শিবলী নোমান

ট্রাম্পের বিজয়ে চারখানা পুরনো লেখা

শিবলী নোমান

২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত জিতেই গেলেন রিপাবলিকান পার্টির আলোচিত-সমালোচিত প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। আগামী চার বছর ৪৫ তম ব্যক্তি হিসেবে তাঁর নামের আগে উচ্চারিত হবে ‘মিস্টার প্রেসিডেন্ট’ শব্দদ্বয়। আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলো এই নির্বাচনে নগ্নভাবে ডেমোক্রেটিক প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনকে সমর্থন দিয়েছে। আমাদের সংবাদমাধ্যমগুলোও সেসব সংবাদই প্রকাশ করেছে প্রতিনিয়ত। তা ট্রাম্পের এই বিজয়কে মিডিয়ার এজেন্ডা সেটিং ও প্রোপাগান্ডার মহাবিপর্যয় বলা যেতেই পারে। এটিই হয়ত ‘কুন্ডলিভেদ’।

২০১৬ সালের জুন মাসে ব্রেক্সিটের পর থেকেই ট্রাম্পের বিজয়ের সম্ভাবনা মাথায় ঘুরছিলো। তবে তা প্রবল হতে থাকে প্রেসিডেন্সিয়াল ডিবেটগুলো থেকে। এসব চিন্তা থেকেই ব্রেক্সিট ও তিনটি প্রেসিডেন্সিয়াল ডিবেট পরবর্তী ভাবনা নিয়ে চারটি লেখা এই সুযোগে একত্রে রিভার্স ক্রনোলজিতে প্রকাশ করলাম।

তবে দিনশেষে কথা এই যে, ট্রাম্পের জয় বা হিলারির পরাজয়ে আশান্বীত হওয়ার কোন কারণ দেখি না। হিলারির জয় বা ট্রাম্পের পরাজয়েও তা ছিল না। দুই প্রার্থীর কেউই মানবিক বিশ্বের পক্ষে সহায়ক নয়। মিডিয়ার নির্লজ্জ পক্ষপাতিত্বের কারণেই বারবার লেখাগুলো লিখেছিলাম। ট্রাম্পকে সমর্থন দিতে নয়।

১। হিলারির মিডিয়া, ট্রাম্প বা আমাদের নয়!

২০১৬ সালের মার্কিন যুক্তরষ্ট্রের প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচন উপলক্ষে ৩য় ও সর্বশেষ প্রেসিডেন্সিয়াল ডিবেট অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো গত বৃহস্পতিবার। নেভাদা অঙ্গরাজ্যের লাস ভেগাসে অনুষ্ঠিত এই সর্বশেষ বিতর্ক ডেমোক্রেট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন ও রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্যে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল কারণ তিনটি স্থানে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্সিয়াল ডিবেটের ভিতর শুধুমাত্র নেভাদাই হল একটি ‘সুইং স্টেট’। অর্থাৎ এই অঙ্গরাজ্যের ছয়টি ইলেক্টোরাল কলেজের স্থায়ী সমর্থন নেই নির্দিষ্ট কোন দলের প্রতি। তাই এই অঙ্গরাজ্যে অনুষ্ঠিত ডিবেট এই অঙ্গরাজ্যের ভোটারদের সমর্থন আদায়ের শ্রেষ্ঠতম সুযোগ। তবে পশ্চিমা মিডিয়াগুলো বারংবার বলে এসেছে যে এই ডিবেট রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্যে আরেকটি কারণে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তা হলো, দ্বিতীয় প্রেসিডেন্সিয়াল ডিবেটের দুইদিন আগে ২০০৫ সালের এক অডিও প্রকাশের মাধ্যমে নারীর প্রতি অসম্মানজনক আচরণের অভিযোগে যে ধরণের বিরূপ অবস্থার মুখোমুখি ট্রাম্প হয়েছেন, একই সাথে ঐ ডিবেটের পর থেকে সর্বশেষ ডিবেটের মধ্যবর্তী সময়ে এই ইস্যুতে যেভাবে নতুন করে জল ঘোলা হয়েছে তাতে ট্রাম্পের জন্যে শেষ বিতর্ককে তার টিকে থাকার শেষ সুযোগ বলাই যায়। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, পশ্চিমা মিডিয়ার সাথে গলা মিলিয়ে এই বিতর্ককে ট্রাম্পের শেষ সুযোগ বলা কতটা সঙ্গতিপূর্ণ তা ভেবে বের করা।

দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রেসিডেন্সিয়াল ডিবেট দেখে এবং এই ডিবেট দু’টির আগে-পরে পশ্চিমা মিডিয়ার সংবাদ প্রকাশের ভঙ্গি দেখে আর যাই হোক তাদের বস্তুনিষ্ঠ বলার আর কোন সুযোগ নেই। সুযোগ নেই নিরপেক্ষ বলারও। তারা কেউ ঘোষণা দিয়ে কেউ ঘোষণা না দিয়ে হিলারি ক্লিনটনকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে তা খুব সহজেই চোখে পড়ছে। কিন্তু এর ফলে সমস্যায় পড়ে যাচ্ছি আমরা বাংলাদেশ কিংবা পশ্চিমা সংবাদ সংস্থা ও মিডিয়া হাউসগুলোর উপর আন্তর্জাতিক সংবাদের জন্যে নির্ভরশীল দেশগুলো। যেহেতু আমাদের দেশের গণমাধ্যমগুলোর অধিকাংশই পশ্চিমা সংবাদ সংস্থাগুলো থেকে আন্তর্জাতিক সংবাদের সাবস্ক্রাইবার হিসেবে সংবাদ পায়, তাই আমাদের গণমাধ্যমেও সেসব সংবাদই উঠে আসে যা ঐ পশ্চিমা সংবাদ সংস্থা বা মিডিয়া হাউসগুলো করছে। এর ফলে হিলারি ও ট্রাম্প উভয়ই আমাদের কাছে সমান পরিচিত কিংবা সমান অপরিচিত হওয়ার পরও ট্রাম্পকে কেন জানি আমাদের একটু বেশি খারাপ মানুষ কিংবা তার নির্বাচিত হওয়ার ঘটনাকে এক ধরণের আতঙ্ক মনে হয়; তাই নয় কি?

