শিবলী নোমান

থিয়োঙ্গো ও জাতীয়তাবাদের সংকট

শিবলী নোমান

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগে পৃথিবীর অন্তত ৮০ শতাংশ ভূখণ্ড ইউরোপের ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর অধীনে ছিল। অর্থাৎ এই বিশাল ভৌগলিক এলাকা ও এর অধিবাসীরা ছিল উপনিবেশিত। এই ঔপনিবেশিক অভিজ্ঞতা সম্ভবত পৃথিবীর এই সিংহভাগ মানুষের অন্যতম সধারণ তথা কমন অভিজ্ঞতা। যদিও এসব উপনিবেশের নিয়ন্ত্রণে আলাদা আলাদা ঔপনিবেশিক শক্তি বিদ্যমান ছিল, তথাপি এসকল ঔপনিবেশিক শক্তিই ইউরোপীয় হওয়ায় হয়তো বলাই যায় যে, পুরো পৃথিবী আদতে ছিল ইউরোপীয় উপনিবেশের অধীনে শাসিত। এটিকে হয়তো ঔপনিবেশিক যুগের আরেকটি সাধারণ অভিজ্ঞতা বা বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে।

বিশ্বব্যাপী এই ঔপনিবেশিক শাসনের যে উত্থান, তার ভেতর সবচেয়ে কৌতুহলজাগানিয়া সম্ভবত আফ্রিকা মহাদেশের উপনিবেশায়ন। ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো পারস্পরিক সংঘাত এড়িয়ে ১৮৮৪-৮৫ সালের বার্লিন কনফারেন্সের মাধ্যমে একটি বিশাল অঞ্চলকে নিজেদের ভেতর ভাগ-বাটোয়ারা করে নেওয়ার এই দৃষ্টান্তকে, তথাকথিত এনলাইটেনমেন্ট প্রকল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বা ফলাফল হিসেবে চিহ্নিত করা যায় কিনা তা নিয়ে আলোচনা বা বিতর্ক হতেই পারে। কিন্তু এসব আলোচনা আসলে ইউরোপের আলোচনা।

ইউরোপকেন্দ্রিক আলোচনা থেকে দূরে থেকেও যে বিষয়ে ইউরোপের সাবেক উপনিবেশগুলোর কথা থেকে যায়, তা হলো বিউপনিবেশায়ন। কারণ যেখানেই উপনিবেশের পর্দা উঠেছিল, তারই প্রতিক্রিয়া হিসেবে বিউপনিবেশায়নেরও উদ্ভব ঘটেছিল অনেকটা তাৎক্ষণিক ও আবশ্যিক বিষয় হিসেবে। উপনিবেশিত এলাকাগুলোর দখল অর্জন কিংবা শোষণ পদ্ধতি আলাদা হলেও বিউপনিবেশায়ন ঠিকই কোনো না কোনোভাবে সব উপনিবেশেই উপস্থিত ছিল বলে ধারণা করা যায়।

আফ্রিকার এই বিউপনিবেশায়ন প্রক্রিয়ার একজন অগ্রসৈনিক হিসেবে নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গোকে চিহ্নিত করা যেতে পারে। মনোজগতের বিউপনিবেশায়ন নিয়ে থিয়োঙ্গোর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রচনা হলো ডিকলোনাইজিং দ্য মাইন্ড শীর্ষক চার অধ্যায়ে বিভক্ত তার বইটি, যেটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৬ সালে। এই বইতে থিয়োঙ্গো আফ্রিকান সাহিত্য, থিয়েটার ও ফিকশনের ভাষা কেমন হওয়া উচিত, তা নিয়ে অত্যন্ত ক্রিটিক্যাল ও রাজনৈতিক অবস্থান থেকে আলোচনা করেছেন। একই সাথে আলোচনা করেছেন কীভাবে আফ্রিকান সাহিত্য, থিয়েটার ও ফিকশন তার প্রাসঙ্গিকতার খোঁজ পেতে পারে তা নিয়ে।

ডিকলোনাইজিং দ্য মাইন্ড পড়লে থিয়োঙ্গোকে আগাগোড়া জাতীয়তাবাদী বলেই মনে হয়। তিনি এই গ্রন্থে ১৯৬২ সালে উগান্ডার কামপালায় আয়োজিত মাকারেরে কনফারেন্স নিয়ে বেশ ব্যাঙ্গাত্মক বর্ণনাই তার বইতে করেছেন, কারণ এই কনফারেন্সে শুধু তাদেরই প্রবেশাধিকার ছিল যারা আফ্রিকান কিন্তু সাহিত্যচর্চা করেন ইংরেজি ভাষায়। থিয়োঙ্গো মনে করেন ইংরেজি কিংবা অন্য যে কোনো ঔপনিবেশিক ভাষায় সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে যে কোনো জাতিকে তাদের স্বতন্ত্র সংস্কৃতি, চর্চা ও জীবনাচরণ থেকে দূরে সরিয়ে রেখে নব্য-ঔপনিবেশিক ও  সাম্রাজ্যবাদী বুর্জোয়া শক্তিই আখেরে লাভবান হয়ে ওঠে। থিয়োঙ্গো এসব ঔপনিবেশিক ভাষাকে সাম্রাজ্যবাদী ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। একই সাথে তিনি মনে করেন যে, উপনিবেশের পরিচয় গোপন করে যে নব্য-উপনিবেশ সাবেক উপনিবেশগুলোতে গড়ে উঠেছে, তার ক্রমবর্ধমান বিস্তৃতি ধরে রাখার জন্যেই সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো তাদের সাবেক উপনিবেশগুলোর ভাষা ও সাহিত্যজগতে এমন ঔপনিবেশিক প্রবাহ চলমান রাখাকে জরুরি মনে করে। আর এজন্যেই ইউরোপ ও হাল আমলের উত্তর আমেরিকা তথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্নভাবে এসব ঔপনিবেশিক তথা সাম্রাজ্যবাদী ভাষায় সাহিত্যচর্চা করা সাবেক উপনিবেশের মানুষদের পুরস্কার, ভাতা, সম্মান ইত্যাদির মাধ্যমে পৃষ্ঠপোষকতা করে যায় দিনের পর দিন।

