শিবলী নোমান

টোকিও টাওয়ার থেকে (কিস্তি ০৫)

শিবলী নোমান

১৫ নভেম্বর, ২০১০, সোমবার

আজকে সকালে রিপোর্টিং টাইম ছিল ১০টা ২০ মিনিট। তাই আগে তিনজনে হোটেলের নিচে এসে নাস্তা করে নিলাম। নাস্তা করতে করতে জাফর ভাই সূচনা আপুকে কিছুক্ষণ ক্ষেপিয়ে মজা করলেন। কারণ জাফর ভাইয়ের হিসেবে দিনের শুরুতে সূচনা আপু যেমন থাকে, দিনের শেষে সব কাজ শেষ করে নাকি তার অর্ধেক হয়ে যায়, তাকে নাকি তখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। সূচনা আপুরও এক কথা, ক্লান্ত হয়ে গেলে কী করার আছে!

আজকে আমাদের সব লাগেজ আর ব্যাগ নিয়ে নিতে হবে। কারণ আজ থেকে তিন রাত আমার আর সূচনা আপুর বিভিন্ন মানুষে বাসায় রাতে ‘হোম স্টে’ করতে হবে। এটা প্রোগ্রামেরই অংশ। তাই সবকিছু নিয়ে ১০টা বাজার পরপরই নিচে নেমে গেলাম।

আজকে মারিকো আসে নি। তবে ইয়োশিকো এসেছে। ইয়োশিকোর সাথে এরই ভেতর সূচনা আপুর বেশ ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছে। আজ আমরা যাবো তাকাহামা জুনিয়র হাই স্কুলে। আজ থেকে আগামী তিন দিন আমারা তিনটি জুনিয়র হাই স্কুলে এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে অংশ নিবো। জাপানে জুনিয়র হাই স্কুল হলো আমাদের দেশের মাধ্যমিক স্কুলগুলোর মতো, তবে ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত; এরপর ওরা আবার হাই স্কুলে পড়ে। যাই হোক, আমরা রওনা হলাম তাকাহামা জুনিয়র হাই স্কুলের উদ্দেশ্যে। গাড়ির পেছনে সব লাগেজ আগেই উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। গাড়িতে আমাকে আর সূচনা আপুকে একটা করে কাগজ দেয়া হলো, যেখানে বিভিন্ন খাবারের নাম ও ছবি আছে। বলা হলো যেগুলো খেতে আমাদের আপত্তি নেই সেগুলোতে যেন টিক চিহ্ন দেই। আমরা গাড়িতে বসেই সেটি করে দিলাম।

জাপানের শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের দেশের চেয়ে একটু আলাদা। এখানে শিক্ষা ব্যবস্থা মূলত চার ভাগে বিভক্ত। এখানে ছয় বছর বয়সে বাচ্চাদের শিক্ষাজীবন শুরু হয়। যদিও এর আগে তিন বছর থেকে ছয় বছর পর্যন্ত কেউ চাইলে কিন্ডারগার্টেনে তার সন্তানকে পড়াতে পারে। কিন্তু মূল পড়ালেখাটা ছয় বছর বয়সে এলিমেন্টারি স্কুল থেকেই শুরু হয়। এরপর ১২ বছর থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত তিন বছর পড়তে হয় জুনিয়র হাই স্কুলে। জাপানে এলিমেন্টারি স্কুল ও জুনিয়র হাই স্কুলে পড়ালেখা করা বাধ্যতামূলক। এরপর কেউ চাইলে আর পড়ালেখা নাও করতে পারে। জুনিয়র হাই স্কুলে পড়ালেখার পর জাপানিরা আরো তিন বছর সিনিয়র হাই স্কুলে পড়ালেখা করে। এই হলো জাপানি মানুষের স্কুল জীবন। এরপর চার বছরের জন্য কোন কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে জাপানি মানুষেরা তাদের সাধারণ শিক্ষাজীবন শেষ করে ২২ বছর বয়সের ভেতর। এদিক দিয়ে আমরা বেশ পিঁছিয়েই আছি বলতে হবে।