আমি যে গণমাধ্যম অধ্যয়নের তাত্ত্বিকতার আলোকেই এসব বলছি তা ভেবে নেয়ার কোন কারণ নেই। বরং হিলারি-ট্রাম্প বা মার্কিন প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচন ইস্যুতে আমি একদম চোখের সামনে মিডিয়ার এমন ব্যবহার দেখেছি একের পর এক। সম্প্রতি ট্রাম্পের ২০০৫ সালের যে অডিও ফাঁস হয়েছে এবং ২য় বিতর্কের পর আরো নয় জন নারী তার বিরুদ্ধে যে যৌন হয়রানির অভিযোগ এনেছেন তার সবই কিন্তু এখন পর্যন্ত অভিযোগ। কোনটাই প্রমাণিত নয়। তবে এ ধরণের অভিযোগে দুষ্ট একজন ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি হওয়ার কিংবা নির্বাচনে অংশ নেয়ার যোগ্য কিনা তা নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে এবং সেক্ষেত্রে অবশ্যই ট্রাম্পকে সমর্থন দেয়ার কোন কারণ নেই। কিন্তুই এখন যেহেতু এটি নিয়ে আলোচনার কিছু নেই তাই বলতেই হচ্ছে যে শুধুমাত্র অভিযোগের উপর ভিত্তি করে মিডিয়াগুলো ট্রাম্পকে যেভাবে চিত্রায়িত করছে  তা কি ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ নয়? তথাকথিত বস্তুনিষ্ঠ গণমাধ্যমগুলোকে কি বলে দিতে হবে যে প্রমাণ হওয়ার আগে কোন ব্যক্তিকে অপরাধী হিসেবে উপস্থাপন করা যায় না? ঠিক আছে, যদি মেনেও নেয়া হয় যে হিলারি সমর্থন দেয়ার কারণে মিডিয়াগুলো এমন করছে, তাহলে ট্রাম্প যে পরপর দুইটি বিতর্কে বললেন তার সম্পর্কে শুধু অভিযোগ আছে আর বিল ক্লিনটনের এসব বিষয় প্রমাণিত, সেগুলো কয়বার উল্লেখ করেছে মিডিয়াগুলো?

তথাকথিত বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ মিডিয়াগুলোর নগ্ন পক্ষপাতিত্ব দেখা যাচ্ছে হিলারির প্রতি। তারা হিলারি ক্লিনটনের ই-মেইল কেলেঙ্কারি নিয়ে কোন আলোচনাই করছে না। বরং এগুলোকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোপনীয় নথি উল্লেখ করে রাশিয়ার বিরুদ্ধে তা হ্যাক করার অভিযোগ আনা হয়েছে। আরো অভিযোগ আনা হয়েছে রাশিয়া এগুলো উইকিলিকসের মাধ্যমে প্রকাশ করছে যেন মার্কিন নির্বাচনের ফলাফলকে প্রভাবিত করা যায়। ট্রাম্প বিরোধীদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে মিডিয়া যখন ট্রাম্পকে ধুয়ে দিচ্ছে তখন অন্যদিকে হিলারির অভিযোগের ভিত্তিতেই উইকিলিকস ও রাশিয়ার মার্কিন গোপনীয় নথি হ্যাক করে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার প্রচারণাও চালাচ্ছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ মেইলগুলো কেন হিলারি ব্যক্তিগত ই-মেইল অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে আদান-প্রদান করলেন সে বিষয়ে মিডিয়াগুলোর কোন চিন্তা আছে বলে মনে হচ্ছে না। সর্বশেষ বিতর্কে ব্রাজিলের সাথে ২২৫ মিলিয়ন ডলারের ‘ওপেন বর্ডার ট্রেড’ ও স্টেট সেক্রেটারি থাকাকালে ছয় বিলিয়ন ডলারের হিসাব না পাওয়ার যে অভিযোগ ট্রাম্প হিলারির বিরুদ্ধে এনেছেন তা নিয়ে মিডিয়ায় কোন আলোচনা আছে কি? খুঁজে দেখুন, পাবেন না বলে দিতে পারি!

মিডিয়ার পক্ষপাতিত্ব নিয়ে আলোচনা সরিয়ে রেখে আসুন ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে ডালপালা মেলতে দেই। ২য় বিতর্কে ট্রাম্প বলেছিলেন তিনি নারীদের সম্পর্কে শুধু বলেছেন, এমন কিছু কখনো করেন নি। আর তার পরই একে একে নয় জন নারী বেরিয়ে আসলেন যারা ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেছেন। কেন ট্রাম্পের ঐ কথা বলা পর্যন্ত তারা অপেক্ষা করেছিলেন নিজেদের সাথে হওয়া অন্যায়ের কথা প্রকাশ করতে? নাকি ট্রাম্পের কথাতেই বিরোধী পক্ষের কারো মনে হল বিষয়টা এভাবে সাজিয়ে নেয়া যায়? ভেবে দেখবেন একটু!

