শিবলী নোমান
২০১৬ সালের মার্কিন যুক্তরষ্ট্রের প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচন উপলক্ষে ৩য় ও সর্বশেষ প্রেসিডেন্সিয়াল ডিবেট অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো গত বৃহস্পতিবার। নেভাদা অঙ্গরাজ্যের লাস ভেগাসে অনুষ্ঠিত এই সর্বশেষ বিতর্ক ডেমোক্রেট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন ও রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্যে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল কারণ তিনটি স্থানে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্সিয়াল ডিবেটের ভিতর শুধুমাত্র নেভাদাই হল একটি ‘সুইং স্টেট’। অর্থাৎ এই অঙ্গরাজ্যের ছয়টি ইলেক্টোরাল কলেজের স্থায়ী সমর্থন নেই নির্দিষ্ট কোন দলের প্রতি। তাই এই অঙ্গরাজ্যে অনুষ্ঠিত ডিবেট এই অঙ্গরাজ্যের ভোটারদের সমর্থন আদায়ের শ্রেষ্ঠতম সুযোগ। তবে পশ্চিমা মিডিয়াগুলো বারংবার বলে এসেছে যে এই ডিবেট রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্যে আরেকটি কারণে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তা হলো, দ্বিতীয় প্রেসিডেন্সিয়াল ডিবেটের দুইদিন আগে ২০০৫ সালের এক অডিও প্রকাশের মাধ্যমে নারীর প্রতি অসম্মানজনক আচরণের অভিযোগে যে ধরণের বিরূপ অবস্থার মুখোমুখি ট্রাম্প হয়েছেন, একই সাথে ঐ ডিবেটের পর থেকে সর্বশেষ ডিবেটের মধ্যবর্তী সময়ে এই ইস্যুতে যেভাবে নতুন করে জল ঘোলা হয়েছে তাতে ট্রাম্পের জন্যে শেষ বিতর্ককে তার টিকে থাকার শেষ সুযোগ বলাই যায়। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, পশ্চিমা মিডিয়ার সাথে গলা মিলিয়ে এই বিতর্ককে ট্রাম্পের শেষ সুযোগ বলা কতটা সঙ্গতিপূর্ণ তা ভেবে বের করা।
দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রেসিডেন্সিয়াল ডিবেট দেখে এবং এই ডিবেট দু’টির আগে-পরে পশ্চিমা মিডিয়ার সংবাদ প্রকাশের ভঙ্গি দেখে আর যাই হোক তাদের বস্তুনিষ্ঠ বলার আর কোন সুযোগ নেই। সুযোগ নেই নিরপেক্ষ বলারও। তারা কেউ ঘোষণা দিয়ে কেউ ঘোষণা না দিয়ে হিলারি ক্লিনটনকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে তা খুব সহজেই চোখে পড়ছে। কিন্তু এর ফলে সমস্যায় পড়ে যাচ্ছি আমরা বাংলাদেশ কিংবা পশ্চিমা সংবাদ সংস্থা ও মিডিয়া হাউসগুলোর উপর আন্তর্জাতিক সংবাদের জন্যে নির্ভরশীল দেশগুলো। যেহেতু আমাদের দেশের গণমাধ্যমগুলোর অধিকাংশই পশ্চিমা সংবাদ সংস্থাগুলো থেকে আন্তর্জাতিক সংবাদের সাবস্ক্রাইবার হিসেবে সংবাদ পায়, তাই আমাদের গণমাধ্যমেও সেসব সংবাদই উঠে আসে যা ঐ পশ্চিমা সংবাদ সংস্থা বা মিডিয়া হাউসগুলো করছে। এর ফলে হিলারি ও ট্রাম্প উভয়ই আমাদের কাছে সমান পরিচিত কিংবা সমান অপরিচিত হওয়ার পরও ট্রাম্পকে কেন জানি আমাদের একটু বেশি খারাপ মানুষ কিংবা তার নির্বাচিত হওয়ার ঘটনাকে এক ধরণের আতঙ্ক মনে হয়; তাই নয় কি?
আমি যে গণমাধ্যম অধ্যয়নের তাত্ত্বিকতার আলোকেই এসব বলছি তা ভেবে নেয়ার কোন কারণ নেই। বরং হিলারি-ট্রাম্প বা মার্কিন প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচন ইস্যুতে আমি একদম চোখের সামনে মিডিয়ার এমন ব্যবহার দেখেছি একের পর এক। সম্প্রতি ট্রাম্পের ২০০৫ সালের যে অডিও ফাঁস হয়েছে এবং ২য় বিতর্কের পর আরো নয় জন নারী তার বিরুদ্ধে যে যৌন হয়রানির অভিযোগ এনেছেন তার সবই কিন্তু এখন পর্যন্ত অভিযোগ। কোনটাই প্রমাণিত নয়। তবে এ ধরণের অভিযোগে দুষ্ট একজন ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি হওয়ার কিংবা নির্বাচনে অংশ নেয়ার যোগ্য কিনা তা নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে এবং সেক্ষেত্রে অবশ্যই ট্রাম্পকে সমর্থন দেয়ার কোন কারণ নেই। কিন্তুই এখন যেহেতু এটি নিয়ে আলোচনার কিছু নেই তাই বলতেই হচ্ছে যে শুধুমাত্র অভিযোগের উপর ভিত্তি করে মিডিয়াগুলো ট্রাম্পকে যেভাবে চিত্রায়িত করছে তা কি ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ নয়? তথাকথিত বস্তুনিষ্ঠ গণমাধ্যমগুলোকে কি বলে দিতে হবে যে প্রমাণ হওয়ার আগে কোন ব্যক্তিকে অপরাধী হিসেবে উপস্থাপন করা যায় না? ঠিক আছে, যদি মেনেও নেয়া হয় যে হিলারি সমর্থন দেয়ার কারণে মিডিয়াগুলো এমন করছে, তাহলে ট্রাম্প যে পরপর দুইটি বিতর্কে বললেন তার সম্পর্কে শুধু অভিযোগ আছে আর বিল ক্লিনটনের এসব বিষয় প্রমাণিত, সেগুলো কয়বার উল্লেখ করেছে মিডিয়াগুলো?