যেহেতু ইন্টারন্যাশনাল ইয়ুথ এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম ১৬ থেকে ১৮ বছর বয়সীদের অংশগ্রহণে হচ্ছে, আর আমরা ইন্টারন্যাশনাল মিটিং-এ শিশু-কিশোরদের সঙ্কটগুলো নিয়ে কাজ করবো, তাই আগামী তিনদিন আমাদেরকে তিনটি জুনিয়র হাই স্কুল দেখানো হবে, যেন আমাদের কাজটা সহজ হয়। এ কারণেই আমরা জুনিয়র হাই স্কুলে যাচ্ছি।

তাকাহামা স্কুলে পৌঁছালে স্কুলের প্রিন্সিপাল আমাদেরকে স্বাগত জানালেন। বিদ্যালয়টির ভেতরে ঢুকেই আমি বুঝতে পারলাম আমাদের দেশের বিদ্যালয় আর জাপার বিদ্যালয়ের ভেতর কোন মিল নেই। ওদের বিদ্যালয়ের ভেতর সব চুপচাপ। হুটহাট শিক্ষার্থীদের কোন দল হয়তো কখনো একদম চুপ করে, আবার কখনো হইচই করে কোথাও ছুটে যাচ্ছে। বিদ্যালয়ে প্রবেশের পরই আমাদেরকে আমাদের পায়ের জুতা খুলে বদলে নিতে বলা হলো। এখানে নাকি এটাই নিয়ম, যেন বাইরের ধুলাবালি বিদ্যালয়ে প্রবেশ না করে। আমরা আমাদের জুতা খুলে এক ধরনের স্যান্ডেল পরে নিলাম।

এরপর আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হলো প্রিন্সিপালের কক্ষে। সেখানে দুই পাশে দুইটি টেবিল দিয়ে এক ধরনের আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। একপাশে আমরা বসলাম, আর আমাদের পেছনে আগের দিনের মতোই বসলো ইয়োশিকো। আর অন্যপাশে প্রিন্সিপাল ও অন্য কয়েকজন শিক্ষক। তাদের বিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য তারা আমাদেরকে ধন্যবাদ জানালেন। আমরা স্যারদেরকে কোট পিন পরিয়ে দিলাম। প্রিন্সিপাল স্যার আমাদেরকে জাপানের গ্রিন টি দিয়ে আপ্যায়ন করলেন। এই গ্রিন টি আমার কাছে খুবই বিস্বাদ লাগে কারণ এতে কোন চিনি দেয়া হয় না, অনেকটা পানসে হয়। তবুও হাসি মুখে খেয়ে নিলাম। আমাদের সাথে আজ আরেকজন ল্যাঙ্গুয়েজ ভলান্টিয়ার ছিলেন এখানে, মিস্টার মাতসুমোটো কেনজো। কিন্তু ইয়োশিকোই দোভাষীর কাজটা বেশি করছিল।

এরপর আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হলো স্কুলের জিমনেসিয়ামে। যেতে যেতে খেয়াল করলাম প্রিন্সিপাল স্যারের কক্ষ আর বিদ্যালয়ের প্রতিটা শ্রেণিকক্ষের দেয়াল একই রঙের। হালকা নীল আর হালকা সবুজ। কোথাও কোন পার্থক্য নেই। জিমনেসিয়ামে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে আমাদের জন্য একটি ওয়ালকাম পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। বিদ্যলাওয়ের জিমনেসিয়ামটা বিশাল। আমাদের দেশে যতটুকু মাঠ থাকলে আমরা একটা স্কুলে বড় মাঠ আছে বলি, সেই পরিমাণ বা তার চেয়েও কিছুটা বড় এই জিমনেসিয়াম। এখানে বাস্কেটবলের কোর্ট আছে কয়েকটা, বুঝলাম এখানে নিয়মিত ইনডোর গেইমস হয়। আমরা দেখলাম একপাশে মঞ্চের উপর একটা ব্যানার টাঙানো হয়েছে। সেখানে একপাশে জাপানি ভাষায় কিছু লেখা, আরেক পাশে লেখা ‘ওয়াআলাইকুমআস্‌সালাম’। এটি দেখে আমরা খুবই মজা পেলাম। সেখানে আমাদের উদ্দেশ্যে একজন ছাত্রী স্বগত বক্তৃতা দিলো। আমাদের তিনজনকেও কিছু বলতে হলো। আমরা সবাই মোটামুটি এমনটাই বললাম যে জাপানে আসার আগে আমরা বেশ ভয়ে ছিলাম, কিন্তু এখন জাপানিদের আতিথেয়তায় আমরা মুগ্ধ। আমাদের ভয় কেটে যাচ্ছে। এইসব কথা শেষ হলে আমাদেরকে জিজ্ঞেস করা হলো আমাদের দেশের পতাকার লাল বৃত্ত বামপাশে কিছুটা চাপানো কেন? আমরা যখন বললাম আমাদের পতাকার নকশাটাও এমন, তারা অবাক হয়ে গেলো কারণ তারা মনে করেছিল আমাদের পতাকার নকশাকারের ভুলের ফলে এমন হয়েছে। ওরা আমদেরকে এক ধরনের শৌখিন বাতি উপহার দিলো, যা শিক্ষার্থীরা নিজেরা বানিয়েছিল।