পশ্চিমা মিডিয়ার বিপক্ষে অনেক বললাম। তাই শেষ করি পশ্চিমা মিডিয়ার পরিসংখ্যান দিয়েই। তিনটি ডিবেটেই হিলারি জিতেছেন বলে জরিপের ফল প্রকাশ করেছে সিএনএন ও ওআরসি। তিনটি বিতর্কে হিলারির পক্ষে রায় ছিল যথাক্রমে ৬২, ৫৭ ও ৫২ শতাংশ। ট্রাম্পের ক্ষেত্রে এটি যথাক্রমে ২৭, ৩৪ ও ৩৯ শতাংশ। জিতে গেলেও প্রতিবারই হিলারির সমর্থন কমেছে, বেড়েছে ট্রাম্পের। তাহলে কি বলা যায় ট্রাম্পের সম্ভাবনা এখনো শেষ হয়ে যায় নি? কার সম্ভাবনা আছে কিংবা নেই তা নিয়ে না ভেবে আসুন এমন একজন প্রেসিডেন্টের আশা করি যিনি শুধুমাত্র ব্যক্তিগত বন্দুক ব্যবহারের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বছরে ৩৩ হাজার মানুষের নিহত হওয়া ঠেকানো নিয়ে চিন্তা না করে বিশ্বের আনাচে-কানাচে মার্কিন স্বার্থরক্ষায় নিহত হওয়া প্রতিটি দেশের সাধারণ, বেসামরিক মানুষ সম্পর্কে চিন্তা করবে; ২০১৬ সালে এমন একজন প্রেসিডেন্ট পাওয়া যদিও দুরাশার সামিল। তাই চলুন দেখি শেষ পর্যন্ত কী হয়। কারণ শেষ হওয়ার আগে শেষ বলে কিছু নেই।

২। ট্রাম্পীয় প্যারাডক্স!

২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনের প্রার্থীদের ভিতর দ্বিতীয় দফা বিতর্ক হয়ে গেলো সোমবার। মিসৌরির সেন্ট লুইসের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত এই বিতর্ককে অনেকে উল্লেখ করেছেন নির্বাচনের দৌঁড়ে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের বেঁচে থাকার লড়াই হিসেবে। তবে বিতর্কের দুইদিন আগে ফাঁস হওয়া ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক ভিডিওর ফলেই অনেকে নির্বাচনে ট্রাম্পের শেষ দেখে ফেলেছেন। ২০০৫ সালে নারীদের সম্পর্কে কটুক্তি করার সেই ভিডিও ওয়াশিংটন পোস্টের মাধ্যমে ফাঁস হওয়ার পর অনেক রিপাবলিকান নেতাও এখন আর ট্রাম্পের পক্ষে প্রচারণা চালাতে চাইছেন না। আবার সম্ভব না হলেও অনেকেই রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বদলের দাবিও করেছেন। প্রার্থীর মৃত্যু বা স্বেচ্ছায় সরে না দাঁড়ালে অন্য কোন উপায়ে প্রার্থী বদলের ক্ষেত্রে যে অসংজ্ঞায়ন আছে তার ফলেই এই দাবি উঠলেও এই অন্য কোন কারণের অসংজ্ঞায়নের কারণেই এই পথটি রুদ্ধ হয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে কোনভাবেই নির্বাচন থেকে সরে না আসার ঘোষণা আগেই দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।

এ বছরের জুনে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে আসা তথা ব্রেক্সিটের সিদ্ধান্তের ফলেই ট্রাম্পের নির্বাচিত হওয়ার কথাটি বেশ যুক্তিযুক্তভাবে চিন্তায় আসে। ইউরোপ জুড়েই অভিবাসনবিরোধী যে কট্টর ডানপন্থী শক্তির উত্থান ইতিমধ্যেই লক্ষ্য করা গিয়েছে তার ঢেউ যে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনেও আছড়ে পড়বে তা সহজেই অনুমেয় ছিল। এরপর হিলারি-ট্রাম্প প্রথম বিতর্কের পর অল্পতেই ট্রাম্পের মেজাজ হারানো এবং জরিপে ট্রাম্পের শোচনীয় পরাজয়ের পরও আমার মনে হয় নি যে ট্রাম্প তখনই হেরে গিয়েছেন। যদিও বারংবার ট্রাম্পের হেরে না যাওয়ার কথা বলা কিংবা ব্রেক্সিটের রাজনৈতিক বার্তা হিসেবে ট্রাম্পের নির্বাচিত হওয়ার কথা বললেও একে ট্রাম্পের প্রতি আমার সমর্থন বা ‘সফট কর্ণার’ হিসেবে আখ্যায়িত করলে তা ভুল ছাড়া কিছু হবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন বলেই আমরা বছর দেড়েক আগে থেকে এ বিষয়ে আলোচনা করছি এবং নির্বাচনের এক মাস আগে এসে এই আলোচনা তুঙ্গে উঠেছে। কিন্তু বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে এই নির্বাচনে আমি কাউকে সমর্থন প্রদানের প্রয়োজন মনে করি না কারণ আমি দেখেছি মার্কিন নির্বাচনগুলোতে মূল আলোচনা হয়ে থাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আভ্যন্তরীন ইস্যু নিয়ে। পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে খুব বেশি মতের অমিল ডেমোক্রেট বা রিপাবলিকানদের ভিতর হতে দেখি না যদিও এ নিয়ে তাদের তর্ক কিংবা বাহাসের শেষ নেই।

