন প্রতিনিয়ত!

বিজ্ঞাপনে জেন্ডার সংবেদনশীলতা আসবে, এই প্রত্যাশায় থাকলাম…

(রচনা: ০৪ জুলাই, ২০১৫; পরিবর্ধন: ২২ মার্চ, ২০১৬)

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।