শিবলী নোমান

বিয়ের বয়স: সর্বোত্তম স্বার্থে ঐক্য প্রয়োজন

শিবলী নোমান

বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করতে ১৯২৯ সালের আইনটিকে যুগোপযোগী করতে ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৩’-এর খসড়া প্রণীত হয়েছিল। মূলত ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ১৯২৯ (সংশোধিত ১৯৮৪)’-এর শাস্তির বিধানগুলো বৃদ্ধি করে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে জনসচেতনতা তৈরির প্রয়াস নেয়া হয়েছিল এর মাধ্যমে। তবে ২০১৬ সাল প্রায় শেষ হয়ে গেলেও এই আইনটি এখনো মন্ত্রীসভায় চূড়ান্তভাবে পাস হতে পারে নি। এই আইন পাস হওয়ার আগেই বারবার এই আইন নিয়ে কথা বলার উপলক্ষ্য তৈরি হয়েছে।

২০১৪ সালে প্রথম এই আইনটি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে আইনের খসড়া নীতিগতভাবে অনুমোদিত হওয়ার সাথে সাথে বিয়ের ন্যুনতম বয়স মেয়েদের ক্ষেত্রে ১৬ ও ছেলেদের ক্ষেত্রে ১৮ বছর করা যায় কিনা সে বিষয়ে পর্যালোচনার কথা বলা হয়েছিল। তখনই এর প্রতিবাদ করে শিশু ও মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠনগুলো। ধারাবাহিক প্রতিবাদ, বিয়ের বয়স না কমানোর অনুরোধ ও এক ধরণের চাপের মুখেই তখন সরকারের পকশ থেকে বিয়ের বয়স কমানো হবে না বলে জানানো হয়। পরবর্তীতে কখনো ‘মা-বাবা চাইলে’, কখনো ‘বিশেষ পরিস্থিতিতে’ মেয়েদের বিয়ে ১৮ বছরের আগেই দেয়া যাবে এমন বিধান এই আইনে রাখা হয়েছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৫ থেকে ২০২১ সালের জন্যে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্তরণালয় বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে যে কর্মপরিকল্পনার খসড়া ২০১৫ সালে তৈরি করে সেখানেও বিয়ের বয়স স্পষ্ট না করে ‘আইনসম্মত বয়স’ কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে।

সর্বশেষ ২২ নভেম্বর’১৬ তারিখে জাতীয় দৈনিকে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে যে, মেয়েদের বিয়ের ক্ষেত্রে ন্যুনতম বয়স ১৮ বছরই থাকছে, তবে বিশেষ কোন পরিস্থিতিতে মেয়েদের ‘সর্বোত্তম স্বার্থ’ বিবেচনায় এই বয়স কমতে পারে এমন বিধানও আইনে রাখা হয়েছে।

এর ফলে সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাবটি হবে এই যে, মেয়েদের বিয়ের বয়সের ক্ষেত্রে ১৮ বছরটি আসলে একটি ‘কাগুজে সংখ্যা’-য় পরিণত হবে, কারণ আইনে বিশেষ ধারা করে বিয়ের ন্যুনতম বয়সের চেয়ে কম বয়সে বিয়ে দিলেও শাস্তি থেকে বাঁচার রক্ষাকবচ রাখা হচ্ছে। আমাদের দেশে কঠোর আইনের ফাঁক গলেও অনেক বড় বড় আসামী বের হয়ে যায়, সেখানে আইনের ভিতরই যদি বিশেষ ধারা করে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়ের বিয়ের ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয় রাখা হয় তাহলে কিভাবে বাল্যবিবাহ এই আইন দ্বারা বন্ধ করা যাবে?

১৮ বছরের আগে মেয়েদের বিয়ের ক্ষেত্রে মেয়ে কিংবা মায়ের স্বাস্থ্য ও শিশুর স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা আপাতত বাদই থাকুক। এসব নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। কিন্তু মূল কথা হল, আইনে কী থাকছে তা কেন স্পষ্ট করা হচ্ছে না? ‘বিশেষ পরিস্থিতি’ বা ‘সর্বোত্তম স্বার্থ’ বলতে কী বুঝতে হবে, অর্থাৎ এর সংজ্ঞায়ন কেন স্পষ্ট করা হচ্ছে না? যে কোন আইনে একটি আলাদা অধ্যায় থাকে বিভিন্ন প্রত্যয় সংজ্ঞায়নের জন্যে, তাহলে বাল্যবিবাহের মত স্পর্শকাতর বিষয়ে এই সংজ্ঞায়ন কেন এখনো স্পষ্ট করা হচ্ছে না?

বাল্যবিবাহ এমন একটি সমস্যা যা সরকারের একার পক্ষে সমাধান করা সম্ভব নয়। জনসচেতনতা, সামাজিক প্রতিরোধ ও গণঐক্যের মাধ্যমেই এই অভিশাপ থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব। ২০১৬ সালের হিসাব অনুযায়ী বিশ্বে বাল্যবিবাহের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ৬ষ্ঠ, দক্ষিণ এশিয়ার ভিতর প্রথম। বিশ্বে প্রতিবছর ১৫ মিলিয়ন মেয়ের বিয়ে হচ্ছে ১৮ বছরের আগেই। প্রতি মিনিটে ২৮ জন এবং প্রতি দুই সেকেন্ডে ১ জন মেয়ে বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে। ২০১৬ সালে যখন বাল্যবিবাহের পরিসংখ্যান এমনই ভয়াবহ তখন কি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের আইনে ১৮ বছরের আগে বিয়ের কোন বিশেষ বিধান রেখে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ আসলেই সম্ভব?

এখানে সরকারের সাথে মতবিরোধকে উসকে দেয়া নয়, বরং সরকারের সাথে পরামর্শের বিষয়টি সামনে আসা উচিত। মাতৃস্বাস্থ্য উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়নে মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল (এমডিজি) ও সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলের (এসডিজি) ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উন্নতি লাভ করেছে সরকারের নজরদারি ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের ফলেই। কিন্তু আইন কঠোর করে শাস্তির বিধান বাড়িয়েই সমাধান করার মত সমস্যা বাল্যবিবাহ নয়। এর সাথে জড়িয়ে আছে সমাজের বিশ্বাস ও মূল্যবোধের বিষয়টি। তাই বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কঠোর আইন করতে হলে সেই আইনে কোন বিশেষ ধারা করে বিয়ের ন্যুনতম বয়স কমানোর বিধান থাকলে আইনটির অপব্যবহার হওয়ার সুযোগ অনেক বেশি বেড়ে যাবে এবং আইনের ফলাফল হিতে বিপরীত হবে।

আবার সরকার যেমন বাল্যবিবাহ বন্ধে বদ্ধপরিকর, তেমনি শিশু ও মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠণগুলোও এ বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু এই আইনের বিভিন্ন বিষয় স্পষ্ট না করায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই, মূলত মেয়েদের বিয়ের ন্যুনতম বয়সের ক্ষেত্রে সরকার ও এসব সংগঠন প্রায়ই মুখোমুখি অবস্থানে চলে যাচ্ছে। কিন্তু বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে এই দুই পক্ষের একে অপরের প্রতি নির্ভরশীল ও সহযোগিতামূলক আচরণ অপরিহার্য। তাই বাংলাদেশ থেকে বাল্যবিবাহ নির্মূলই হোক ‘সর্বোত্তম স্বার্থ’, আর ‘সর্বোত্তম স্বার্থ’-র কারণেই গঠিত হোক ঐক্য।

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।