শিবলী নোমান

টোকিও টাওয়ার থেকে (কিস্তি ০৪)

শিবলী নোমান

১৪ নভেম্বর, ২০১০, রবিবার

আমাদেরকে সকাল ৯টা ২০ মিনিটে হোটেলের লবিতে থাকার জন্য বলা হয়েছিল। তাই আমরা তিনজন পুরোপুরি প্রস্তুত হয়েই হোটেলের নিচে এসে নাস্তা করে নিলাম। এই হোটেলের রেস্তোরাঁটি খুব বেশি বড় নয়, মানুষের ভিড়ও তেমন দেখলাম না। নাস্তা শেষে আমরা হোটেলের লবিতে বসে অপেক্ষা করতে থাকলাম। আমি আজ আগের দিনের পোশাকই পরেছি, কারণ বাইরে খুব বেশি ধুলাবালি না থাকায় জামা-কাপড় একদমই নোংরা হয় নি, তাই ঠিক করেছিলাম নতুন জামা-কাপড় বের না করে যতদিন চালানো যায়, চালিয়ে নিবো।

৯টা ২০ মিনিটেরও কিছু পর রেড ক্রস কর্মকর্তারা এসে গেলো। আমাদেরকে নিচে প্রস্তুত অবস্থায় দেখে তারা বেশ অবাক হলো। তাদের ধারণা ছিল বাংলাদেশ ডেলিগেশন সময়মতো প্রস্তুত থাকতে পারবে না। আজ মারিকোর সাথে এসেছে ইয়োশিকো, অর্থাৎ নারিতা এয়ারপোর্টের সেই ল্যাঙ্গুয়েজ ভলান্টিয়ার, আর আছে শোকো নামের একজন রেড ক্রস সদস্য। আমাদেরকে ওরা জিজ্ঞেস করলো যে ওরা শুনেছে বাংলাদেশিরা নির্ধারিত সময় অনুযায়ী চলতে পারে না, তাহলে আমরা কীভাবে সঠিক সময়ের ভেতর নিচে প্রস্তুত থাকলাম। আমি উত্তর দিলাম, ঐ কাজটা বাংলাদেশিরা শুধু নিজেদের ভেতর করে, এছাড়া তারা সময় মেনেই চলে। কী করতাম, আমাদের নিয়ে দুর্নামটা একটু কমাতে তো হবে, নাকি!

যাই হোক, আমরা রওনা হলাম। আজ আমরা শুকুতোকু বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবো। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইয়ুথ ভলান্টিয়ার কর্পসের সাথে আমাদের এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম হবে। শুকুতোকু বিশ্ববিদ্যালয় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, যেটি ১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন রায়োসিন হাসেগাওয়া। যে সময় এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় তখন জাপানে সরকারি প্রণোদনায় সামাজিক উন্নয়নের গতি খুব শ্লথ ছিল, তাই বেসরকারি উদ্যোগে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি তৈরি করা হয়। বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নার্সিং ও পুষ্টিবিজ্ঞান, ব্যবসা ও আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগ, ব্যবসায় প্রশাসন, শিক্ষা, সামাজিক ও মানবিক উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক ব্যবসা ও সংস্কৃতি বিষয়ে শিক্ষাদান করা হয়ে থাকে। এছাড়া চিবা শহরে প্রতিবন্ধীদের জন্য আয়োজিত ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করেন।

গাড়িতে যেতে যেতে চিবা শহরটা দেখছিলাম। শহরের এই অংশ দেখে মনে হচ্ছিলো কোন এক মফস্বল শহর। কিন্তু একটু পরই চিরচেনা ব্যস্ত শহরের মতো মানুষের ভিড় চোখে পড়লো। টোকিওর মতো চিবার মানুষও সবসময় ব্যস্ত; অন্তত ব্যস্তভাবে চলাফেরা করে। কারো দিকে কারো খেয়াল করার অবসরটুকুও যেন নেই। চিবার প্রাকৃতিক দিকটাও বেশ উপভোগ্য। আমরা যেখানে আছি, সেখানে এখন পর্যন্ত টোকিওর মতো উঁচু উঁচু দালানের সমাহার নেই। রাস্তার একপাশে গাছের সারি দেখতে দেখতে এগিয়ে চলছি, গাছের পাতার রঙ কমলা ও লাল। হঠাৎ দেখলে কিছুটা মন খারাপ হয়, কিন্তু একসাথে সব গাছে একইরকম লাল বা কমলা দেখলে মনের ভেতর কেমন জানি একটা উৎসবের আমেজও তৈরি হয়।

