শিবলী নোমান

‘চোথা’ পাঠের সঙ্কট কিংবা ম্যাকলুহান-হল রহস্যগাঁথা

শিবলী নোমান

আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়ালেখার ক্ষেত্রে ‘চোথা’ নামক আজব এক বস্তুর দেখা মেলে, যা হলো কোন একটি বিষয়ের উপর তৈরি করা নোট, এবং এর মান যেমনই হোক না কেন, এই ‘চোথা’ নামক বস্তু পরীক্ষার সময় উগড়ে দেয়ার এক দারুণ উপায় হিসেবে বিবেচিত হয়।

তো, মোটাদাগে আমাদের সামনে দুই ধরনের ‘চোথা’-র দেখা মিলে। প্রথমত, একজন শিক্ষার্থী কর্তৃক নিজ ব্যবহারের উদ্দেশ্যে তৈরি করা নোট, যা এরপর আবহমানকাল ধরে ছোট ছোট নাদান ভাই-বোনদের শিক্ষার্জন নামক ভয়ঙ্কর বিষয়টির হাত থেকে রক্ষা করে চলে পরম মমতায়। আর বিপরীতদিকে নিজের তৈরি করা এসব নোটের এমন দীর্ঘ ব্যবহারযোগ্যতা আবার এক ধরনের প্রশান্তি তৈরি করে এর আদি ও আসল রচয়িতার মনে।

দ্বিতীয়ত, শিক্ষকের তৈরি করা ‘চোথা’। শোনা যায়, কোন কোন শিক্ষক যে নোটের সাহায্য নিয়ে ক্লাস নেন, সেই নোটের কাগজের রঙ সময়ের সাথে সাথে সাদা থেকে হলুদে পরিণত হয়েছে, ছিড়ে-ফেটেও গেছে হয়তো জায়গায় জায়গায়। আবার চাইলেও অনেক সময় শিক্ষকের মান্ধাতা কিংবা তামাদি হয়ে যাওয়া পাঠ্য থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হয় না শিক্ষার্থীদের পক্ষে, কারণ সেই তামাদি হয়ে যাওয়া বিষয়ের ভেতরই পুঞ্জীভূত থাকে আরাধ্য মার্কস-নম্বর-গ্রেড।

এরূপ ‘চোথা’ বা ‘চোথাসমগ্র’ যতক্ষণ পর্যন্ত তামাদি হয়ে না যাচ্ছে, কিংবা সঠিকভাবে একটি বিষয়কে তুলে ধরছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আসলে ‘চোথা’ সংস্কৃতি নিয়ে খুব বেশি মাথাব্যথার কারণ থাকে না, কারণ এর চেয়ে অনেক বড় বড় মাথাব্যথার কারণ নিয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ধুকছে। কিন্তু উল্লিখিত দুইটি শর্তের কোন একটি পূরণ করতে না পারলেই ‘চোথা’ হয়ে উঠতে পারে মারাত্মক বিপজ্জনক ও বিভ্রান্তিতে পূর্ণ।

মূল পাঠ্য না পড়ে তামাদি পাঠ্য কিংবা ‘চোথা’-য় নির্ভর হওয়ার কারণে দুইজন মানুষের সাথে আমার যথাযথ পরিচয় নিদারুণভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে বলে মনে পড়ে। সেই দুঃখগাথা বিবৃত করাই আজকের উপলক্ষ্য। এই দুইজনের একজনের নাম মার্শাল ম্যাকলুহান, অপরজন স্টুয়ার্ট হল।

ভুল মিডিয়ামে ম্যাকলুহানের ম্যাসেজ

মার্শাল ম্যাকলুহান প্রদত্ত বেশ কিছু কনসেপ্ট বা ধারণা যোগাযোগ ও গণমাধ্যমের শিক্ষার্থীদেরকে অপরিহার্যভাবে জানতে হয়। এর ভেতর সর্বাপেক্ষা আলোচিত সম্ভবত ম্যাকলুহানের Medium is the Message শীর্ষক বক্তব্য, যার বাংলা করা হয়েছে বাহনই বার্তা বা মাধ্যমই বার্তা