তাই নির্বাচনে কাউকে সমর্থন প্রদানের অপ্রয়োজনীয় আলোচনাকে দূরে রেখে আসুন হিলারি-ট্রাম্প বিতর্কে ফিরে যাই। দ্বিতীয় দফা বিতর্কটি আমি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখেছি। আমার মনে হয়েছে ট্রাম্প প্রথম বিতর্কের চেয়ে অনেকি বেশি ভালো করেছেন এবং সবচেয়ে ভালো করেছেন সহজেই মেজাজ না হারিয়ে। যদিও আমার মনে হয়েছিল এই বিতর্কে দুই প্রার্থীর জয়ের সম্ভাবনা প্রায় সমান, কিন্তু বিতর্ক পরবর্তী জরিপের ফলাফল দেখে আমি বেশ অবাকই হয়েছি। ইউগভের অনলাইন জরিপে ৪৭ ভাগ ভোটার হিলারির পক্ষে এবং ৪২ ভাগ ভোটার ট্রাম্পের জয়ের কথা বলেছেন। কিন্তু সিএনএন ও ওআরসির জরিপ বলছে ৫৭ ভাগ ভোটার হিলারির পক্ষে ও ৩৪ ভাগ ভোটার ট্রাম্পের জয়ের পক্ষে বলেছেন। তবে উভয় ক্ষেত্রেই এটি স্পষ্ট যে ট্রাম্প আগের বিতর্কের চেয়ে এবার ভালো করেছেন। আবার সিএনএন ও ইউগভ উভয়ের জরিপেই হিলারির নির্বাচনে জয়ের সম্ভাবনা এক শতাংশ কমে গিয়েছে।

কিন্তু মজার বিষয় হল, এই বিতর্ককে ইতিহাসের অন্যতম ‘কদর্য’ বিতর্ক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। একের পর এক ব্যক্তিগত আক্রমণ আমরা দেখেছি এই বিতর্কে। কিন্তু আরেকটি বিষয় হল, এই বিতর্কে হিলারির প্রতি ট্রাম্প যেসব অভিযোগ এনেছেন তার বিপক্ষে সুস্পষ্ট কোন প্রমাণ হিলারি দেখাতে পারেন নি। তিনি এসব অভিযোগকে মিথ্যা বলে ট্রাম্পের প্রতি অভিযোগ তুলে ধরেছেন। অন্যদিকে হিলারি বারংবার রাশিয়ার বিপক্ষে কথা বলেছেন এবং ট্রাম্পকে প্রশ্নই করা হয়েছে উইকিলিকস তাকে সমর্থন করছে কিনা। ট্রাম্প এটি নাকচ করে দিলেও সম্প্রতি হিলারির ৩৩ হাজার ই-মেইল ফাঁস ও ওয়াল স্ট্রিটের সাথে হিলারির যোগাযোগের কথা প্রকাশ করে উইকিলিকস ট্রাম্পের পক্ষে না গেলেও স্পষ্টতই হিলারির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। অন্যদিকে ওবামা প্রশাসনের সাথে ক্রেমলিন ও পুতিনের সম্পর্কের জের ধরেই হিলারির সাথে পুতিনের সুসম্পর্কের কোন আভাস নেই। তবে এর মানে এই নয় যে ট্রাম্প রাশিয়ার পক্ষে কিছু কথা বললেই বা তিনি নির্বাচিত হলেই যে রাশিয়ার সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দারুন সম্পর্ক হয়ে যাবে। যদি তা আশা করা হয় তবে তার মানে হবে বোকার স্বর্গে বাস করা।

এখন এতগুলো জটিলতার ভিতর কোনভাবেই বলা সম্ভব নয় যে আট নভেম্বরের নির্বাচনে আসলে কী হতে যাচ্ছে। একের পর এক জরিপে বারংবার হিলারির বিজয়ের কথা বলা হলেও নির্বাচনী জরিপ নিয়ে গবেষণার ফলাফল থেকেই আমরা বলতে পারি যে, জরিপ যাই বলুক, শেষ মূহুর্তে ‘অপিনিয়ন লিডার’ বা মতমোড়লদের সিদ্ধান্ত একটি বড় ফ্যাক্টর হিসেবে উঠে আসতে পারে। যে কোন নির্বাচনেই ‘সুইং ভোট’-ই যেহেতু ফল নির্ধারণ করে দেয়, তাই ‘সুইং ভোট’-এর সমর্থন আদায় ও মতমোড়লদের দৃষ্টি আকর্ষণ যিনি করতে পারবেন তিনিই শেষ হাসি হাসবেন তা বলে দেয়া খুব সহজ। তাই এখন খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, মার্কিন সমাজে বর্তমানে যারা মতমোড়ল তারা কী ধরণের মানসিকতা লালন করেন তা অনুধাবনের চেষ্টা করা। ট্রাম্পের চিন্তা বা কর্মপরিকল্পনা, যা এখন পর্যন্ত তিনি বলেছেন, তার প্রতি যদি সেই মতমোড়লদের সমর্থন থাকে তাহলে এখন পর্যন্ত পরিচালিত যে কোন জরিপ যে কোন সময় বাতিল হয়ে যেতে পারে। তাই নির্বাচনের ফলাফল না দেখেই আমি বলে দিতে চাই না যে ডোনাল্ড ট্রাম্প হেরে গিয়েছেন। বরং ট্রাম্পের ইতিমিধ্যেই হেরে যাওয়া নিয়ে যে আলোচনা সেটিকে প্যারাডক্স হিসেবেই ধরে নিচ্ছি কিছু সময়ের জন্যে।

(দৈনিক ইত্তেফাক, ৮ম পাতা, ১৮ অক্টোবর, ২০১৬)

৩। ট্রাম্প কি হেরে গেলেন?

