শিবলী নোমান
১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের যে বাজেট ঘোষণা করা হয় তার আকার ছিল অতিক্ষুদ্র। যুদ্ধবিদ্ধস্ত একটি দেশের অর্থনীতিতে সেই বাজেটও অনেক সাহসী হিসেবেই দেখা হয়েছিল তা ধারণা করা যায়। তখন মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকার জাতীয় বাজেট ঘোষণা করেছিলেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মহান জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদ। গত অর্থবছরে অর্থাৎ ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটের আকার ছিল দুই লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকা। প্রতিবছরই বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটের আকার বাড়ছে এবং তা রেকর্ড ভঙ্গ করেই বাড়ছে।
সূচনা করা আলোচনা থেকে এ বিষয়টি নিশ্চিত যে বর্তমান লেখাটি বাংলাদেশের জাতীয় বাজেট নিয়ে কথা বলবে। কোন প্রকার দ্বিমত এতে নেই কারণ জাতীয় বাজেট সন্নিকট। ধারণা করা হচ্ছে আগামী ২ জুন, ২০১৬ তারিখে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করা হবে। তাই সময়টাই এখন বাজেট নিয়ে আলোচনা করার। আর দেশের সাধারণ নাগরিক হিসেবে প্রিন্ট ও ব্রডকাস্ট মিডিয়ার ‘এজেন্ডা সেটিংস’ এর বাস্তবতায় পড়ে আমিও এখন বাজেট নিয়েই কথা বলব, এমনটাই তো হওয়ার কথা ছিল!
একটি দেশের জাতীয় বাজেট শুধু টাকার অঙ্কে পরিমাপ করার বিষয় নয়। এতে জড়িয়ে থাকে দেশের অর্থনৈতিক কিংবা মানবিক উন্নয়নের মত বিষয়গুলো। কিন্তু লক্ষ্য করে থাকি এবং খুব আগ্রহ নিয়েই লক্ষ্য করি যে, প্রতিবছর বাজেট ঘোষণার সময় হলেই আমাদের মূল আগ্রহের জায়গা তৈরি হয় বাজেটের আকার নিয়ে। হয়ত এ বছরের আলোচনার বিষয় হল, এবারের বাজেট তিন লাখ কোটি টাকা তো ছাড়াবেই, সেটি বাড়তে বাড়তে সাড়ে তিন লাখ কোটি হবে কিনা। কিংবা আরেকটু বেড়ে চার লাখ কোটি হয়ে যাবে কিনা।
কিন্তু হতাশার কথা হতাশ হয়েই বলতে হয় যে, এই আলোচনাগুলো জাতীয় বাজেট নিয়ে খুব স্থূল আলোচনা। আরেকটি বিষয় হল, বাজেট ঘোষণার পর বাজেটের বর্ণনামূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করেই আমাদের মিডিয়া তাদের দায়িত্ব শেষ করে। সম্পূরক বাজেট কিংবা বাজেট সংশোধনী নিয়ে ততটা আলোচনা করতে দেখা যায় না যতটা দেখা যায় প্রাক-বাজেট সময়ে। সেই সাথে জনগণের জন্যে ঘোষিত বাজেট নিয়ে যেসব প্রতিবেদন করা হয় তা কতটা জনবান্ধব হয়, আপনি কিংবা আমি নিজে ঐ প্রতিবেদন পড়ে বাজেটটা কতটুকু বুঝি আর কতটুকু বুঝব না ভেবে ফেলে রাখি তা নিয়েও আলোচনা হতে পারে।
বাজেট নিয়ে মিডিয়ার আচরণকে তুলে রেখে এবার আসুন বাজেট নিয়েই একটু ভেবে দেখি। প্রতিবছর বাজেটের আকার বাড়ছে সংখ্যার দিক থেকে। প্রতিবছর প্রবৃদ্ধিও বাড়ছে একটু একটু করে। যদিও প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে অসন্তুষ্টি আছে বিভিন্ন মহলে, বর্তমান অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি সাত শতাংশ ধরা হলেও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বর্তমান ও আগামী অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি পূর্বাভাস দিচ্ছে সাত শতাংশের নিচে। অথচ ২০২১ সালের ভিতর মধ্যম আয়ের দেশ হতে হলে আট শতাংশ প্রবৃদ্ধি প্রয়োজন প্রতি বছর।
প্রবৃদ্ধির এসব কটমটে হিসাব ভালো না লাগলে আসুন সাধারণ বিষয় নিয়ে কথা বলি। বলা হচ্ছে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ২৯ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছে, মাথাপিছু আয় গত মাসে ছিল ১,৪৬৬ মার্কিন ডলার, এখন হয়ত আরো বেড়েছে, তাহলে দেশের উন্নতি হচ্ছে তা তো বলাই যায়। হ্যা, এসব পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই যে এগিয়ে যাওয়া তার সুফল কি সাধারণ মানুষ পাচ্ছে? যদি পেয়ে থাকে তাহলে ঠিক আছে কিন্তু না পেয়ে থাকলে তার কী হবে? তারপরও কি বলতে হবে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে?
জানুয়ারি মাসে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার উপ-সম্পাদকীয়তে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম লিখেছিলেন দেশে যুব বেকারত্ব বেড়েছে, বিনিয়োগ বাড়ে নি। তাহলে কিভাবে বলব দেশে প্রয়োজনীয় উন্নয়ন হচ্ছে? প্রবৃদ্ধি বা ব্যাংক রিজার্ভ বা মাথাপিছু আয়ের সংখ্যাগুলোই যদি উন্নয়ন হয় তাহলে বলতে হয় এসব সংখ্যাগত উন্নয়নের ফলে জীবনে কতটুকু ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে সে মানুষটির যিনি রোজ সকালে আমার হলের করিডোর ঝাড়ু দেন কিংবা তার যার টং দোকানে আমি চা খাই কিংবা খোদ আমার? বলার মত তেমন কোণ পরিবর্তন নেই। আমি বলছি না দেশে উন্নয়ন হচ্ছে না, বলতে চাচ্ছি উন্নয়নের সুফল আমরা তথা সাধারণ মানুষ পাচ্ছি না। আর বাজেটে কাজ করতে হবে এসব ক্ষেত্রেই।
ডাডলি সিয়ার্স একটি কথা বলেছিলেন, “মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ হওয়ার পরও দেশে যদি বেকারত্ব, বৈষম্য এবং দারিদ্রতা থাকে তাহলে তাকে উন্নয়ন বলা আশ্চর্যজনক।” তাই শুধু সংখ্যাগত উন্নয়ন নয় বরং মানব উন্নয়ন হয় এমন খাতে বাজেটে বরাদ্দ করতে হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষির মত খাতগুলোতে প্রতিবছর বরাদ্দ শতকরা হিসেবে কমানো হচ্ছে। এসব জনমুখী খাতে বরাদ্দ না কমিয়ে যদি বাড়ানো হয় তাহলে উন্নয়ন অনেক বেশে দৃষ্টিগ্রাহ্য হবে তা বলাই বাহুল্য। বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিবছর সরকারকে এসব খাতে বরাদ্দ বাড়াতে আহ্বান জানানো হলেও ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায় খুব কম। এসব খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে মানব উন্নয়ন করতে পারলেই অর্থনৈতিক তথা সংখ্যাগত উন্নয়নের সুফল সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া সম্ভব হবে তা ভুলে গেলে চলবে না।