মার্শাল ম্যাকলুহান

ম্যাকলুহানকে বলা হয় যোগাযোগ ও প্রযুক্তি সংক্রান্ত তত্ত্বের রহস্যমানব, যার অনেক রচনারই প্রকৃত পাঠোদ্ধার একেবারে সম্ভব না হলেও, কষ্টসাধ্য বটে। এরকম একজন তাত্ত্বিক প্রদত্ত ধারণাগুলো নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে তাঁর মূল রচনাগুলোকে পাশ কাটিয়ে সরল থেকে সরলতর ব্যাখ্যার বিপদ হলো, বাহনই বার্তা মানে আসলে যে কী, সেটিই অনেক শিক্ষার্থী আর ধরতে পারেন না। শরীরে ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ লেখা থাকা বোমার বিস্ফোরণ আর অন্য বোমার বিস্ফোরণের ভেতরের বার্তায় কোন পার্থক্য নেই, এই উদাহরণ দিয়ে ম্যাকলুহানকে বুঝতে পারা আদৌ কতটা সম্ভব, তা হয়তো ম্যাকলুহানই ভালো বলতে পারবেন।

নিজ তাত্ত্বিক আলোচনার জোরে টরন্টো স্কুল নামে পরিচিতি পাওয়া ম্যাকলুহান বলেছিলেন,

…”the medium is the message” because it is the medium that shapes and controls the scale and form of human association and action.1

মূলত, একটি নতুন প্রযুক্তি আসার ফলে মানুষের জীবনাচরণ পরিবর্তিত হয়, আর এজন্যই প্রযুক্তিকে ইতিবাচক ধরে নেয়া একজন মাধ্যম তাত্ত্বিক হিসেবে ম্যাকলুহান বলেছিলেন ঐ নতুন প্রযুক্তিটিই আসলে একটি মাধ্যম, দৈনন্দিন জীবনাচরণের মাধ্যম। আর ঐ নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে আমাদের জীবনাচরণ বদলে যায়, সেই প্রযুক্তি বা মাধ্যমের কনটেন্ট বা আধেয় যাই হোক না কেন।

বাসার ড্রয়িং রুমে নাটক দেখা আর নিজের স্মার্ট ফোনে একটি নাটক দেখার ভেতর মূল পার্থক্য হলো নির্দিষ্ট স্থানে পরিবারের আরো অনেকের সাথে নাটকটি দেখা, আর যে কোন স্থানে সাধারণত একাকী নাটকটি দেখা। এই যে ড্রয়িং রুমের স্থলে এখন আপনি-আমি হাই কমোডে বসেও নাটক দেখতে পারছি স্মার্ট ফোনের কল্যাণে, যা আমাদের নাটক দেখার অভ্যাস ও চর্চাকে বদলে দিয়েছে, তাই হলো স্মার্ট ফোনের ম্যাসেজ। অর্থাৎ, নাটক দেখার জন্য ড্রয়িং রুম আর টেলিভিশনের আর প্রয়োজন নেই।

যোগাযোগের বার্তা আর ম্যাকলুহানের ম্যাসেজ যে দুটি ভিন্ন বস্তু, তা ম্যাকলুহানের মূল টেক্সটে একবারেই স্পষ্ট। কিন্তু গদিনসীন ‘চোথা’-র কাছে ম্যাকলুহানও আজ অসহায়, সেই ‘চোথা’ বড় ভাই বা বোনের তৈরি হোক, বা কোন শিক্ষকের।

আ ক্রিটিক্যাল সার্চ ফর স্টুয়ার্ট হল

২০১৪ সালে স্নাতক ৩য় বর্ষে অধ্যয়নকালে প্রথম পরিচিত হয়েছিলাম স্টুয়ার্ট হলের ক্রিটিক্যাল থিওরির সাথে। তখন পর্যন্ত বিভাগের সেমিনার গ্রন্থাগার না থাকায় এবং একই সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে খুব বেশি বিভাগীয় বই না থাকায় ইন্টারনেটই ছিল মূল ভরসা। তো, হলের ক্রিটিক্যাল থিওরি নিয়ে ক্লাসে আলোচনার পর থেমে থেমে বেশ কয়েকবার ইন্টারনেটে হলের ক্রিটক্যাল থিওরি খুঁজে প্রথমে ব্যর্থ ও পরে হতাশ হয়েছি। ইন্টারনেটের মতো সহজলভ্য মাধ্যমেও হলের ক্রিটিক্যাল থিওরি খুঁজে না পাওয়ার বেদনা আমাকে পুড়িয়েছে দীর্ঘদিন।