তথাকথিত বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ মিডিয়াগুলোর নগ্ন পক্ষপাতিত্ব দেখা যাচ্ছে হিলারির প্রতি। তারা হিলারি ক্লিনটনের ই-মেইল কেলেঙ্কারি নিয়ে কোন আলোচনাই করছে না। বরং এগুলোকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোপনীয় নথি উল্লেখ করে রাশিয়ার বিরুদ্ধে তা হ্যাক করার অভিযোগ আনা হয়েছে। আরো অভিযোগ আনা হয়েছে রাশিয়া এগুলো উইকিলিকসের মাধ্যমে প্রকাশ করছে যেন মার্কিন নির্বাচনের ফলাফলকে প্রভাবিত করা যায়। ট্রাম্প বিরোধীদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে মিডিয়া যখন ট্রাম্পকে ধুয়ে দিচ্ছে তখন অন্যদিকে হিলারির অভিযোগের ভিত্তিতেই উইকিলিকস ও রাশিয়ার মার্কিন গোপনীয় নথি হ্যাক করে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার প্রচারণাও চালাচ্ছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ মেইলগুলো কেন হিলারি ব্যক্তিগত ই-মেইল অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে আদান-প্রদান করলেন সে বিষয়ে মিডিয়াগুলোর কোন চিন্তা আছে বলে মনে হচ্ছে না। সর্বশেষ বিতর্কে ব্রাজিলের সাথে ২২৫ মিলিয়ন ডলারের ‘ওপেন বর্ডার ট্রেড’ ও স্টেট সেক্রেটারি থাকাকালে ছয় বিলিয়ন ডলারের হিসাব না পাওয়ার যে অভিযোগ ট্রাম্প হিলারির বিরুদ্ধে এনেছেন তা নিয়ে মিডিয়ায় কোন আলোচনা আছে কি? খুঁজে দেখুন, পাবেন না বলে দিতে পারি!
মিডিয়ার পক্ষপাতিত্ব নিয়ে আলোচনা সরিয়ে রেখে আসুন ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে ডালপালা মেলতে দেই। ২য় বিতর্কে ট্রাম্প বলেছিলেন তিনি নারীদের সম্পর্কে শুধু বলেছেন, এমন কিছু কখনো করেন নি। আর তার পরই একে একে নয় জন নারী বেরিয়ে আসলেন যারা ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেছেন। কেন ট্রাম্পের ঐ কথা বলা পর্যন্ত তারা অপেক্ষা করেছিলেন নিজেদের সাথে হওয়া অন্যায়ের কথা প্রকাশ করতে? নাকি ট্রাম্পের কথাতেই বিরোধী পক্ষের কারো মনে হল বিষয়টা এভাবে সাজিয়ে নেয়া যায়? ভেবে দেখবেন একটু!
পশ্চিমা মিডিয়ার বিপক্ষে অনেক বললাম। তাই শেষ করি পশ্চিমা মিডিয়ার পরিসংখ্যান দিয়েই। তিনটি ডিবেটেই হিলারি জিতেছেন বলে জরিপের ফল প্রকাশ করেছে সিএনএন ও ওআরসি। তিনটি বিতর্কে হিলারির পক্ষে রায় ছিল যথাক্রমে ৬২, ৫৭ ও ৫২ শতাংশ। ট্রাম্পের ক্ষেত্রে এটি যথাক্রমে ২৭, ৩৪ ও ৩৯ শতাংশ। জিতে গেলেও প্রতিবারই হিলারির সমর্থন কমেছে, বেড়েছে ট্রাম্পের। তাহলে কি বলা যায় ট্রাম্পের সম্ভাবনা এখনো শেষ হয়ে যায় নি? কার সম্ভাবনা আছে কিংবা নেই তা নিয়ে না ভেবে আসুন এমন একজন প্রেসিডেন্টের আশা করি যিনি শুধুমাত্র ব্যক্তিগত বন্দুক ব্যবহারের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বছরে ৩৩ হাজার মানুষের নিহত হওয়া ঠেকানো নিয়ে চিন্তা না করে বিশ্বের আনাচে-কানাচে মার্কিন স্বার্থরক্ষায় নিহত হওয়া প্রতিটি দেশের সাধারণ, বেসামরিক মানুষ সম্পর্কে চিন্তা করবে; ২০১৬ সালে এমন একজন প্রেসিডেন্ট পাওয়া যদিও দুরাশার সামিল। তাই চলুন দেখি শেষ পর্যন্ত কী হয়। কারণ শেষ হওয়ার আগে শেষ বলে কিছু নেই।