শিবলী নোমান
বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাঙ্কিং আসলে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, বা আদতে গুরুত্বপূর্ণ কিনা তা নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে। অথবা এই র্যাঙ্কিং-এ স্থান পাওয়া-না পাওয়া আসলে কী অর্থ তৈরি করে তা নিয়েও বাক-বিতণ্ডা হতেই পারে। তবে ব্যক্তিগতভাবে র্যাঙ্কিং-এ স্থান পাওয়া মানেই বিশাল কোন অর্জন, তা মেনে নিতে আমি নারাজ। তবে র্যাঙ্কিং-এর ভালো-খারাপ বা পক্ষে-বিপক্ষে নয়, বরং সম্প্রতি টাইমস হায়ার এডুকেশন কর্তৃক ২০২৪ সালের বিশ্বব্যাপী বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের র্যাঙ্কিং প্রকাশের পর, নতুন করে এ সংক্রান্ত আলোচনার উপলক্ষ্যকে কাজে লাগিয়ে কিছু প্রতিক্রিয়া জানিয়ে রাখাই এই লেখার মূল উদ্দেশ্য।
মোটাদাগে কয়েক বছর আগ পর্যন্ত টাইমস হায়ার এডুকেশন বা কিউএস কর্তৃক ঘোষিত বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাঙ্কিং-এ নিয়ম করে দেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান না পাওয়ার কয়েক দিন পর্যন্ত সামাজিক মাধ্যম থেকে শুরু করে পত্রিকা-টেলিভিশনে দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার দিশাহারা অবস্থা নিয়ে কান্নাকাটির আসর জমতে দেখা যেতো। কিন্তু নিরেট সত্যটি হলো, আমাদের গণমাধ্যমগুলো তো বটেই, আমাদের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনেরও র্যাঙ্কিং-এ আসার জন্য বিবেচিত হতে হলে কী করতে হয়, মানে কোন্ পদ্ধতিতে আগাতে হয় তা অজানা ছিল, এই না জানার কারণ অনীহা বা অজ্ঞতা যাই হোক না কেন। তো, সেদিকে মনোনিবেশ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আলোর পথ না দেখিয়ে আমাদের গণমাধ্যম মূলত ‘রেডিমেড’ সংবাদ প্রকাশের সহজ পথটিকেই বেছে নিয়েছিল আর কী!
অন্যদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যখন র্যাঙ্কিং-এর জন্য বিবেচিত হওয়ার পূর্বশর্তগুলো পূরণের জন্য কাজ করা শুরু করলো, তখনও আমরা নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে দেখেছি প্রশাসনকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাঙ্কিং-এ স্থান পাওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট পাঠযোগ্য রূপে গড়ে তোলা এবং নিয়মিত হালনাগাদ করা জরুরি। দুঃখজনক হলো আমাদের বহু বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটই বর্ণবোধহীন, রুচিহীন এবং ‘ভুল-ভুলাইয়া’ জাতীয় গোলক ধাঁধা, যেখানে কাঙ্ক্ষিত বিষয় হয় থাকে না, আর থাকলেও খুঁজে পেলে সাত কপালের ভাগ্য বলতে হয়!
সে যাই হোক, র্যাঙ্কিং-এ আসতে হলে একটি অপরিহার্য বিষয় হলো, আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে সকল শিক্ষকের পেশাগত তথ্য তথা প্রোফাইল হালনাগাদ থাকতে হবে, যা থেকে প্রতিটি শিক্ষকের গবেষণার আগ্রহের বিষয়, প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধসমূহ, গবেষণা প্রকল্প ও পাঠদান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। তো, আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি সেখানে গত এক বছরে শিক্ষকদের প্রোফাইল হালনাগাদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ মহল থেকে অন্তত তিন দফা চিঠি দিতে হয়েছে। এমনকি ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগও করতে হয়েছে। তারপরও আমি নিজের চোখে একজনকে বলতে দেখেছি, “এটা না করা হলে কি চাকরি চলে যাবে?” হায় সেলুকাস, এখনো যদি আমাদের ওয়েবসাইটে বহু অ-হালনাগাদকৃত প্রোফাইল খুঁজে পাওয়া যায়, সত্যি বলছি আমি একে বিচিত্র বলবো না!
যাই হোক, র্যাঙ্কিং-এ এক হাজারের ভেতর দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্থান পাওয়া খালি হাতে বসে থাকার চেয়ে আনন্দদায়ক বটে। তবে প্রশ্নটি হলো, এই র্যাঙ্কিং নিয়ে আমরা আসলে কী করবো?