এরই মধ্যে শিক্ষকতায় যোগদানের পর যোগাযোগ ও গণমাধ্যম তত্ত্ব পড়ান এমন একজন শিক্ষকের কাছে জানতে চেয়েছিলাম যে তিনি স্টুয়ার্ট হলের ক্রিটিক্যাল থিওরি কোথা থেকে পড়ান, মূলত এ সংক্রান্ত টেক্সট পড়ার আগ্রহ থেকেই জানতে চেয়েছিলাম। তিনি আমাকে বলেছিলেন ইএম গ্রিফিনের বইতে আছে। কিন্তু ঐ বইতে আমি এরূপ কোন অধ্যায় খুঁজে পেলাম না। বার্মিংহাম স্কুলখ্যাত স্টুয়ার্ট হলের নানা রচনা ও কাজ বিভিন্ন সূত্রে খুঁজে পেলেও, এত সন্ধানের পরও তাঁর ক্রিটিক্যাল থিওরি থেকে গেলো অধরাই।

এরপর করোনাকালে গ্রিফিনের বইয়ের নতুন একটি সংস্করণ আমার হাতে আসে। সে সময় আমি বইতে থাকা স্টুয়ার্ট হলের Cultural Studies শীর্ষক অধ্যায়টি পড়তে শুরু করি। ততদিনে ক্রিটিক্যাল থিওরি নিয়েও কিছুটা পড়ালেখা করায় জানা ছিল যে, ক্রিটিক্যাল থিওরি আসলে তত্ত্বের একটি মৌলিক শ্রেণি বা প্রকার, ফলে ক্রিটিক্যাল থিওরি একমাত্র স্টুয়ার্ট হলের দেয়া তত্ত্ব নয়, বরং যোগাযোগ ও গণমাধ্যমকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বহু তাত্ত্বিক ক্রিটিক্যাল ধারার তত্ত্ব প্রদান করেছেন।

যাই হোক, গ্রিফিনের বইতে হলের কালচারাল স্টাডিজ শীর্ষক অধ্যায়ের একটি অংশে পড়লাম,

Obviously, critical theory and cultural studies are close relatives. However, Hall placed less emphasis on rationality and more emphasis on resistance.2

যেহেতু, তত্ত্বের ইন্টারপ্রেটিভ ও ক্রিটিক্যাল ধারা প্রায়শই একে অপরের সাথে মিশে যায়, ফলে তত্ত্বের প্রকৃতি নিয়ে বিতর্কের অবকাশ থাকে, তারপরও গ্রিফিনের এই বয়ান থেকে এটুকু প্রায় স্পষ্ট যে, স্টুয়ার্ট হলের তত্ত্ব ক্রিটিক্যাল থিওরির কাছাকাছি হলেও, ক্রিটিক্যাল থিওরি নয়।

হলের সুলুক সন্ধানের গল্পটি এখানে শেষ হলেও হতে পারতো। তবে সেটি হলে এই গল্পটি বর্তমান লেখায় প্রাসঙ্গিক হতো না। গল্পটা শেষ করা যাক তাহলে!

স্টুয়ার্ট হল

ঠিক সেই সময়েই আমি গ্রিফিনের বইয়ের একটি ওয়েবসাইটের সন্ধান পাই। এই সাইটে গ্রিফিনের A First Look at Communication Theory শীর্ষক গ্রন্থের সর্বশেষ সংস্করণে নেই, কিন্তু পূর্বের কোন না কোন সংস্করণে ছিল, এমন অধ্যায়গুলো আর্কাইভ করা আছে। সেখানেও আমি পুরনো কোন সংস্করণে স্টুয়ার্ট হলের ক্রিটিক্যাল থিওরি খুঁজে পেলাম না। কিন্তু এই গ্রিফিনের হল রহস্য আমাকে তাড়া করে ফিরতো।