ওয়েলকাম পার্টির পর আমরা আবারও প্রিন্সিপাল স্যারের কক্ষে আসলাম। তখন সেখানে ঐ বিদ্যালয়ের একজন ছাত্রীকে নিয়ে আসা হলো, জাফর ভাই তাকে দেখেই জড়িয়ে ধরলেন। জাফর ভাইয়ের কাছ থেকে জানতে পারলাম এই ছাত্রীটি আগের বছর জাপানি প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশে গিয়েছিল। জাফর ভাই আর ওই মেয়েটির ভেতর কী জানি ফিসফাসও হলো এবং দেখলাম এক পর্যায়ে ছাত্রীটি একদম লাফিয়ে উঠে জাফর ভাইকে ইশারা করলো যেন সবাইকে কিছু একটা না বলে। জাফর ভাই ছাত্রীটির মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিলেন আর আমাদেরকে বাংলায় বললেন গত বছর বাংলাদেশে গিয়ে এই মেয়েটি হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, কিন্তু এ তার বিদ্যালয়ের কাউকে সেটি বলে নি দেখে এখন জাফর ভাইকে সেটি বলতে মানা করছে।

জাপানের বিদ্যালয়ে একটা মজার বিষয় হলো, এখানে ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক ও অন্য দেশ থেকে আসা শিক্ষকরা ছাড়া আর কোন শিক্ষকই তেমন ইংরেজি বলতে পারেন না। তাই সব সময়ই আমাদের ইয়োশিকোকে প্রয়োজন হচ্ছিলো। এর ভেতর ইয়োশিকো এসে আমাদের কাছে আজও জানতে চাইলো যে আমরা শৌচাগারে যেতে চাই কিনা। আমরা আজও তাকে না-সূচক উত্তর দিলাম।

দুপুর হয়ে যাওয়ায় আমাদেরকে শিক্ষার্থীদের সাথে খাওয়ার জন্য আমাকে আর সূচনা আপুকে একটি কক্ষে পাঠানো হলো। এই রুমে প্রতিদিন শিক্ষার্থীদেরকে বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে খাবার দেয়া হয়। আমি এক টেবিলে বসলাম আ,র সূচনা আপু আরেক টেবিলে। আর আমাদের সাথে দুই টেবিলে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। আমাদেরকে খেতে দেয়া হল মাছের বার্গার, দুধ এবং পরিচিত কিছু একটা। আমি মাছের বার্গার আর কিছুটা দুধ খেয়ে রেখে দিলাম। খেয়াল করলাম, আমি আর কিছু খাচ্ছি না দেখে আমাকে দেখিয়ে আশে পাশে বসে থাকা শিক্ষার্থীরা নিজেদের ভেতর হাসাহাসি করছে, আমিও তাদের দিকে তাকিয়ে বোকার মত হেসে কিছুটা প্রত্যুত্তর দেয়ার চেষ্টা করলাম।