মাস কতক আগে কিউএস র্যাঙ্কিং-এ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ১২০১-১৪০০ ব্র্যাকেটের ভেতর স্থান পাওয়ায় আমার এক ছাত্র অনেকটা এমন লিখেছিলেন, তিন হাজারের ভেতর স্থান পাওয়ার কথা না, দেড় হাজারের ভেতর আসে কীভাবে? আর এবার টাইমস হায়ার এডুকেশনের র্যাঙ্কিং-এ ৮০১-১০০০ ব্র্যাকেটে আসার পরও অনেকেই শিক্ষার মান বৃদ্ধির কথা বলছেন।
তবে এর ভেতর একজন শিক্ষার্থীকে লিখতে দেখলাম, ৮০১-১০০০ এর ভেতর স্থান পেলেও দুনিয়ায় আর কোথাও এমন বিশ্ববিদ্যালয় আছে কিনা যেখানে শিক্ষকদের কক্ষগুলোর দিকে ‘entry restricted’ লেখা থাকে? প্রশ্নটিকে একেবারে ফেলে দেয়া না গেলেও একতরফা সাধারণীকরণের দোষে দুষ্ট বলা ছাড়া অন্য কোন উপায় আপাতত নেই। শিক্ষকদের এলাকায় ‘প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত’ যেমন লেখা যায় না বা লেখা ঠিক নয়, তেমনিভাবেই শিক্ষকদের কাজ করার এলাকায় অহেতুক ঘুরতে আসা, ছবি তুলতে আসা, বৃষ্টি দেখতে আসা, এমনকি খাবার-দাবার নিয়ে বনভোজনে চলে আসার মতো বিষয়ের সম্মুখীন হতে হয় আর কোন দেশটিতে?
এটি মূলত আমাদের দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্কট। এর একেবারে ভিন্ন চিত্র দেখা যাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। আপনি যত গুরুত্বপূর্ণ কাজেই যান না কেন, বহিরাগত হলে নিরাপত্তার দুই বা ততোধিক ধাপ পার না হয়ে, আর নিরাপত্তা কর্মীদের চোখ রাঙানি না দেখে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছানো যে কারো জন্য প্রায় অসম্ভব একটি কাজ।
আমি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভুল করে শিক্ষকদের প্রক্ষালন কক্ষ তথা শৌচাগারের দিকে কয়েক কদম এগুনোর ফলে একজন নিরাপত্তাকর্মীকে এমনভাবে একজন শিক্ষার্থীকে ধমক দিতে দেখেছি, সেভাবে যদি নিজ বিভাগ বাদে অন্য কোন বিভাগের শিক্ষার্থীকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন শিক্ষকও ধমক দেন, তার বিরুদ্ধে আন্দোলন তৈরির সম্ভাবনাকে ফেলে দেয়া যায় না।
আবার আরেকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পরিচয় পত্রের ফিতা বা রিবনের নির্দিষ্ট রঙ রয়েছে, সেই নির্দিষ্ট রঙের ফিতার পরিচয় পত্র রয়েছে এমন কাউকে দেখলে শিক্ষার্থীদেরকে হাত খানেক দূরে সরে যেতে হয়, যেন কোনভাবেই শিক্ষকদের সাথে তাদের শরীর স্পর্শ না করে।
এখানে বিষয়টা কিন্তু পাবলিক বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠত্বের নয়। মূলত একটি প্রতিষ্ঠানে আমাদের আচরণ কেমন হওয়া উচিত, সেটি গুরুত্বপূর্ণ। এই বোধটা না থাকার ফলেও কোথাও যেমন ‘প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত’ লেখাটা ‘চিড়িয়াখানাসদৃশ’ মনে হয়, তেমনি কোন একটি জায়গা আদতে বন্দিশালা বা সংশোধনাগার জাতীয় স্থানের রূপ লাভ করে। কিন্তু দুই ব্যবস্থার কোনটিই যেমন কাম্য নয়, তেমনি ব্যবস্থাটি গ্রহণের পেছনের কারণটিও তো সুখকর নয়।
আরো গুরুত্বপূর্ণ হলো, র্যাঙ্কিং-এ স্থান পেয়ে আমরা কী করবো যদি শিক্ষক-শিক্ষার্থী একে অপরকে দুইটি পক্ষ মনে করা চালিয়ে যায়? কী করবো র্যাঙ্কিং-এ ঢুকে যদি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যয় থেকে শিক্ষার্থীরা শুধু চাকরির পরীক্ষায় বসার পূর্বশর্ত একটি বা দুইটি সনদ প্রাপ্তির চেয়ে বেশি কিছু না চায়? কী করবো শিক্ষকদের শিক্ষকতাকে দর্শনহীন, জবাবদিহিতাহীন, স্বেচ্ছাচারী একটি চাকরি মনে করা জারি থাকলে, যেখানে পাঠদান বা উচ্চশিক্ষার্জনের মূল লক্ষ্য হয়ে যায় বেতন বৃদ্ধি ও পদোন্নতি? বাস্তবতা এমন বলেই হয়তো ৮০১-১০০০ ব্র্যাকেটের ভেতর স্থান পাওয়া কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয় নিজেদেরকে দেশের ভেতর শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঘোষণা করার শিশুসুলভ ভেল্কিবাজিতে মেতে ওঠে প্রতি বছর।
তার উপর বিশ্ব র্যাঙ্কিং-এ ১০০০ এর ভেতর থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আবাসিক হলে গণরুমের উপস্থিতি, গেস্টরুম সংস্কৃতি, সর্বোপরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতা কাঠামোতে শিক্ষার্থীদের ব্যবহার এভাবেই জারি থাকলে এই র্যাঙ্কিং দিয়ে আমরা কী করবো? আর কী-ই বা করবো শিক্ষাকে পণ্য করে তুলে বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্যবসা আর মুনাফার উর্বর ভূমি হিসেবে গড়ে তোলা হলে?
