শিবলী নোমান

অগ্নিস্নানে সূচি হোক ধরা!

শিবলী নোমান

বাংলা ১৪০৮ সালের পহেলা বৈশাখ মনে আছে? মনে থাকারই কথা কারণ দিনটা বাংলা নববর্ষ। তবে আরো ভালো মনে পড়বে ইংরেজি সালটা বলে দিলে, ইংরেজি ২০০১ সালের বাংলা নববর্ষের কথা বলছি। ঠিক ধরেছেন, যেবার নববর্ষে রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা হল সেই নববর্ষের কথা বলছি। ২০০১ তো অনেক আগের কথা, গতবছরের পহেলা বৈশাখের কথা মনে আছে? পহেলা বৈশাখের বিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রবেশমুখে যৌন সন্ত্রাসের কথা মনে আছে? হয়ত মনে আছে, কিংবা নেই!

আমরা যতই বলি না কেন যে আমরা কখনো অন্যায় মেনে নেই না, এই কথাটার সাথে দ্বিমত থেকেই যায়। আমরা অন্যায় মেনে নেই না ঠিক কিন্তু আমরা সময়মত অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াইও না। ২০০১ সালের নববর্ষে বোমা হামলার জবাব আমরা দিয়েছিলাম ২০০২ সালের নববর্ষে আরো বেশি লোকসমাগম করে। আমরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে গিয়েছিলাম বাঙালির প্রাণের উৎসব নববর্ষ পালনে রমনায় কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কিংবা সারা দেশে। গতবছর যখন নববর্ষে যৌন সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটল তার পর বেশ কিছুদিন শুধু এই বিষয় নিয়েই আলোচনা হয়েছে। আমি নিজেও এই বিষয় নিয়েই ব্যস্ত থেকেছি তা অস্বীকার করব না। কিন্তু কতদিন? নববর্ষে এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার প্রতিবাদে প্রতিবাদী সমাবেশ হয়েছে, পাল্টা আঘাতের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু কোথায় সেই পাল্টা আঘাত? পাল্টা আঘাত যদি আমরা করতেই পারতাম তাহলে কি আজ সোহাগী জাহান তনু এভাবে মারা যায়? পাল্টা আঘাত যদি কুরতেই পারি তাহলে কেন আমি নববর্ষের বিকালে পাঁচটার পর ঢাকা বিশ্বোবিদ্যালয় এলাকায় থাকতে পারব না? কেন বিকাল পাঁচটার পর কোন অনুষ্ঠানে আমার নিরাপত্তা দিতে পারবে না রাষ্ট্র?

সোহাগী জাহান তনুর হত্যা বা ধর্ষন নিয়ে অনেক জলঘোলা হয়েছে, কিন্তু আমি বরাবর আলোচনাটা আরো বৃহৎ পরিসরে করতে চাই। আমি এই আলোচনা শুধু তনুর ভিতর আটকে রাখতে চাই না। প্রতিদিন কতজন তনু নির্যাতিত হচ্ছে আমরা জানি কি? আর প্রকৃত নির্যাতনের কতগুলো ঘটনাইবা আমরা জানতে পারছি? কিংবা পুরুষের উপর হওয়া যৌন নির্যাতন নিয়ে আমরা কি আদৌ সচেতন?

আমি বলছি না আমরা প্রতিবাদ করছি না কিংবা প্রতিবাদের পথটি ঠিক নয়। প্রতিটি প্রতিবাদ জরুরি। কিন্তু একইসাথে এও জরুরি যে প্রতিবাদটি যেন কাঙ্খিত ফলাফল নিয়ে আসে। আমরা আবেগের বশে কিছু ঘটে গেলে লিখতে শুরু করি, বলতে শুরু করি, আন্দোলন করি; কিন্তু নতুন কোন বিষয় সামনে আসলেই আমরা ভুলে যাই সব, আমরা নতুনের প্রতি আবার আবেগতাড়িত হই। আবেগপ্রবণতাকে খারাপ বলছি না, আবেগ না থাকলে মুক্তিযুদ্ধ হত না। কিন্তু আমাদের আবেগের জায়গাগুলো পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে সেটাই চিন্তার বিষয়। আমরা আমাদের আবেগ দেখানোর সবচেয়ে বড় জায়গা বানিয়ে ফেলছি ভার্চুয়াল জগতকে। এ কথা নিঃসন্দেহে স্বীকার্য যে অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সামাজিক মাধ্যম ও তার ব্যবহারকারীরা মূলধারার গণমাধ্যমের দায়িত্ব পালন করছেন, কিন্তু এর ফলে সার্বিকভাবে ভার্চুয়াল জগত খুব ইতিবাচকতা দেখাচ্ছে তা বলা যায় না। টি-টোয়েন্টি ওয়ার্ল্ড কাপের দেমিফাইনালে ভারত-ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ যখন হেরে যাবে মনে হচ্ছিল তখনই আমরা ভার্চুয়াল জগতে নানা ষড়যন্ত্রতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেছিলাম, খেলার ফলাফলের পর সেসব আষাঢ়ে গল্প আষঢ়ে গল্পেই পরিণত হয়েছে। মূলধারার গণমাধ্যমের কাজ মূলধারার গণমাধ্যম করছে না বা করতে পারছে সেটি যেমন হতাশার তেমনি ভার্চুয়াল জগতের কার্যক্রমও অনেক ক্ষেত্রে নিতান্তই দুঃখজনক।

বাংলা নববর্ষ আমাদের আনন্দের দিন, আমাদের উদযাপনের দিন। এই দিনে আমাদের সমালোচনা করে দিনটার আনন্দ কমিয়ে দেয়া কোনভাবেই আমার উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু নববর্ষ আমার কাছে উপলব্ধিরও দিন। গত একটা বছর কী করেছি আর কী করার কথা ছিল সেই হালখাতা মিলিয়ে নেয়ার দিন। নতুন বছরে আরো ভালো কিছু করব এই চিন্তার দিন। নববর্ষ এলেই আমরা বলি, ‘অগ্নিস্নানে সূচি হোক ধরা’। এই অগ্নিস্নান এখন বড় জরুরি। ঠিক ততটাই জরুরি আমাদের সূচি হওয়া। হ্যা, আমাদের কথাই বলছি। যারা এখনো আবেগতাড়িত হই, যারা আবেগতাড়িত হয় তারাই মানুষ। তাই মানুষ হিসেবে সূচি হতে চাই, অগ্নিস্নাত হতে চাই। নববর্ষ আমাদেরকে নতুন দিনের আশা দেখাক, নববর্ষ আমাদেরকে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শেখাক। তাই নববর্ষে অগ্নিস্নানে সূচি হোক ধরা, অগ্নিস্নানে সূচি হই আমরা।

নববর্ষের শুভেচ্ছা।

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।