খাওয়ার পর এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে আমরা ঐ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরকে আমাদের বানানো কার্ড উপহার দিলাম। আর ওরা আমাদের সাথে একটা খেলা খেলতে চাইলো। খেলাটিতে ওরা ১০ জন আমাদেরকে একবার করে ওদের প্রত্যেকের নাম বলবে। এরপর তাদের থেকে যে কারো নাম জিজ্ঞেস করলে আমাদেরকে তা মনে করে বলতে হবে। আমি দুই তিনজনের নাম বলতে পারলাম। যাদের নাম বলতে পারলাম তারা খুব অবাক হলো। আর যাদের নাম বলতে পারলাম না বা ভুল বললাম, তারা অনেক হাসলো। এরপর আমরা ছবি তুললাম আর এখানেও খেয়াল করলাম বেশিরভাগ জাপানিই ছবি তোলার সময় আঙুল দিয়ে ‘ভিক্টোরি’ চিহ্ন দেখায়, বুঝতে পারলাম এটাই জাপানিদের ছবি তোলার কায়দা। এরপর আমি যত ছবি তুলেছি, সব সময়ই দেখেছি ওরা এমন করে। ওদের সাথে সাথে আমিও প্রায়ই একইভাবে আঙুল দিয়ে ‘ভিক্টোরি’ চিহ্ন দেখিয়ে ছবি তুলেছি, এটা বেশ মজার লাগছিল আমার।

এরপর বিদ্যালয়ের প্রিন্সিপাল আমাদেরকে নিয়ে গেলেন টি-সেরেমনি নামক এক আয়োজনে। এটি নাকি জাপানের ঐতিহ্যবাহী বিষয়। কোন দাওয়াতে খাওয়া-দাওয়ার পর জাপানিরা নাকি এই বিশেষ ধরনের চা পান করে। আর এই চা বানানোর জন্য নাকি আলাদা প্রশিক্ষণও নিতে হয়, কারণ সবাই এই চা বানাতে পারে না। এই চা পানের বিষয়টিকেই টি-সেরেমনি বলা হয়। যাই হোক, আমাদেরকে একটি কক্ষে মাটিতে বসানো হলো। কীভাবে বসতে হবে তা আগে একজন দেখিয়ে দিলেন। আমরা তিনজন পাশাপাশি বসলাম। প্রথমে আমাদেরকে এক ধরনের মিষ্টি খেতে দেয়া হলো, মিষ্টি খাওয়ার জন্য একটা চোখা কাঠিও দেয়া হলো। আমি মিষ্টিটা খেয়ে দেখলাম, সেটা ছিল কড়া মিষ্টি আর কেমন বালি বালি। এরপর সূচনা আপুকে এক পেয়ালা চা দেয়া হলো কারণ সে একদম ডান পাশে ছিল। সে সেটা পান করলো। আমাদেরকে বলা হয়েছিল ভালো না লাগলে আমাদের পুরোটা খেতে হবে না। সূচনা আপু এক চুমুক খেয়ে আর খেলো না। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম জিনিসটা কেমন, বারবার জিজ্ঞেস করলাম। কিন্তু তিনি কিছু না বলে হয় মুচকি মুচকি হাসে, নাহলে আমাকে চুপ থাকার ইশারা করে। এই করতে করতে আমাকেও চা দেয়া হলো। চায়ের চেহারা দেখে তো আমার অবস্থা খারাপ। ঘন টিয়া রঙের কেমন একটা পানীয়। ঢোক গিলে এক চুমুক খেলাম। কোন স্বাদ নেই, চিনি নেই, কিছুই নেই, এর চেয়ে সকালের গ্রিন টি হাজার গুন ভালো ছিল। পানিতে ডুবে মরার ভয়ে আরেক চুমুক খেয়ে রেখে দিলাম। কিন্তু জাফর ভাই পুরোটাই খেলেন আর তার নাকি খুব ভালোও লেগেছে। জাফর ভাইকে দেখে তখন আমাদের কেমন জানি লাগছিল।