পশ্চিমা দেশগুলোর নির্বাচনী সংস্কৃতির যে দিকগুলোর প্রতি আমাদের আগ্রহ জন্মায় বা যেসব সংস্কৃতি আমরা আমাদের দেশেও দেখতে চাই তার তালিকা করা হলে নির্বাচনের প্রার্থীদের মুখোমুখি বিতর্ক আয়োজন করার বিষয়টি হয়ত বেশ উপরের দিকে থাকবে। যদিও আমাদের দেশে যে ধরণের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিদ্যমান, সেখানে এ ধরণের বিতর্কের আয়োজন করলে তার সমাপ্তি কোথায় এবং কিভাবে হবে আর সমাপ্তি হলে তা আদৌ শান্তিপূর্ণ হবে কিনা তা নিয়ে হাস্যরস কিংবা দুশ্চিন্তার অবকাশ থেকে যায়। সবচেয়ে বড় কথা হল, আমাদের দেশে এই ধরণের সংস্কৃতি গড়ে তোলার কোন প্রয়াস বা সেই প্রয়াসের কোন আভাস আমাদের সামনে নেই। তাই চলুন আরেকবার মিডিয়ার ‘এজেন্ডা সেটিং’-এর বলি হয়ে আমরাও হিলারি-ট্রাম্প নির্বাচনী বিতর্ক নিয়ে কথা বলি।

গত মঙ্গলবার ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনের প্রধান দুই প্রার্থীর ভিতর প্রথম বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। ধারণা করা হচ্ছে প্রায় ১০কোটি মার্কিন নাগরিক এই বিতর্ক উপভোগ করেছেন। দেশটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলেই হয়ত দেশ, কাল বা জতিসত্ত্বার সীমানা বিলীন করে আর সব দেশের মত আমাদের দেশেও বিতর্কের দিন এবং তার পরের দিন গণমাধ্যমগুলোর কনটেন্টের বড় স্থান জুড়ে ছিল এই বিতর্ক। বিতর্ক চলাকালীন চালানো জরিপ কিংবা বিতর্ক পরবর্তী জরিপ যাই বলি না কেন সকল জরিপেই এই বিতর্কে জয়ী হিসেবে ডেমোক্রেটিক দলের প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের নাম দেখা গিয়েছে। একই সাথে বিতর্কে খেই হারিয়ে ফেলা থেকে শুরু করে বক্তিগত আক্রমণ ও মেজাজ হারানোয় হয়ত এখন হতাশায় ভুগছেন ট্রাম্পের সমর্থকগণ। নির্বাচনের আগে আরো দুই দফা বিতর্ক এখনো বাকি। তারপরও প্রথম বিতর্কের ফলাফলের ভিত্তিতে যেই প্রশ্নটি উঠে আসছে বারংবার তা হল, ট্রাম্প কি হেরে গেলেন? নাকি হেরে যাচ্ছেন?

বছর দুয়েক আগেও ডোনাল্ড ট্রাম্পের রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়াকে অনেকে অসম্ভব ভেবেছেন। মার্কিনীরাই এটি ভেবেছেন। তারা ট্রাম্পকে নিয়ে হাসি-তামাশা করেছেন। কিন্তু ট্রাম্প এখন এমন এক বাস্তবতা নিয়ে হাজির হয়েছেন যেখানে তাকে নিয়ে হাসি-তামাশার অবসান না হলেও তাকে অস্বীকার করার আর কোন উপায় তিনি বাকি রাখেন নি। যুদ্ধের পক্ষে নিজের অবস্থান, নারীদের প্রতি কটুক্তি, অভিবাসন ও অন্যধর্মের প্রতি বিরোধী মনোভাবের কারণে নিন্দিত হয়েছেন বলেই কি আমরা সুদূর বাংলাদেশে বসেও ডোনাল্ড ট্রাম্প নামক এই স্বর্ণকেশীকে অপছন্দ করি? উত্তরটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয়ত ‘হ্যা’ হবে। কিন্তু তারপরও কথা থেকে যায়। ট্রাম্পের এসব নীতির বিপক্ষে সমালোচনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই তো কম হয় নি। তারপরও ট্রাম্প অন্যান্য মনোনয়ন প্রত্যাশীদের পিছনে ফেলে রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হয়ে গিয়েছেন। তবে এর ভিতর অনেকে ষড়যন্ত্র তত্ত্বও হয়ত খুঁজে পান। যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী একজন বাংলাদেশী আমাকে বলেছিলেন ট্রাম্পের সাথে হিলারির সুসম্পর্ক বেশ পুরনো এবং ট্রাম্প হিলারিকে প্রেসিডেন্ট করার জন্যেই রিপাবলিকান মনোনয়ন প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন। এর প্রমাণ হিসেবে তিনি বলেছিলেন যে, মনোনয়ন নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পর ট্রাম্পকে আর আগের মত আক্রমণাত্মক হতে দেখা যায় নি খুব বেশি। এটি নিছক কল্পনাপ্রসূতও হতে পারে। কিন্তু অকাট্য সত্য হল, ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন নাগরিকদের ‘পালস’ বুঝে তার মতামত প্রচার করেছেন। সম্প্রতি যুক্তরষ্ট্রের যে বাস্তবতা তাতে দেখা যায় যে, যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসিত নাগরিকদের সংখ্যা আর অল্প সময়ের ভিতর যারা প্রকৃতপক্ষেই মার্কিন নাগরিক তাদের চেয়ে বেড়ে যাবে। ফলে নিজেদের দেশে মার্কিন নাগরিকরাই হয়ে যাবেন এক ধরণের সংখ্যালঘু গোষ্ঠী। এসবের সাথে সাথে নিয়ত বর্ধমান অভিবাসীদের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক সেবার মানও আগের মত থাকছে না যা স্পষ্টভাবেই মার্কিন নাগরিকদের চোখে পড়ছে। অভিবাসন বিরোধীতার হুজুগ তুলে যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে বেরিয়া আসা (ব্রেক্সিট) ডোনাল্ড ট্রাম্পের পালেই হাওয়া দিয়েছে বলে তখনই মনে হয়েছিল।