তাই বলতে হয়, গণমাধ্যমের ভুলভাবে সংবাদ করার কারণে চাপে পড়ে হোক, বা নিজেদের বিবেকের তাড়নায় হোক, যেসব বিশ্ববিদ্যালয় নিয়মিত র্যাঙ্কিং-এ ১০০০ এর ভেতর স্থান পাচ্ছে, সম্ভবত সবচেয়ে সহজ কাজটা তারা করে ফেলেছে, আর তা হল র্যাঙ্কিং-এ ঢোকা। এবার অবস্থান ধরে রাখা আর একটু একটু করে উপরে ওঠার পালা, যা কঠিন হতে বাধ্য। আর র্যাঙ্কিং এক আলাপ এক পাশে সরিয়ে দিয়ে একখানা মানবিক বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠার বিষয়টিকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা কতটা কঠিন করে তোলেন, আশা করা যায় কলিকালে বসে তা নিজ চোখেই দেখা যাবে!
ব্যতিক্রমকে উদাহরণ হিসাবে বিবেচনায় নিচ্ছি না। সেই হিসাবে আমি মোটাদাগেই বলবো, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিদ্যায়তন হতে প্রায় ব্যর্থ। প্রথাগত সিলেবাস/কারিকুলামের বাইরে আমি যেভাবে বিশ্ববিদ্যালয়কে ভাবতাম, তার কিঞ্চিত পেয়েছি। তাও, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অমূল্য সেই সবেধন নীলমণিগুলো অবহেলায় পড়ে থেকেছে/থাকছে। চিন্তা/আইডিয়া/ভিন্নমত/নতুন কিছু জানা/করার অ্যাডভেঞ্চার/শেখার আনন্দ সবমিলিয়ে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর নয়।
তবে, আমি একইসাথে মেনে নিচ্ছি সমালোচনা কিংবা না পাওয়ার মাতম গাওয়া যতোটা সহজ, সংস্কার কিংবা একটু করে আমূল সংশোধন ঠিক ততোটাই কঠিন।
তাই, বিশ্ববিদ্যালয় র্যাংক করার আনন্দ আমাকে খুব একটা ছুঁয়েছে, এমনটা এখনো টের পাইনি। বরং, যখনই আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা মনে পড়ে, তখনই মনে হতে থাকে, আরো কিছু হওয়ার/করার ছিলো আমাদের একসাথে।
আমাদের মতো রেজাল্টশিটের তলানীতে থাকা শিক্ষার্থীদের প্রতি মনোযোগ হয়তো, র্যাংক বাড়ানোর প্রতিযোগিতার দৌড়ে আরো বাড়বে। কেউ জানবেও না, আমরা কী করতে চেয়েছিলাম, কী হতে পারতাম..। আসলে, বয়সের সাথে সাথে অনেকের জ্ঞান বাড়ে। আমার বাড়ছে নির্বিকারত্ব। হয়তো তাই মনে হয়, যা হয় হোক। তবে, এর পরেও মাথার ভেতর ঝিঁঝিঁ পোকার মতো নড়তে থাকে, একসাথে আমাদের অনেক কিছুই করার ছিলো।
একমত, আসলেই অনেক কিছু করার কথা ভাবি আমরা, শেষ পর্যন্ত পারপার্শ্বিকতার কারণে যা আর করা হয়ে ওঠে না।