শুকুতোকু বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছাতেই আমাদেরকে স্বাগত জানালো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও স্বেচ্ছাসেবকরা। রবিবার বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য সব কিছু সেদিন বন্ধ ছিল। আমাদেরকে একটি সম্মেলন কক্ষে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে একপাশে আমরা, আর অন্যপাশে স্বেচ্ছাসেবকরা বসার পর অনুষ্ঠান শুরু করলেন একজন শিক্ষক। আমাদের ঠিক পেছনেই বসা ছিল ইয়োশিকো, কারণ দোভাষীর কাজটা সেই করবে। স্বেচ্ছাসেবকদের একজন পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে চিবা শহরের সাথে আমাদের পরচয় করিয়ে দিলো, এরপরই আরেকজন স্বেচ্ছাসেবক শুকুতোকু বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথেও পরিচয় করিয়ে দিলো। আমাকে একটি কবিতা আবৃত্তি করতে বলা হলো, জাপানে আমি শুধু বিদ্রোহী কবিতাই আবৃত্তি করবো ভেবে এসেছিলাম, তাই সেখান থেকেই কিছুটা অংশ আবৃত্তি করলাম। এরপর আমরা ওদেরকে আমাদের বানানো কার্ডগুলো দিলাম। আর ওদের পক্ষ থেকে আমাদেরকে দেয়া হলো একদিন মেয়াদী শুকুতোকু বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয় পত্র। এসময় ইয়োশিকো আমাদের কাছে জানতে চাইলো আমরা কেউ ওয়াশরুমে যেতে চাই কিনা, আমরা মানা করলাম।

এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম শেষ হওয়ার পর আমাদেরকে আরেকটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে আমাদেরকে বলা হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বেচ্ছাসেবকরা আমাদের সাথে কিছু খেলতে চায়। বলে তারা খেলাটি কেমন তা একবার তারা দেখিয়ে দিলো। বুঝলাম তারা কানামাছি খেলতে চায়। এটা খেলতে তো আমাদের কোন সমস্যাই নেই। আমরা কিছুক্ষণ কানামাছি খেললাম। একবার আমার চোখ বেঁধে দেয়া হলো, তখন আমি স্বেচ্ছাসেবক নেতাকে ধরে ফেললাম।

দুপুর হয়ে যাওয়ায় আমাদেরকে দুপুরের খাবারের জন্যে একজন শিক্ষকের কক্ষে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে খেতে খেতে আমার সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তির বিষয়ে জানতে চাওয়া হলো। আমি চে গেভারার নাম বললাম। উচ্চারণের ভিন্নতার জন্য তারা প্রথমে বুঝতে না পারলেও, পরে বুঝতে পেরে খুব অবাক হওয়ার মতো মুখভঙ্গি করলো।

খাওয়া শেষে আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের পেছনে থাকা এক পুরনো মন্দিরে, এটি ছিল একটি বৌদ্ধ মন্দির, সেখানে গৌতম বুদ্ধের মূর্তিও ছিল। সেখনে ছবি তোলার সময় খেয়াল করলাম ওরা ছবি তোলার সময় সবসময়ই ‘ভিক্টোরি’ চিহ্ন দেখাতে পছন্দ করে।

এরপর আমাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রহশালায় নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিকের ছবি, ক্রমবিবর্তনের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়টি কীভাবে আজকের অবস্থায় এলো তার ধারাবাহিক ছবি, বিভিন্ন সময় ব্যবহৃত শিক্ষা উপকরণ, বিভিন্ন স্মারক, পুরস্কার প্রভৃতি। একইসাথে প্রতিবছর প্রতিবন্ধীদের জন্যে আয়োজিত ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করার স্মারকও দেখানো হলো। আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি টি-শার্ট দিলেন একজন শিক্ষক, আর সূচনা আপুকে দেয়া হলো চিবা শহরের প্রতীক শূকরের একটি পুতুল।

শুকুতোকু বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্ধারিত কাজগুলো শেষে আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে যাবো, তখন আবার কিছু গ্রুপ ছবি তোলা হলো। আর ইয়োশিকো আমাকে বললো আজ এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা হচ্ছে, আমি সেই পরীক্ষায় অংশ নিতে চাই কিনা। আমি তাকে বললাম পরেরবার দিবো, বলে দু’জনেই হেসে ফেললাম।

বিকাল হওয়ার আগেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কাজ শেষ হয়ে গেলো। আমাদের কাছে জানতে চাওয়া হলো আমরা এখন কী করতে চাই। জাফর ভাই কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, “শপিং করতে চাই।” জাফর ভাই আগে জাপান এসেছিলেন, তাই জানেন এখানে কিছু দোকান আছে যেখানে সবকিছুর দাম ১০০ ইয়েন। অর্থাৎ ১০০ ইয়েনের একটি কয়েন দিয়ে যে কোন কিছু কেনা যায়। জাফর ভাই বললেন আমাদেরকে যেন কোন একটি ১০০ ইয়েনের দোকানে নিয়ে যাওয়া হয়। তার কথা মতো আমাদেরকে ১০০ ইয়েনের একটি দোকানে নিয়ে যাওয়া হল। আমরা আমাদের মত কেনাকাটা শুরু করলাম।