আমি মূলত বলতে চাচ্ছি যে, চিলকট কমিশন যতই বলুক ইরাক যুদ্ধ ছিল অপ্রয়োজনীয় কিংবা যুদ্ধটি ছিল যুদ্ধাপরাধ, মার্কিন নাগরিকদের ইরাক নিয়ে চিন্তার আগে নিজেদের মৌলিক বিষয়াদি নিয়ে চিন্তাই বেশি। এটি শুধু মার্কিন নাগরিক নয় বরং সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। সেক্ষেত্রে অভিবাসন বিরোধী মনোভাব এবং চলমান বাস্তবতায় অন্য ধর্ম, মূলত ইসলাম বিদ্বেষ প্রকাশ করে ট্রাম্প নিজেকে অনেক মার্কিনীর কাছে নিয়ে গিয়েছেন তা স্বীকার করতেই হবে।

অন্যদিকে ট্রাম্প বা হিলারি কারো বিজয়েই আমি খুশি বা অসন্তুষ্ট হবো না ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ পর্যন্ত আমি জানতে পারবো না যে কে প্রেসিডেন্ট হলে সিরিয়ায় আর ওমরান দাকনিশকে রক্তাক্ত দেখতে হবে না, কে প্রেসিডেন্ট হলে মৃত পড়ে না থেকে নিজের দেশের সমুদ্র সৈকতে খেলতে দেখা যাবে আয়লান কুর্দিকে, কে প্রেসিডেন্ট হলে নিজের স্বার্থে হাজার হাজার সাধারণ মানুষের জীবন শেষ করে দেয়া হবে না। ডেমোক্রেট পার্টীর প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন সময়েই এসব ঘটনা ঘটেছে তাই হিলারি আসলে এর পরিবর্তনের তেমন কোন সুযোগ বা আভাস এখনো দেখা যায় নি। আর ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্য শুনে এসব আশা করাই অপরাধ বলে মনে হতে পারে। বিশ্বশান্তির জন্যে যে ধরণের মানবিকতা বোধসম্পন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রয়োজন সে ধরণের প্রার্থী এই নির্বাচনে আদৌ আছেন কিনা তা নিয়েই আলাদা বিতর্ক চলতে পারে।

ট্রাম্পের প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। আমার মনে হয় না প্রথম বিতর্কে হেরে গিয়েছেন বা পিঁছিয়ে পড়েছেন বলে ট্রাম্পের বিজয়ের সম্ভাবনা কমে গিয়েছে। ২০০৮ ও ২০১২ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচন নিয়ে অত্যন্ত সফল ভবিষ্যদ্বাণী করা মার্কিন প্রতিষ্ঠান ‘ফাইভ থার্টি এইট’ এ বছর হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এটি ঠিক যে ব্যাপক সংখ্যক মার্কিন নাগরিক ট্রাম্পের উপর বিরক্ত। তিনি নির্বাচিত হলে সেটিও হয়ত আশ্চর্য কিছু হবে অনেকের কাছে। কিন্তু আশ্চর্য বিষয়ের ভিতরই তো আমরা প্রতিনিয়ত ঘুরপাক খাচ্ছি। মার্কিন নির্বাচন পদ্ধতিতে ছোট ছোট অঙ্গরাজ্যগুলোর ফলাফল বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নিরপেক্ষ ভোটারদের সমর্থন। নিরপেক্ষ ভোটারদের মতামতও যদি অভিবাসন বিরোধী কিংবা ইসলাম বিদ্বেষী হয়ে থাকে, তাহলে ট্রাম্পের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। তাই এখনই বলতে রাজি নই যে ট্রাম্প হেরে গিয়েছেন। বরং হোয়াইট হাউজে এই স্বর্ণকেশীকে চার বছরের জন্যে প্রবেশ করতে দেখলেও খুব বেশি অবাক হওয়ার কিছু নেই।

(দৈনিক ইত্তেফাক, ৮ম পাতা, ০৬ অক্টোবর, ২০১৬)

৪। ব্রেক্সিটের রাজনৈতিক বার্তা

ব্রেক্সিট শেষ পর্যন্ত হয়েই গেলো। যুক্তরাজ্যের ৫২ শতাংশ মানুষ ইউরোপিয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে আসার পক্ষে রায় দিলেন ২৩ জুনের ঐতিহাসিক গণভোটে। বৈশ্বিক পুঁজিবাজারের সাথে সাথে বিশ্ব গণমাধ্যমও এখন ব্রেক্সিট ঝড়ে ধুঁকছে। এজেন্ডা সেটিংস-এর সহজ শিকার আমিও তাই বারংবার অনুসরণ করছিলাম ব্রেক্সিট সংক্রান্ত আলোচনাগুলো। ব্রেক্সিটের ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে কী পরিবর্তন আসবে কিংবা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্যে তার ফলাফল কেমন হবে তা বুঝতে পারার তাত্ত্বিক অর্থনৈতিক জ্ঞান আমার পর্যাপ্ত নয়, ইচ্ছাও আছে কিনা সেটি নিয়েও ভিন্ন পরিসরে আলোচনা হতে পারে। আমার আগ্রহের পুরোটা জুড়েই আছে ব্রেক্সিটের ফলে রাজনৈতিক মহলের পটপরিবর্তনগুলো।

