শিবলী নোমান

ধর্ষণ, কিংবা পুরুষতান্ত্রিকতা

শিবলী নোমান

সোহাগী তনুর ধর্ষণ ও হত্যা নিয়ে কিছু লেখার ইচ্ছা ছিল না। সঙ্গত কারণেই ছিল না। এক বন্ধু লিখতে বলায় কিছু লেখার চেষ্টা করছি। কিন্তু তনুকে নিয়ে আসলেই কিছু লিখতে চাচ্ছি না। তনু নামের এই মেয়েটির ধর্ষণ কিংবা ধর্ষণের পর হত্যা নিয়ে এত আলোচনা কেন বলতে পারেন? কেন আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেকদিন পর একটি মিছিল দেখলাম ধর্ষণের এই ঘটনার কল্যাণে? তনুকে নিয়ে এত আলোচনার কারণ কি এই যে তনুর লাশ পাওয়া গিয়েছে কিংবা ধর্ষণটি হয়েছে সেনানিবাস এলাকার ভিতর? নাকি তনু একটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের শিক্ষার্থী ছিল এজন্যে? নাকি তনু হিজাব পরতো এজন্যে? নাকি মিডিয়ায় এ নিয়ে খবর নেই এজন্যে?

এই তিনটি কারণই ভিত্তিহীন কিংবা অমূলক হতে পারে, হোক এমনটাই চাই। কিন্তু নিশ্চিতভাবে জানি যে একটি ধর্ষণ ও হত্যা হয়েছে যার প্রতিবাদ করা উচিত সেই চিন্তা থেকে আমরা এত আলোচনা করছি না। ধর্ষণ প্রতিদিন হচ্ছে, সারা দেশে হচ্ছে, সব বয়সের মেয়েদের সাথে হচ্ছে। বয়সটা জন্মের পরদিনও হতে পারে! তাই এত ধর্ষণের পরও চুপ করে বসে থাকা আমরা হঠাৎ করে এত সচেতন হয়ে যাব তা মেনে নিতে পারছি না। ফেসবুকে একজন লিখেছেন যে আর পাঁচ ঘন্টার ভিতর ফেসবুকে তনুকে নিয়ে যাবতীয় আলোচনা শেষ হয়ে যাবে। কারণ এরপর বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচ শুরু হবে। বাস্তবতা যে সেরকমই ছিল তা কিন্তু আমাদের ফেসবুকের নীল দেয়ালই প্রমাণ করতে যথেষ্ট। এক্ষত্রে তনুর ঘটনা নিয়ে এত আলোচনা আমাদের সাময়িক অবসর মস্তিষ্কের নিউরন সেলগুলোকে কাজে লাগিয়ে রাখার প্রয়াসের চেয়ে বেশি কিছু মনে করছি না। তাই তনু থাক, চলুন ধর্ষণ নিয়ে কথা বলি।

ধর্ষণ, শব্দটি এখনো ট্যাবুই বলতে হবে। বাসায় কবে আমার বাবা শেষ ধর্ষণ শব্দটি উচ্চারণ করেছে মনে নেই, মা কবে করেছে তাও মনে নেই। ধর্ষণের চেয়ে রেইপ শব্দটা বেশ সহজে ব্যবহারযোগ্য। যার ধর্ষণ হয়েছে তার চেয়ে যার রেইপ হয়েছে সে যেন একটু বেশি সাবলীল আমাদের কাছে! ধর্ষণের সংজ্ঞা অনুযায়ী কারো মতের বিরুদ্ধে তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপণই ধর্ষণ। সংবাদপত্রের পাতায় আমরা এসব ধর্ষণের সংবাদ নিয়মিত দেখি, দেখতে দেখতে এমন অবস্থা যে এখন আর দেখিও না। বিষয় হল, পৃথিবীর ইতিহাসে ধর্ষণ সবসময়ই একটি বড় শক্তি হিসেবে বিবেচিত। আপনি এমন একটা যুদ্ধ দেখাতে পারবেন না যেখানে বিরোধীপক্ষের নারীদের ধর্ষণ করা হয় নি এমন স্পষ্ট দাবি করা হয়েছে। গণতন্ত্রের যুদ্ধে আমার দেশেও নির্বাচনের পর পরাজিত দলের সমর্থকদের পরিবারের নারীদের ধর্ষণ এক ধরণের সংস্কৃতির মতই। পহেলা বৈশাখে খোলা আকাশের নিচে যৌন সন্ত্রাস কিংবা মিশরের ‘তাহারুশ’ নামক রেইপ গেম কিংবা মিডিয়ার এ বিষয়ক সংবাদ, সবই তো আমাদের, মানে পুরুষদের আনন্দ দেয়। প্রিন্ট মিডিয়ায় ধর্ষণের সংবাদে শব্দের ব্যবহারগুলো অনুসন্ধানে দেখা গিয়েছিল এসব শব্দ পাঠকদের ‘ছদ্ম ধর্ষণ’-এর স্বাদ দেয়। অর্থাৎ শারীরিক ধর্ষণের শিকার একজন আরও কতবার যে পুরুষের মস্তিষ্কে ধর্ষিত হচ্ছেন তা তিনিও জানতে পারেন না। এটা হল পুরুষতান্ত্রিকতা বা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নিয়ম।

আসেন নিজেকে নিয়ে কথা বলি। মিডিয়া কিংবা ধর্ষণ কিংবা পুরুষতান্ত্রিকতা নিয়ে অনেক বললাম, এবার চিন্তা করি। চিন্তা করি এই লেখাটি লেখার আগে আমি যে নারীদের দেখে এসে লিখতে বসেছি, তাদের নিয়ে যা ভেবেছি তার ঠিক উল্টো কথাই কি এখন লিখছি না? আপনি যখন লেখাটি পড়ছেন তার ঠিক আগ মূহুর্তে একজন নারীর প্রতি আপনার তাকানোর ভঙ্গি কিংবা চিন্তাটি কেমন ছিল? আমরা যারা ধর্ষণের বিরুদ্ধে কথা বলি বা বলছি, কিন্তু সামনে কোন নারী থাকলে তাকে চোখ দিয়েই ধর্ষণ করে ফেলছি তার হিসাবটা কিভাবে মিলাবেন? ধর্ষণ কিংবা পুরুষতান্ত্রিকতাকে টিকিয়ে রাখছি আমরাই, প্রতিদিনই আমরা এগুলোকে জাস্টিফাই করছি। তাই তনুকে নিয়ে আলোচনা করতে চাই না বা লিখতে চাই না, চলেন ধর্ষণ কিংবা পুরুষতান্ত্রিকতা নিয়ে কথা বলি। ধর্ষণ কিংবা পুরুষতান্ত্রিকতা নিয়ে সঠিক আলোচনা হলে তনুদের এই দশা আর দেখতে হবে না।

১ thought on “ধর্ষণ, কিংবা পুরুষতান্ত্রিকতা”

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।