শিবলী নোমান

সাম্প্রতিককালের সাংবাদিকতার শিক্ষকগণ

শিবলী নোমান

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়ালেখার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদেরকে স্ব স্ব বিষয়সংশ্লিষ্ট কর্মক্ষেত্রের সাথে পরিচিত করানোর একটি সাধারণ চর্চা আমরা দেখে থাকি। উদাহরণ হিসেবে সাংবাদিকতার শিক্ষার্থীদের সাথে দেশের প্রথিতযশা সাংবাদিকদের আলাপের সুযোগ করে দেয়ার কথা বলা যেতে পারে।

শিক্ষার্থীদের সাথে কর্মক্ষেত্রে অভিজ্ঞজনদের এই যোগাযোগে যে বিষয়টি প্রায়ই সামনে চলে আসে তা হলো, কর্মক্ষেত্রের মানুষরা বলতে চান শ্রেণিকক্ষে যা বলা হয়, বা বইতে যা লেখা থাকে, তার সাথে কর্মক্ষেত্রের ব্যবহারিক চর্চার রয়েছে যোজন যোজন দূরত্ব। বিদ্যায়তনিক চর্চাকে অপ্রয়োজনীয় হিসেবে উপস্থাপনের ইচ্ছা থেকেই হোক, কিংবা বাস্তবতা সম্পর্কে ধারণা প্রদানের কামনা থেকেই হোক, এই দাবিকে পুরোপুরি ফেলে দেয়া কোনভাবেই সম্ভব নয় বলেই মনে করি। অর্থাৎ, এই যে কর্মক্ষেত্রের অভিজ্ঞ মানুষদের আলাপচারিতা, এগুলোকে সাংবাদিকতা শিক্ষারই একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে ধরে নেয়া উচিত।

তবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইদানিং আমরা আরো অনেক সাংবাদিকতার শিক্ষকের দেখা পাই। মজার বিষয় হলো, এই শিক্ষকগণ শুধু শিক্ষার্থীদেরই নয়, নিয়মিত ভিত্তিতে খোদ সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষকদেরও সাংবাদিকতা চর্চা ও সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতা শেখান, বা শেখাতে চান।

এই যেমন, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যোগদানের পরপরই অপর এক বিভাগের শিক্ষককে দেখলাম সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থীদেরকে সাংবাদিকতা কীভাবে করতে হবে তা বলে দিচ্ছেন। মজার বিষয় হলো, সেই শিক্ষক তখন বসেছিলেন সাংবাদিকতা বিভাগেরই সভাপতির কক্ষে, সাংবাদিকতার কতিপয় শিক্ষকসমেত। সেই সময় সাংবাদিকতা বিভাগের সভাপতি এরূপ অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে দারুণ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন।

আমি জানি না ব্যাপারটি শুধু আমারই অস্বাভাবিক ঠেকছে কিনা, কিন্তু ধরুন চারুকলার একজন শিক্ষকের কক্ষে বসে নিজের কোন পড়ালেখা বা অভিজ্ঞতা না থাকার পরও চারুকলা বিভাগেরই শিক্ষার্থীদেরকে এক্সপ্রেশনিস্ট আর্ট সম্পর্কে জ্ঞান দিতে যাওয়া আমার কাছে খুবই অস্বাভাবিক একটি বিষয় মনে হয়।

আরেকটি স্মৃতিচারণ করা যেতে পারে। একদিন দুপুরে বিভাগের সকল শিক্ষক একসাথে দুপুরের খাওয়ার জন্য মাত্র বসেছিলাম। সেই মুহূর্তে বিভাগের সভাপতিকে ফোন দিয়ে সকল শিক্ষকসমেত তলব করা হলো। এরপর ফোনের পর ফোন, বাধ্য হয়ে বিভাগের সভাপতি না খেয়েই ছুটে গেলেন, যেন বাকি শিক্ষকরা হাতে কিছুটা সময় পান খাওয়া শেষ করার।