ব্রেক্সিট সংক্রান্ত গণভোটের আগের জনমত জরিপগুলো বলছিলো শেষমূহুর্তে উভয় পক্ষের পক্ষে প্রায় ৪৪ শতাংশ সমর্থনের কথা। এ থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিলো যে সিদ্ধান্ত নিতে না পারা ১২ শতাংশ ভোটারের ভোটই নির্ধারণ করে দিবে যুক্তরাজ্যের ইইউ ভাগ্য। তবে ২০১৫ সালের জাতীয় নির্বাচনে জনমত জরিপের ফলাফলের বিপরীত ফল হওয়ায় এসব জনমত জরিপকে বিশ্বাস করা যায় কিনা সেই সন্দেহ নিয়েই এগুলোকে মস্তিষ্কে স্থান দিয়েছি তা অস্বীকার করা যাবে না। তবে গণভোটের ফলাফলে জরিপ সংস্থাগুলোর উপর হয়ত যুক্তরাজ্যের মানুষের আস্থা আবারও ফিরে আসলো বা আসবে। তবে মজার বিষয় হল এই গণভোটে ভোটারদের ২৮ শতাংশ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন নি, আর দুই পক্ষের ভোটের ব্যবধান মাত্র ১৩ লাখ; দিনশেষে এই পরিসংখ্যান গণতন্ত্রের দুর্বল দিকটিকেই প্রকাশ করে গেলো। ভোটের ফলাফলে এও দেখা গেলো যে, মূলত বয়স্ক ভোটারগণ ব্রেক্সিটের পক্ষে ভোট দিয়েছেন যেখানে তরুনরা থেকে যেতে চেয়েছিলেন ইইউতে। তাই ভোটের ফলাফল তরুনদের জন্যে হতাশাজনক কারণ তারা কোন বাস্তবতায় জীবন কাটাবেন তা ঠিক করে গেলো তাদের পূর্বজগণ।

গণভোটে ব্রেক্সিটের পক্ষে রায় আসার পরই যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু ব্রেক্সিট ঝড়ের পর আসন্ন ঘটনা হিসেবে উদ্ভূত হয়েছে যুক্তরাজ্য থেকে স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার বিষয়টি। গণভোটের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে স্কটল্যান্ড ও নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের ৬০ ভাগ ভোটার ব্রেক্সিটের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছেন। অন্যদিকে ওয়েলস ও ইংল্যান্ডের সিংহভাগ ভোটার ছিলেন ব্রেক্সিটের পক্ষে। এর ফলে ২০১৪ সালে স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার প্রশ্নটি গণভোটের মাধ্যমে প্রশমিত হলেও তা আবার মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠবে বলে মনে হয়। আবার স্কটল্যান্ড স্বাধীনতা পেয়ে গেলে নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড কিংবা ওয়েলসও ঐ একই পথ অনুসরণ করবে না তা বলা যায় না। সে ক্ষেত্রে ইইউর ভাঙন যুক্তরাজ্যের ভাঙনকে তরান্বীত করবে।

যুক্তরাজ্য থেকে বেরিয়ে এবার যদি ইউরোপের দিকে তাকাই তাহলে দেখা যাবে, ব্রেক্সিটের ফলে ইতিমধ্যেই ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ডানপন্থী উগ্র জাতীয়তাবাদী দলগুলো ইইউতে থাকার প্রশ্নে তাদের দেশে অনুরূপ গণভোটের ডাক দিয়েছেন। সামগ্রিকভাবে অভিবাসন প্রশ্নই ব্রেক্সিটের মূল হয়ে দাঁড়িয়েছে তা বলাই বাহুল্য। একই কথা বাকি ইউরোপের বেলাতেও সত্যি। তথাকথিত অনুন্নত ও ৩য় বিশ্বের মানুষ নিরাপদ জীবনের খোঁজে ইউরোপ ও পাশ্চাত্যে গিয়েছে, উত্তর-উপনিবেশকালে এটি একটি বাস্তবতা। এর ফলে পশ্চিমা দেশগুলোতে সৃষ্ট সামাজিক সংকট, যা মূলত সরকার প্রদত্ত নাগরিক সুবিধা এবং জীবিকার সংকট হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে তা ঘনীভূত হয়েছে এবং ঘনীভূত হতে থেকেছে। কিন্তু পুরো বিষয়টি নতুন করে ইউরোপের মূল বাসিন্দাদের সামনে এসেছে নতুন করে শুরু হওয়া শরণার্থী সংকটের ফলে। এই বিপুল পরিমাণ শরণার্থীকে গ্রহণ কিংবা বর্জন বিতর্কের সাথে সাথে যারা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে তাদের দেশে মূল নাগরিকদের বিভিন্ন সুবিধা সংকোচন এবং অনেক ক্ষেত্রে শরণার্থীদের দ্বারা সৃষ্ট বিভিন্ন অপ্রীতিকর ঘটনার ফলে পুরো পাশ্চাত্যেই অভিবাসনবিরোধী মনোভাব প্রকট হয়েছে এবং হচ্ছে। ব্রেক্সিটের ফলে অভিবাসনের পক্ষে থাকা সরকারগুলো একটু হলেও নড়ে-চড়ে বসেছেন কিংবা বসবেন এবং নিজেদের অভিবাসন নীতিতে পরিবর্তন আনবেন কিংবা আনার কথা ভাববেন তা নিশ্চিত। যদি ব্রেক্সিটের ধারাবাহিকতায় ইইউ-এর আরো কিছু সদস্য রাষ্ট্র ইইউ থেকে বের হয়ে যায় তাহলে আমি মোটেও অবাক হবো না। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের আইএস সংক্রান্ত প্রভাবের ফলে ইউরোপে সৃষ্ট শরণার্থী সংকটের ফলে ইইউ এর ভাঙন যে খুব সাধারন নয় বরং জটিল রাজনৈতিক ক্রিয়া-মিথষ্ক্রিয়ার ফলাফল তা নিয়ে ভাবতে হবে বারংবার।