হুট করেই একদিন বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরিতে থাকা গ্রিফিনের বইয়ের জরাজীর্ণ এক ফটোকপি সংস্করণের কথা আমার মনে পড়ে যায়, যা আমি বহু আগে ছাত্রাবস্থায় দেখেছিলাম। সেমিনার গ্রন্থাগার থেকে খুঁজে সেই বইটি বের করার পরই যেন খুলে গেলো আলীবাবার গুহা, জেগে উঠলো সিন্দাবাদের দৈত্য! এই জরাজীর্ণ বইয়ের ২৯তম অধ্যায়ে আমি পেলাম Critical Theory of Stuart Hall। আমি পাইলাম, আমি ইহাকে পাইলাম!

কিন্তু, সেই আরাধ্য অধ্যায়টি পড়ে আমি যারপরনাই হতাশ হলাম। এর বেশিরভাগ অংশই গ্রিফিনের বইয়ের সর্বশেষ সংস্করণে থাকা স্টুয়ার্ট হলের কালচারাল স্টাডিজ অধ্যায়ের সাথে মিলে যায়। কিন্তু বিষয়টি এবার আমার কাছে কিছুটা পরিষ্কার হতে শুরু করে।

যে জরাজীর্ণ বইটিতে আমি স্টুয়ার্ট হলের ক্রিটিক্যাল থিওরি খুঁজে পাই, তা ১৯৯১ সালে প্রকাশিত গ্রিফিনের বইয়ের ১ম সংস্করণ। কোন কারণে হয়ে যাওয়া ভুল সংশোধন করতে, অথবা পরবর্তী সময়ে ধারণায় পরিবর্তন আসায় অধ্যায়টির নাম পরিবর্তন করে কালচারাল স্টাডিজ রাখা হয়। আর এ কারণেই বইটির আর্কাইভ করা অধ্যায়গুলোতেও স্টুয়ার্ট হলের ক্রিটিক্যাল থিওরি বলে কিছু নেই। কারণ সর্বশেষ সংস্করণেও অধ্যায়টি বহাল তবিয়তে আছে কালচারাল স্টাডিজ নামেই।

এর ফলে উপসংহারটি এমন হয় যে, একটি বইয়ের প্রথম সংস্করণে থাকা ভুল, আমরা শিক্ষকরা শনাক্ত করতে পারলাম না তিন দশকেও, ততদিনে সেই ভুল সংশোধন করে বইটির আরো ১০টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়ে গিয়েছে। আমরা ভুলে যাই যে, শিক্ষকতা আসলে শিখতে থাকার একটি প্রক্রিয়া। তো, এরূপ একটি প্রক্রিয়ার অংশ হয়ে বছরের পর বছর একই ‘চোথা’ পড়িয়ে যাওয়ার যুক্তিটা কী হতে পারে? আপনার কোর্স বা পঠিত বিষয়ে পরিবর্তন না আসতে পারে, কিন্তু সেই বিষয়গুলোর সাম্প্রতিক পরিবর্তনগুলো তো জানা থাকবে, নাকি? অন্যদিকে ভাষা এমন এক বিষয়, প্রতিবার পাঠ করলে যার অর্থ বদলে যায়। অর্থাৎ একই পাঠ্য দুইবার পড়লে তাতে অর্থ আর বোঝাপড়ার ভিন্নতা থাকে, বারবার পড়লে নিজের বোঝাপড়া স্পষ্ট হতে থাকে। অথচ আমরা একবার পড়ে শেষ করতে পারলে বাঁচি! সেটিও তবেই করি যদি না নিজের ছাত্রজীবনের ‘চোথা’ দেখে ক্লাস নিতে থাকি।

মূল টেক্সটে ম্যাকলুহান আর হল কিংবা অন্যদের যেভাবে পাওয়া সম্ভব, পীর-ফকির ধরে যে তা হয় না, কবে বুঝবি পাগলা, কবে?

তথ্যসূত্র:

1 Understanding Media: The Extensions of Man by Marshall McLuhan

2 A First Look at Communication Theory (10th Edition) by Em Griffin, Andrew Ledbetter and Glenn Sparks

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।