আমি অনেকগুলো চকোলেটের প্যাকেট, জাপানের ঐতিহ্যবাহী পাখা, ছাতি আর চিরুনি কিনলাম আত্মীয়দের জন্য। আমি প্রায় সাড়ে তিন হাজার ইয়েনের শপিং করলাম। আমাকে এত চকোলেট কিনতে দেখে মারিকো জানতে চাইলো চকোলেট আমার খুব পছন্দ কিনা। আমি বললাম চকোলেট আমার পছন্দ, কিন্তু এগুলো সব দেশে আমার বন্ধু আর আত্মীয়দের জন্যে। এটা শুনে মারিকো খুব অবাক হলো, আর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আমাকে দুই হাত দিয়ে ‘থাম্বস আপ’ করে বললো, “ইউ আর গ্রেট!” আমি তাকে বললাম এটা তেমন কিছু নয়, বরং সব বাংলাদেশিই এটা করে। তখন ও বললো, “বাংলাদেশ ইজ গ্রেট!”

১০০ ইয়েনের দোকানটিতে আমাদের কেনাকাটা শেষ করে আমরা জাপানের একটা মেগা মার্কেটে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করলাম। আমার ডিএসএলআর ক্যামেরার অনেক পুরনো শখ ছিল, আমি একটা দোকানে দেখলাম একটা ক্যামেরার ছবির নিচে লেখা দশ হাজার ইয়েন। দশ হাজার ইয়েনে যদি সত্যিই ডিএসএলআর ক্যামেরা পাওয়া যায় তাহলে আমি তা কিনবোই, এমনটা ভাবতে ভাবতে আমরা সেই মার্কেট থেকে বের হয়ে গেলাম। মার্কেটের বাইরে কিছুক্ষণ বসে থেকে আমরা গল্পগুজব করলাম, আর সন্ধ্যা হলে একটা ভারতীয় রেস্তোরাঁয় ঢুকলাম। সেখানে আমরা সবাই তন্দুরি চিকেন আর নান রুটি খেলাম। এটাই ছিল আমাদের রাতের খাবার। এরপর আমাদেরকে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে মারিকোরা চলে গেলো।

আমি আমার রুমে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে ছিলাম আর দেয়ালে আঙুল দিয়ে শব্দ করছিলাম। হঠাৎ ফোন আসলো আর ধরেই বুঝলাম পাশের রুম থেকে সূচনা আপু ফোন দিয়েছে। জানতে চাইলো শব্দ করছি কেন। একটু লজ্জা পেয়ে গেলাম। বললাম বুঝতে পারি নি পাশের ঘরেও আওয়াজ শোনা যাবে। আপু গল্প করতে আমার রুমে আসতে চাইলো। আমি বললাম চলে আসতে। তিনি আসার পর কিছুক্ষণ গল্প করলাম। আসলে বয়সের ব্যবধান মাত্র এক বছর হওয়ায় আমরা অনেকটা বন্ধুর মতোই হয়ে গিয়েছিলাম। গল্পের মাঝেই দেশ থেকে আমার মায়ের ফোন আসল। মার সাথে কথা আর সূচনা আপুর সাথে গল্প শেষ করে শুয়ে পড়লাম।

মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো, আর আমি বুঝতে পারলাম অস্বাভাবিক কোন কারণেই এমন অসময়ে ঘুমটা ভেঙেছে। কিছুক্ষণ পর টের পেলাম প্রচণ্ড পেট ব্যথা করছে। ব্যথায় আমি নড়তে পর্যন্ত পারছি না। দেশ থেকে জরুরি সব ওষুধই এনেছিলাম, তাই অনেক কষ্ট করে টেবিল পর্যন্ত গিয়ে ওষুধ বের করতে শুরু করলাম। তার আগে দেখলাম টেবিলের উপর আগের দিন মারিকোর দিয়ে যাওয়া বিস্কিট আর চকোলেট এখনো আছে। আমি একটা বিস্কিট খেতে শুরু করলাম। আর এক বিস্কিটের এক টুকরো খাওয়ার সাথে সাথেই আমার ভাল লাগতে শুরু করলো। পেট ব্যথা কমে যেতে লাগলো। আসলে সেই সন্ধ্যাবেলায় রাতের খাবার খেয়ে ফেলায় অনেক ক্ষুধা লেগে পেট ব্যথা করছিল, তা প্রথমে বুঝতে পারি নি। তবে সেদিন মারিকোর দেয়া বিস্কিট না থাকলে আমার কী হতো জানি না। মারিকোর কল্যাণে সেদিন বড় বাঁচা বেঁচে গেলাম।

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।