টি-সেরেমনি নামক বিভীষিকা থেকে মুক্ত হওয়ার পর প্রিন্সিপাল স্যার আমাদেরকে আরেকটি কক্ষে নিয়ে আসলেন। সেখানে তিনি তার ক্যালিগ্রাফির শখের কথা জানালেন। ক্যালিগ্রাফি হলো পাতলা কাগজে হাতে তৈরি কালি দিয়ে লেখা বা নকশা করা। তিনি এখন আমাদেরকে দিয়ে ক্যালিগ্রাফি করাবেন। জাফর ভাইয়ের কথা ভেবে মায়া লাগছিলো, কারণ তিনি সবকিছু শুধু দেখছিলেন। না পারছেন উঠে যেতে, না পারছেন কিছু করতে। যাই হোক, আমাদের দিয়ে কালি তৈরি করার পর প্রিন্সিপাল বললেন কাগজে কিছু একটা করতে। আমি তুলি দিয়ে আমার সামনের কাগজে একটা লম্বা টান দিলাম আর আইডি কার্ড দেখে জাপানি ভাষায় আমার নাম লিখলাম। এরপর প্রিন্সিপাল স্যার নিজেই আরো কী কী জানি লিখলেন। সূচনা আপুর ক্ষেত্রেও একই কাজ করলেন।

এই ছিল তাকাহামা স্কুলে আমাদের কার্যক্রম। এরপর স্কুলের পক্ষ থেকে আমাদেরকে পাশের মাকুহারি নিউ সিটি ন্যাচারাল গার্ডেনে নিয়ে যাওয়ার কথা হলো। আমরা স্কুলেরই এক শিক্ষকের নতুন কেনা গড়িতে উঠলাম। জাফর ভাই গাড়িটিকে বিমানের সাথে তুলনা করলেন। গাড়িটির সবকিছুই ছিল স্বয়ংক্রিয়। একটা জাতি শিক্ষকদের কী পরিমাণ আর্থিক ও সামাজিক মর্যাদা দিলে একজন জুনিয়র হাই স্কুল টিচারের এমন গাড়ি থাকতে পারে তা বুঝতে পারলাম। একই সাথে খারাপ লাগলো আমার দেশের শিক্ষকদের কথা ভেবে। জাপানের শিক্ষকরাও মানুষ বানানোর কারিগর, আমাদের শিক্ষকরাও তো তাই-ই!

আমরা মাকুহারি নিউ সিটির ন্যাচারাল গার্ডেনে চলে আসলাম। প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা একটি বাগানকে শুধু কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করে এত সুন্দর বানানো যায়, তা না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। লেকগুলোর উপর পায়ে হাটার জন্য ছোট ছোট সেতু, ছোট-বড় গাছের সমাহার, বসার জায়গা, সব মিলে দারুণ একটা পরিবেশ। পাশেই একটা মোটামুটি বড় আকারের ঘর। যারা এই বাগানে বেড়াতে আসেন, তাদের আপ্যায়নের জন্য এটি করা হয়েছে। আমরা সেখানে গেলাম। দুই সারিতে লম্বা লম্বা কাঠের বেঞ্চ সাজিয়ে রাখা হয়েছে বসার জন্য। বাগানের একজন মহিলা আমাদেরকে বসতে বললেন, তারা নাকি আমাদের আপ্যায়ন করতে চান। আপ্যায়ন নাকি করা হয় টি-সেরেমনির মাধ্যমে! শুনে তো আমি শেষ, আবার যদি ঐ চা খেতে হয় তাহলে নির্ঘাত বমি করে দিবো। তাই আগেই বলে দিলাম আমি আর চা খাচ্ছি না। কিন্তু জাফর ভাই ঠিকই আরেক কাপ চা পুরো শেষ করে ফেললেন। কীভাবে পারেন জাফর ভাই!