এক্ষেত্রে ঘটনার সূত্রপাত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মহোদয়ের সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন সাংবাদিকের ‘আপত্তিকর’ প্রশ্ন থেকে। সেখানেও বিভিন্ন বিভাগের উপস্থিত শিক্ষকগণ সাংবাদিকতা বিভাগের সকল শিক্ষককে সাংবাদিকতা বিভাগের দুইজন শিক্ষার্থীর সামনে বেশ সাংবাদিকতা শিখিয়েছিলেন।

মজার বিষয় হলো, সেই সময় আমি রিপোর্টিং-এর একটি কোর্স নিচ্ছিলাম, এবং ঐ দুই বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিকের একজন আমার ঐ কোর্সের শিক্ষার্থী ছিলেন। আর কিছুদিন আগেই একটি ক্লাসে সাক্ষাৎকার গ্রহণের কৌশল হিসেবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি সবার শেষে করার কথাটি বলেছিলাম।

যারা আমাদের সেদিন ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন, তাদের ভাষ্য থেকেই জেনেছিলাম যে প্রথম দিকে তাদের মতে বিষয়টি ‘খুব সুন্দরভাবে’ এগোচ্ছিল, শেষ মুহূর্তে ‘কী জানি’ হয়ে যাওয়ায় ‘আপত্তিকর’ প্রশ্ন করে ফেলেছিল সংবাদকর্মী দুইজন। অর্থাৎ শ্রেণিকক্ষের পড়ালেখা থেকে জেনে হোক বা অন্য কোন পন্থায়, সেই সাংবাদিকদের কৌশলটি ভুল ছিল না।

ঐদিন আবার আমি মাল্টিডিসিপ্লিনারি অ্যাকাডেমিক চর্চার স্বাদও পেয়েছিলাম। কারণ সাংবাদিকদের কীভাবে সাক্ষাৎকার নিতে হবে, সেই সবক দিতে গিয়ে আমাদের যা বলা হয়েছিল, তা মূলত ছিল এথনোগ্রাফিক কাজের জন্য নেয়া সাক্ষাৎকারের অনুরূপ।

সে যাই হোক, সেদিনের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় ভুলে গিয়েছিল যে, তাদের কাছে দুইজন সাংবাদিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদকের পরিচয়ে সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলেন। কোন নির্দিষ্ট বিভাগের শিক্ষার্থী পরিচয়ে নয়। দ্বিতীয়ত, ঘটনাচক্রে তারা দুইজন সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন বলে সাংবাদিকতার শিক্ষকদের ডেকে নিয়ে যেভাবে সাংবাদিকতা শেখানো হয়েছিল, ঐ সাংবাদিকরা অন্য বিভাগের শিক্ষার্থী হলে সে শিক্ষা কাদের দেয়া হতো, বা আদৌ দেয়া হতো কিনা তাও ভাবার বিষয়। আর নিজ বিভাগের শিক্ষার্থীদের সামনে শিক্ষকদের যেভাবে বেইজ্জত করা হয়েছিল, সেই কথা না হয় আজ তোলাই থাকলো।

এর মধ্যে আজ আবার নতুন যে ঘটনা দেখলাম তা হলো, এবার আর একজন বা কতিপয় ব্যক্তি নয়, বরং একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো শিক্ষক সমিতি কোন্‌ গণমাধ্যমের সাংবাদিকতার চর্চা সঠিক, আর কোন্‌টির ভুল তা নির্ধারণে নেমে পড়েছেন। আমি আসলে এমন বিবৃতি আরো অনেকগুলো আশা করছি।

বিদ্যায়তনের মতো স্থানেও কেন সবাই সাংবাদিকতার শিক্ষক বনে যান, তার পেছনের কারণটি খুব সরল। কারণ সকল সংবাদে অন্তত দুইটি পক্ষ থাকে, আর থাকে মানুষের ভালো ও খারাপ স্বার্থের উপস্থিতি।

তার চেয়ে এই লেখার পাঠকদের বলি, সব ভুলে দুইটি উপন্যাস পড়ে বা পুনরায় পড়ে সময় কাটাতে পারেন, আহমদ ছফার গাভী বিত্তান্ত আর মুহম্মদ জাফর ইকবালের মহব্বত আলীর একদিন

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।