শিবলী নোমান

বাজেট পরবর্তী বিচ্ছিন্ন ভাবনা

শিবলী নোমান

২০১৬-১৭ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট ঘোষণা হয়ে গেলো আজ ২রা জুন। কিছু দিন আগে বাজেট নিয়ে কিছু বিচ্ছিন্ন ভাবনার কথা লিখেছিলাম। তাই বাজেট ঘোষণার পর আরও কিছু বিচ্ছিন্ন ভাবনা মাথায় এসে জড়ো হতে বেশি সময় লাগে নি। আগের লেখায় লিখেছিলাম বাজেটের আকার নিয়ে জল্পনা-কল্পনার কথা। তবে জল্পনা-কল্পনা বেশি ডালপালা মেলতে পারে নি কারণ মাননীয় অর্থমন্ত্রী বাজেটের আকার নিয়ে কল্পনার ডালপালা ছেটে দিয়েছেন ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকাতেই। তবে তারপরও এই বাজেটকে উচ্চাভিলাষী বলছেন অনেকে। বাজেটের আকার বৃদ্ধি পাওয়াই সঙ্গত মনে করি তাই আমি অন্তত বাজেটের আকার দেখে একে উচ্চাভিলাষী বলতে রাজি নই বরং অনেকটা নাটকীয়ভাবে হলেও অবচেতন মনে আমি বাজেটের আকার আরও বড় আশা করেছিলাম বলে মনে হচ্ছে।

বাজেট ঘাটতি কিংবা বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা (এডিপি)-র মত কটমটে অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে আমি মাথা ঘামাতে চাই না। তবে কিছু বিষয় নিয়ে আমার বেশ আগ্রহ তৈরি হয়েছে ইদানিং। আমি বাজেটে খাতওয়ারী বরাদ্দ দেখলাম সময় টেলিভিশনের ওয়েবসাইট থেকে। জেনে খুশি লাগছে যে এবার শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে যা মোট বাজেটের ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ। তবে এই বরাদ্দ আমাদের দেশের জনসংখ্যার তুলনায় প্রতুল না অপ্রতুল তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে একটি ভিন্ন কিন্তু আগ্রহোদ্দীপক ডিসকোর্স কারন বিভিন্ন বাম ছাত্র সংগঠন বছরের পর বছর ধরে শিক্ষা খাতে জাতীয় বাজেটের ২৫ শতাংশ বরাদ্দের দাবি করে আসছে ঘটা করে প্রতি বছরই। আবার বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তন না করে শুধু আর্থিক বরাদ্দ বাড়িয়ে আমাদের শিক্ষাখাতকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে কিনা, এগিয়ে যাওয়াটা সঙ্গত হবে কিনা তা নিয়েও আলোচনা এখন সময়ের দাবি বলে মনে হচ্ছে।

শিক্ষা থেকে চলুন চলে আসি স্বাস্থ্য খাতে। বাজেট নিয়ে প্রচারিত সংবাদগুলো দেখে জানতে পেরেছিলাম শিক্ষার পাশাপাশি এবার স্বাস্থ্যখাতেও গুরুত্ব দিচ্ছেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু বাজেটের মাত্র ৪ দশমিক ৭ শতাংশ স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ করা হয়েছে দেখে নিতান্তই হতাশ হয়েছি। যে গতিতে আমরা উন্নয়ন করতে চাই সেখানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষিখাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ করতেই হবে। এটি ঠিক যে গতবছরের তুলনায় স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বেড়েছে কিন্তু একই প্রশ্ন এখানেও চলে আসে যে বিশাল একটি জনসংখ্যার স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন কিংবা ন্যুনতম স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্যে এই বরাদ্দটুকু বাস্তবসম্মত কিনা তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে এবং হওয়া উচিত বলে মনে করি।

কৃষিভিত্তিক দেশ হিসেবে জাতীয় বাজেটে কৃষি খাত নিয়েই আমাদের আলোচনা সবার আগে হওয়ার কথা থাকলেও শহুরে বাঙালি হিসেবে আমার লেখায় কৃষি পিছিয়েই গেলো। কিন্তু তাতে কৃষিখাতের গুরুত্ব কমবে না একটুও। ১৯৭২-৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় বাজেটের আকার ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা, এই বাজেটে কৃষি খাতে বরাদ্দ ছিল প্রায় ১০১ কোটি টাকা। শতাংশের হিসেবে এটি ঐ বাজেটের প্রায় ১৫ শতাংশ। সদ্য স্বাধীন একটি কৃষিপ্রধান দেশের উন্নয়নের মোটিভ বুঝতে পেরেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যোগ্য অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ কৃষিখাতে জাতীয় বাজেটের প্রায় এক-সপ্তমাংশ বরাদ্দের সাহস দেখিয়েছিলেন বলে মনে হয়। আমাদের জাতীয় জীবনে কৃষির ভূমিকা যেহেতু আগের চেয়ে কমে যায় নি তাই দিন দিন এই খাতে বরাদ্দের দাবিও বৃদ্ধি পেয়েছে। বামপন্থী দলগুলো জাতীয় বাজেটের ৪০ শতাংশ কৃষিখাতে বরাদ্দের দাবি জানিয়েছে বারংবার। কিন্তু এবারও জাতীয় বাজেটে কৃষিখাতে বরাদ্দ মাত্র ৩ দশমিক ৮ শতাংশ যা আগের চেয়ে মাত্র দশমিক ৪ শতাংশ বেশি।

আমি বারংবার কৃষি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত নিয়ে কথা বলি কারণ আমি বিশ্বাস করি উন্নয়নের যে মহাসড়কে আমরা নিজেদের সচল করতে চাই, অর্থৎ মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় নিজেদের নাম উঠাতে হলে এবং প্রকৃত উন্নয়নের মাধ্যমে সেটি করতে হলে প্রয়োজন আমাদের মানব সম্পদের অগ্রগতি। আর মানব সম্পদের অগ্রগতির পূর্বশর্তই হল শিক্ষা, কৃষি ও স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন, অন্তত বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে তো বটেই।

চিন্তার আরেকটি বিষয় হল জিডিপি প্রবৃদ্ধি। সহজ কথায় আগের বছরের তুলনায় দেশের অভ্যন্তরে উৎপাদিত পণ্যের শতকরা বৃদ্ধির হারি হল জিডিপি প্রবৃদ্ধি। যেহেতু আমরা ২০২১ সালের ভিতর মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে পরিচিত হতে চাই সে হিসেবে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে হবে প্রায় আট শতাংশ। কিন্তু আমরা এখনো সাতের ঘর অতিক্রম করতে পারছি না কেন আর এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক বা এডিবি কেন ২০১৬-১৭ অর্থবছরেও আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি সাতের নিচে থাকবে বলে পূর্ভাবাস দিচ্ছে তা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষণও জরুরি মনে করছি। একই সাথে দেশের সার্বিক আয় বৈষম্য, বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও বেকারত্ব দূরীকরণেও কাজ করতে হবে তা স্পষ্ট হয় এসব বিষয়ের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান দেখে।

তাই বিশাল আকারের বাজেট দেখে স্বস্তিবোধ করার কোন সুযোগ দেখছি না, কারণ এখনো পাড়ি দিতে হবে বহুদূর।

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।