ন্যাচারাল গার্ডেনটা আসলে একটা নতুন করে গড়ে তোলা শহর অর্থাৎ মাকুহারি নিউ সিটির অংশ। এই নতুন শহরটা টোকিও উপসাগরের পাশেই। একজন শিক্ষক আমাদেরকে একটা উঁচু দালান দেখিয়ে বললেন, এটা ৪৮ তলা উঁচু, এর উপরের তলা থেকে টোকিও উপসাগর দেখা যায়। ইয়োশিকো বললো ঐ দালানের উপরের তলাতেই কয়েক বছর আগে তার বিয়ে হয়েছিল। আমি তো শুনে অবাক, ইয়োশিকোকে তো ভেবেছিলাম স্কুলের ছাত্রী! যাই হোক, উপর থেকে টোকিও উপসাগর দেখবো বলে আমরা সেই দালানে ঢুকলাম। জাফর ভাই আমাকে ধরে বললেন, আমি কিন্তু লিফট দিয়ে এত উপরে যাবও না। লিফট যদি ছিঁড়ে যায় বা আটকে যায় তাহলে সর্বনাশ, তুমি আমার সাথে থাকবা। আমি বললাম যে আমি উপরে যাব। পরে তিনি বললেন, আমি যাবো না। লিফটে উঠার সময় দেখি জাফর ভাইও চলে এসেছেন। জিজ্ঞেস করলাম যে উনি তো মানা করেছিলেন; তখন তিনি বললেন, বিদেশের মাটিতে একা একা থাকবো নাকি। আমরা যে লিফটে উঠেছিলাম সেটার আকার আমাদের ঢাকা শহরের বাসাগুলোর ছোট বেডরুমের সমান হবে। লিফট বেশ দ্রুতগতিতে আমাদেরকে ৪৮ তলায় পৌঁছে দিল। আমরা টোকিও উপসাগর দেখলাম আর কিছু ছবি তুললাম। এরপর আবার নিচে নেমে এলাম।

আমরা আবার বিদ্যালয়ে ফিরে আসলাম। সেখানে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হলো তাকাহামা স্কুলের ছাত্র ইউনো আর তার মায়ের সাথে। আমি আজ রাতে ইউনোদের বাসায় থাকবো। আর সূচনা আপু থাকবে একজন ছাত্রীর বাসায়। আর জাফর ভাই থাকবেন হোটেলে। বার্ডি হোটেল বেশি ছোট বলে তাকে আজ নতুন একটি হোটেলে রাখা হবে, হোটেল গ্রিন টাওয়ার।

আমি ইউনো আর তার মায়ের সাথে আমার ব্যাগ আর লাগেজ নিয়ে স্কুল থেকে হাটতে হাটতে ওদের বাসায় আসলাম। ওদের বাসাটা ছিল বেশ ছোট। ঢুকতেই করিডোরের বাম পাশে বসার ঘর, তার ঠিক উল্টো পাশে কিচেন আর শৌচাগার ও গোসলখানা। এরপর মূল করিডর ধরে বামপাশে ইউনোর বাবা-মার কক্ষ, আর ডান পাশে ইউনোর কক্ষ। আমি রাতে থাকবো বলে ইউনো আমাকে তার ঘরটা ছেড়ে দিল। আমি ঘরে ঢুকে কাপড় বদলে এসে বসার ঘরে বসলাম। তখন ইউনোর এক বন্ধু আর ইউনো এক্স বক্সে গেইম খেলছিল। ওরা কেউ ইংরেজি পারে না, তাই আমাকে ইশারায় বললো আমি খেলতে চাই কিনা। আমি বুঝিয়ে দিলাম যে আমি খেলতে পারি না, তাই আমি শুধু দেখতে চাই। তখন ওরা খেলতে থাকলো।

কিছুক্ষণ পর ইউনোর ঐ বন্ধুর মা আর বড় বোন আসলো। তারা বলল ইউনোর বাসায় কেউ ইংরেজি বলতে পারে না, তারা হালকা ইংরেজি বলতে পারে দেখে আমার সাথে কথা বলতে এসেছে। আমি তাদেরকে ধন্যবাদ দিলাম আমার সাথে কথা বলতে আসার জন্য। তারা জানতে চাইলো আমার জাপান কেমন লাগছে এবং আমি কীভাবে জাপানে আসার জন্যে নির্বাচিত হলাম, আমি তাদেরকে সব বললাম। জাপানে আসার জন্য নির্বাচির হতে আমাকে পরীক্ষা দিতে হয়েছে বলায় তারা খুব অবাক হলো। কিছুক্ষণ পর ইউনোর বাবাও অফিস থেকে চলে আসলেন।

