শিবলী নোমান

ক্যাস্ত্রো ও বাংলাদেশ

শিবলী নোমান

কিউবায় ১৯৫৯ সালে সমাজতান্ত্রিক বিল্পবের সফলতার পর বারবার এই বিপ্লব ও বিপ্লবী সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণের চেষ্টা করা হয়েছে। চেষ্টা করা হয়েছে বিপ্লবের মূল শক্তিগুলোকে সরিয়ে দেয়ার। কিউবা বিপ্লবের নেতা ফিদেল ক্যস্ত্রোকে হত্যার জন্যে বারবার চেষ্টা করা হয়েছে। ক্যাস্ত্রোকে হত্যার কোন চেষ্টাই বাকি রাখে নি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। দাঁড়িতে জীবাণু সংক্রমণের মাধ্যমে ক্যাস্ত্রোকে হত্যার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে ক্যাস্ত্রোর সাবেক স্ত্রী মিরতা ডিয়াজ-বালার্তকে পাঠানো হয়েছিল। এসময় বিষয়টি জানাজানি হলে ক্যাস্ত্রো বলেছিলেন তাকে জীবাণু দিয়ে নয়, মিরতা যেন তাঁকে গুলি করে হত্যা করে। মিরতাকে পিস্তলও দেয়া হয়েছিল। মিরতা গুলি করতে পারেন নি, বলেছিলেন, “আই ক্যান্ট।” ক্যাস্ত্রো হেসে বলেছিলেন, “অফকোর্স ইউ ক্যান্ট। নোবডি ক্যান।”

আমি জানি না ফিদেল ক্যাস্ত্রো কথাটি সচেতনভাবে বলেছিলেন কিনা। কিন্তু তিনি তাঁর এই কথা রেখেছেন। ২০১৬ সালে ৯০ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন বার্ধক্যজনিত স্বাভাবিক কারণে। সিআইএ বা মার্কিন মদদপুষ্ট কোন গোষ্ঠী তাঁকে হত্যার গৌরব(!) অর্জন করতে পারে নি। ফিদেল ক্যাস্ত্রোই সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র রাষ্ট্রনায়ক যাকে ৫০ বছরের ভিতর অন্তত ৬৩৮বার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে এবং প্রতিবার সেই চেষ্টাগুলো ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। কিউবা বিপ্লবের পর ডেমোক্র্যাট বা রিপাবলিকান, প্রেসিডেন্ট যেই হোক, সবাই চেয়েছেন ফিদেল ক্যাস্ত্রোকে সরিয়ে দিতে। কিন্তু ফিদেল ক্যাস্ত্রোকে সরানো যায় ন। ইতিহাস বলছে ফিদেলের রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পালন করা সময়ে ২০০০ সাল পর্যন্ত আইজেনহাওয়ার থেকে বিল ক্লিনটন পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বদল হয়েছে আটবার। জর্জ ডব্লিউ বুশ জুনিয়রকে ধরলে হিসাবটা হবে নয়বার।

মূলত বিপ্লবের পর কিউবায় ব্যাপক জাতীয়করণের ফলে মার্কিন বাণিজ্যিক স্বার্থ ব্যাপক বিপর্যয়ের মুখে পড়লে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বারংবার এই বিপ্লবকে ব্যর্থ করার চেষ্টা করে। কখনো প্রবাসী কিউবানদের মাধ্যমে, কখনো কিউবার বিমানে বোমা হামলায় মদদ দিয়ে, কিংবা কখনো ক্যাস্ত্রোর সহযোগিদের হত্যা করে। বলিভিয়ায় চে গেভারাকে হত্যা করা হয় সিআইএ-র প্রত্যক্ষ মদদে। কিন্তু এরপরও কিউবার এগিয়ে যাওয়া থেমে থাকে নি। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় এবং খাদ্য ইৎপাদন ও বন্টনে কিউবা এতটাই স্বয়ংসম্পূর্ণ হয় যে এখনো তা যে কোন দেশের জন্যে মডেল।