চলুন আবার যুক্তরাজ্যে ফিরে যাই। যুক্তরাজ্যবিরোধী অনেকেই ব্রেক্সিটকে চিহ্নিত করেছেন যুক্তরাজ্যের ইইউকে ব্যবহারের একটি প্রক্রিয়া হিসেবে। তারা বলতে চান ১৯৭০ এর দশকে নিজের ভঙ্গুর অর্থনীতিকে রক্ষার জন্যে যুক্তরাজ্য ইইউ-এর সাথে  নিজেকে যুক্ত করে। ৪৩ বছরে নিজের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার পর এখন যখন আর যুক্তরাজ্যের ইইউ-এর প্রয়োজন নেই তখন তারা গণভোটের মাধ্যমে বেরিয়ে এলো ইইউ থেকে। এই ষড়যন্ত্রতত্ত্বকে দূরে সরিয়ে রেখে আসুন যুক্তরাজ্য রাষ্ট্র হিসেবে কোন প্রকারভেদে পড়ে তা নিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলি। স্যামুয়েল পি হান্টিংটন তাঁর ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশনসে চার ধরণের রাষ্ট্রের কথা বলেছিলেন। প্রথমত, কোর রাষ্ট্র; যারা কোন একটি সভ্যতার মূল হিসেবে থাকে। দ্বিতীয়ত, ফাটলরেখার রাষ্ট্র; যেসব রাষ্ট্রে একাধিক সভ্যতা রয়েছে এবং সভ্যতার সংঘাতে এসব রাষ্ট্র খন্ডিত হতে পারে। তৃতীয়ত, একাকী রাষ্ট্র; যে রাষ্ট্রের মত সভ্যতা পৃথিবীর আর কোথাও নেই। আর সর্বশেষ ছিন্ন রাষ্ট্র, যারা নিজেদের চরিত্র পরিবর্তন করে। হান্টিংটন ১৯৯৬ সালে তাঁর বই প্রকাশ হওয়ার সময় ছিন্নরাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন রাশিয়া, তুরস্ক, অস্ট্রেলিয়া এবং মেক্সিকোকে। কেন এগুলোকে চিহ্নিত করেছিলেন ছিন্নরাষ্ট্র হিসেবে সেই আলোচনায় না গিয়ে যুক্তরাজ্যেই আলাপ সীমিত রাখতে চাই। যুক্তরাজ্য গত ৪৩ বছর ইইউতে থেকেও অভিন্ন মুদ্রা ব্যবস্থা ইউরো গ্রহণ না করে পাউন্ড স্টার্লিং-কে সক্রিয় রেখেছে, গ্রহণ করেনি ইইউ এর ভিসা ব্যবস্থাও। আবার ভৌগলিকভাবে যুক্তরাজ্যকে ইউরোপ হসেবে স্বীকৃতির প্রশ্নেও দ্বিধাবিভক্তি রয়েছে। এসব পার্থক্যের পরও ইইউ-এর সাথে থাকার জন্যে যুক্তরাজ্যকে ইউরোপের অংশ হিসেবেই মনে হয়েছে এতদিন। কিন্তু ব্রেক্সিটের ফলে যুক্তরাজ্য কি আরেকটি ছিন্নরাষ্ট্রে পরিণত হলো কিনা তা নিয়ে ভেবে দেখার সময় হয়ে গিয়েছে। একইসাথে ব্রেক্সিটের ফলে যদি এক ইউরোপের ধারণায় ফাটল সৃষ্টি হয় এবং ফাটল তরান্বীত হয় অর্থাৎ আরো কিছু রাষ্ট্র যদি ইইউ থেকে বেরিয়ে যায় আর যদি শেষ পর্যন্ত জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্স ও স্পেনকে কেন্দ্র করে ইউরোপ থাকে তাহলে বলতেই হবে যে, হান্টিংটনের ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশনে আপনাকে স্বাগতম!

ইউরোপের আলোচনায় একঘেয়ামি লাগলে আসুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চোখ ফেরাই। এটি স্পষ্ট যে ইইউ থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে যাওয়ার ফলে যুক্তরাষ্ট্র তার পরীক্ষিত মিত্র যুক্তরাজ্যের মাধ্যমে ইইউকে নিজের প্রভাব বলয়ে রাখার চিন্তাটি আর করতে পারবে না। কিন্তু আমি অন্য বিষয় নিয়ে ভাবতে চাচ্ছি। মূলত একটি ওয়াইল্ড গেস করে লেখাটি শেষ করি চলুন। ব্রেক্সিটের ফলে ইউরোপে কোন পরিবর্তন আসুক বা না আসুক, আমার ধারণা এর সবচেয়ে বড় ফলাফল পরিলক্ষিত হবে মার্কিন প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে। এ বছরের নভেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য এই নির্বাচনে বিভিন্ন জরিপে হিলারি ক্লিনটনের চেয়ে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প এখনো পিঁছিয়ে থাকলেও অভিবাসনবিরোধিতাকে সামনে রেখে ব্রেক্সিটের পক্ষে যুক্তরাজ্যের জনগণের রায় এবং ট্রাম্পের অভিনাসনবিরোধী এজেন্ডা কিংবা প্রোপাগান্ডা মিলেমিশে যদি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমাদের সামনে হাজির করে তাহলে মোটেই অবাক হবো না। আখেড়ে, সবই তো প্রোপাগান্ডার ফলাফল!

(দৈনিক বণিক বার্তা, ৪র্থ পাতা, ২৮ জুন, ২০১৬)

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।