আমি খেয়াল করলাম ইউনো বিদ্যালয় থেকে এসেই গেইম খেলতে বসে গিয়েছে আর তাকে কেউ কিছু বলছে না। ভাবতে লাগলাম ওরা পড়ালেখা করে কখন! পরে জেনেছিলাম ওরা সারাদিন বিদ্যালয়ে থাকে এবং বিদ্যালয়েই শিক্ষার্থীদেরকে ঠিকমতো পড়িয়ে দেয়া হয়, যেন বাসায় গইয়ে শিক্ষার্থীদের আর পড়তে না হয়। এটি জেনে আমি খুব বড় একটা হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলাম, কারণ আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা স্কুল থেকে এসেই আবার ঘাড়ে ব্যাগের বোঝা নিয়ে একবার এই টিচার তো আরেকবার ঐ কোচিং-এ দৌড়াদৌড়ি করে সময় কাটিয়ে প্রয়োজনীয় বিনোদনবঞ্চিত হয়।

একটু পর ইউনোর মা আমাদেরকে খেতে দিলেন। জাপানি পদ্ধতিতে রান্না করা সেই আঠালো ভাত আর জাপানিজ কারি। জাপানিজ কারি হলো বেশ ঘন ঝোল ঝোল করে আলু ভুনা। খেতে বেশ ভালো লেগেছিল। এরপর ইউনোর বন্ধুর বোন আমাকে বললো আমাকে বেশ সকালে উঠতে হবে। আমি বললাম যে আমি সেটি জানি। সে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ডু ইউ হ্যাভ অ্যারাম? আমি বুঝতে পারলাম না, বললাম আরেকবার বলতে। সে আবার বললো, ডু ইউ হ্যাভ অ্যারাম? অ্যারাম? আমি বললাম, অ্যারাম? হোয়াট অ্যারাম? তখন ওরা বুঝলো আমি কথা বুঝতে পারছি না। তখন মেয়েটা ওর হাতের ঘড়ি দেখিয়ে বলল, অ্যারাম? আমি বুঝলাম সে অ্যালার্ম ঘড়ি আছে কিনা জানতে চাচ্ছে। আমি বললাম, ওহ অ্যালার্ম? সে বললো, ইয়েস, ইয়েস, অ্যারাম। আমি তখন বললাম যে আমার কাছে অ্যালার্ম ঘড়ি আছে। সকালে উঠতে কোন সমস্যা হবে না। এরপর ওরা চলে গেলে ইউনোর মা আমাকে অনেকগুলো চকোলেট আর কয়েকটা নোটবুক দিলেন। তখন আমি বুঝলাম সকালে ইয়োশিকোকে খাবার তালিকার যে কাগজে টিক চিহ্ন দিয়ে দিয়েছিলাম সে অনুযায়ীই আমাকে খাওয়ানো হচ্ছে। আমার জন্য এটা ভালোই হলো।

খাওয়া দাওয়া সব শেষ হওয়ার পর আমি গোসল করে যখন ঘুমাতে যাচ্ছি, তখন ইউনোর মা এসে জানতে চাইলেন আমার কিছু লাগবে কিনা। মানে আকারে ইঙ্গিতে বুঝালেন আর কী! আমি বললাম যে একটা গ্লাস হলেই হবে। তিনি সব বুঝে গেছেন এমন ভাব করে কোথায় জানি গেলেন, আর একটা টাওয়েল এনে আমাকে দিলেন। আমি হেসে দিয়ে তাকে পানি খাওয়ার ইশারা করলাম। তখন তিনি আবারও সব বুঝে গেছেন এমন ভাব করে কোথাও গেলেন, আর একটা পানিভর্তি জগ নিয়ে ফিরলেন। আমি তাকে হেসে দেখালাম আমার কাছে পানি আছে, আর ভালোভাবে দেখালাম যে আমার পানি খাওয়ার গ্লাস দরকার, তখন তিনি আমাকে একটা গ্লাস এনে দিলেন। আমি তাকে বললাম আরিগাতো গোজায়মাস, অর্থাৎ ধন্যবাদ। তিনিও মাথা নিচু করে আমার কথা সায় দিলেন আর দরজা বন্ধ করে চলে গেলেন।

হোম স্টে যতটা কঠিন হবে ভেবেছিলাম তেমন হয় নি। বিষয়টা বেশ সহজই মনে হচ্ছে এখন। আমি এক গ্লাস পানি খেয়ে ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে শুয়ে পড়লাম।

 

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।