কিউবার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব মার্কিন পুঁজিবাদের মদদপুষ্ট সরকারের বৈষম্য থেকে জনগণকে মুক্ত করার প্রয়াস ছিল বলেই হয়ত বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রতিও ফিদেল ক্যাস্ত্রোর ছিল অপার শ্রদ্ধা। কারণ বাংলাদেশের মানুষও পশ্চিম পাকিস্তানের ২৩ বছরের অর্থনৈতিক বৈষম্য ও রাজনৈতিক শোষণের শিকার হয়েই এই জনযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন ও তার কিছুদিন পরই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেশে ফিরে আসাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির জন্যে বিব্রতকর পরিস্থিতি মনে করা হয়েছে ঠিক কিউবা বিপ্লবের সময়ের মত। এ প্রসঙ্গে এ এল খতিব তাঁর ‘হু কিলড মুজিব’ গ্রন্থে লিখেছেন, “…মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলে হেনরি কিসিঞ্জারের সহযোগি হিসেবে কাজ করা রজার মরিসের মতে, মুজিবের ঢাকায় ফিরে বীরের সংবর্ধনা পাওয়াটা ‘সম্ভবত ক্যাস্ত্রো একটি ট্যাঙ্কে চড়ে হাভানায় প্রবেশ করার পর মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির জন্য সবচেয়ে অপমানকর মূহুর্ত।’…”

বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়া দুই নেতার প্রথম সাক্ষাতেই তাই দুই জনের ভিতর সখ্যতা গড়ে উঠতে দেখা গিয়েছিল। ১৯৭৩ সালে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের আলজিয়ার্স সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর সাথে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে ফিদেল ক্যাস্ত্রো বঙ্গবন্ধুকে সাবধান করে বলেছিলেন যে, রাষ্ট্র পরিচালনায় পাকিস্তান আমলের আমলাদের রেখে দিলে সংকট অত্যাসন্ন। বলেছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ক্ষমতা প্রদান করে দেশ গঠণের। মুক্তিযোদ্ধারা হয়ত বারবার ভুল করবে, কিন্তু কখনো দেশের সাথে বেইমানি করবে না। বঙ্গবন্ধু পুরো বৈঠকে ফিদেল ক্যাস্ত্রোকে সম্বোধন করেছিলেন ‘কমরেড’ বলে। ক্যাস্ত্রো জানিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁর ভালোবাসার কথা। বৈঠক শেষে ফিরে যাওয়ার সময়ে গাড়িতে ওঠার আগ মূহুর্তে চিৎকার করে বলেছিলেন, “জয় বাংলা।”

সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশও চেয়েছিল বিপ্লবী কিউবার সাথে উষ্ণতম বন্ধুত্বের সম্পর্ক। এজন্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক অবরোধের তোয়াক্কা না করেই কিউবার সাথে করা হয়েছিল পাট রপ্তানী চুক্তি। তবে এই চুক্তির জন্যে বাংলাদেশ সরকার ও সাধারণ মানুষকে চড়া মূল্য দিতে হয়েছিল। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে যখন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের মানুষ দিশেহারা, তখন কিউবার সাথে বাণিজ্য চুক্তি করায় বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের জন্যে পাঠানো ত্রাণবাহী জাহাজ মাঝ সমুদ্র থেকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ফলাফল বাংলাদেশের নিরীহ সাধারণ মানুষের মৃত্যু, যে মৃত্যু সহজেই প্রতিরোধ করা যেত।

আমরা জানি না ফিদেল ক্যাস্ত্রোর উপদেশ বাস্তবায়ন করার কথা বঙ্গবন্ধু ভেবেছিলেন কিনা। ভাবলেও সেই ভাবনা বাস্তবায়নের সময়টুকু হয়ত তিনি পান নি। তার আগেই সপরিবারে নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পিছনে ঘুরে-ফিরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সিআইএ-র নাম প্রায়ই চলে আসে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সকল তথ্যই তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড পাচ্ছিলেন তা পরবর্তীতে প্রকাশিত মার্কিন নথিপত্রেই দেখা গিয়েছে।

ক্যাস্ত্রো বলেছিলেন যে, বিপ্লবের অন্যতম ভালো দিক হল কিউবার যৌনকর্মীরাও গ্র্যাজুয়েট। বাংলাদেশে আমরা এখনো মানসম্মত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্যে লড়াই করছি। তাই ক্যাস্ত্রোর মৃত্যুতে শোক নয় বরং নতুন করে অনুপ্রাণিত হওয়া উচিত তাঁর জীবন সংগ্রাম ও সফলতা থেকে। কারণ ক্যাস্ত্রোদের মৃত্যু হয় না। ক্যাস্ত্রোরা জেগে থাকেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা মিছিলের মাঝে বা এক কোণে থাকা কোন তরুণের হৃদয়ে, ক্যস্ত্রোরা বেঁচে থাকেন প্রতিটি দেশপ্রেমিকের মননে।

 

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।