এই যে নানা উপায়ে সাবেক উপনিবেশকে একটি নব্য-উপনিবেশে পরিণত করে রাখার প্রক্রিয়ার দিকে থিয়োঙ্গো আঙুল নির্দেশ করছেন, সেই নব্য-ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্তি কোথায়? থিয়োঙ্গো বলতে চান নিজ জাতিসত্তার ভাষা চর্চার ভেতরেই রয়েছে এই সমস্যা তথা আত্মপরিচয় সংকটের সমাধান। থিয়োঙ্গো একজন অ্যাক্টিভিস্টও বটে! অথবা আরেকটু এগিয়ে গিয়ে তাকে গ্রামসির অরগানিক তথা জৈব বুদ্ধিজীবীও বলা যেতে পারে। কারণ তিনি শুধু সমাধান দেখিয়ে বসে থাকেননি, বরং সেই পথে অনেক দূর হাঁটার চেষ্টাও করেছেন। তিনি একরকম ঘোষণা দিয়েই ইংরেজি ভাষায় দীর্ঘদিনের সাহিত্যচর্চা বাদ দিয়ে তার নিজস্ব মাতৃভাষা গিকুয়ুতে সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। পুরো ডিকলোনাইজিং দ্য মাইন্ড বইতে বারংবার থিয়োঙ্গো তার আফ্রিকান ভাইদের ভেতর এই জাতীয়তাবাদী চেতনা ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন।

এক্ষেত্রে থিয়োঙ্গো মনে করছেন ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের মাধ্যমেই বেরিয়ে আসা সম্ভব নব্য-ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী বুর্জোয়া প্রকল্প থেকে। বিংশ শিতাব্দীর ইতিহাসে জাতীয়তাবাদকে এই ধরনের সঙ্কটের সমাধান হিসেবে গ্রহণ করার প্রবণতা যে খুব স্বাভাবিক ও অনেকাংশেই সঠিক ছিল ইতিহাসও হয়তো সেই সাক্ষ্যই দেয়।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, একটি পর্যায় পর্যন্ত এই জাতীয়তাবাদী চেতনা বিউপনিবেশায়ন তথা নব্য-ঔপনিবেশিকতা ও সাম্রাজ্যবাদী বুর্জোয়া কার্যক্রমকে প্রতিহত করতে পারলেও সময়ের সাথে সাথে এই চেতনা কি প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠতে পারে? পৃথিবীর ইতিহাসে জাতীয়তাবাদী চর্চা চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে সাধারণত উগ্র জাতীয়তাবাদেই কি পরিণত হয় নি? আর্যদের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করার তত্ত্ব থেকে কি হিটলারের উত্থান ঘটেনি? কিংবা প্যালেস্টাইনের মুসলমান ও খ্রিষ্টানদের ওপর যে অত্যাচার গত প্রায় ১০০ বছর ধরে জায়নবাদের সমর্থকরা করে আসছে, সেই জায়নবাদ কি এক অর্থে উগ্র ইহুদি জাতীয়তাবাদ নয়? অথচ ইহুদিদের ওপর বিভিন্ন জাতি, ধর্ম কিংবা সাম্রাজ্যের মানুষের অত্যাচারের ইতিহাস রয়েছে অন্তত প্রায় আড়াই হাজার বছরের। ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশনস-এ স্যামুয়েল পি. হান্টিংটন সভ্যতাসমূহের ভেতর যে সংকটের কল্পনা করেছেন কিংবা ভবিষ্যত খুঁজে পেয়েছেন তার পেছনে কি কোনো না কোনোভাবে ধর্মীয় বা রাজনৈতিক বা জাতিগত জাতীয়তাবাদ উপস্থিত নেই?

রুডল্‌ফ রকার তার এক রচনায় বলেছিলেন, জাতীয়বাদের চরিত্রই আসলে কোনো না কোনোভাবে প্রতিক্রিয়াশীল। অর্থাৎ জাতীয়তাবাদী চর্চা চূড়ান্ত রূপধারণ করলে তা থেকে নেতিবাচকতার উদ্ভব ঘটাই খুব স্বাভাবিক। তাহলে কি থিয়োঙ্গোর পন্থা ভুল? নাকি জাতীয়তাবাদী যে চেতনার কথা আমরা প্রায়শই বলে থাকি তা ভুল বা ত্রুটিপূর্ণ?

খুব খেয়াল করলে দেখা যাবে প্রতিটি জাতীয়তাবাদের প্রকৃত উত্থান আসলে ঘটে কোনো না কোনো ধরনের বৈষম্যমূলক অবস্থা থেকে উত্তরণের একটি প্রগতিশীল চিন্তাধারা হিসেবে। যেখানে মূল কথাই থাকে জাতিগতভাবে স্বায়ত্তশাসিত কিংবা স্বশাসিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু প্যারাডক্স হলো এই প্রগতিশীল চিন্তা যখন কোনো না কোনোভাবে বাস্তবায়িত হয়ে সামনে আসে, ঠিক তখনই কোথাও একটা কিছু হয়ে যায়। হুট করেই এই প্রগতিশীল চেতনা সমাজের কিছু অংশের জন্যে বেদনাদায়ক, কষ্টকর ও চাপিয়ে দেওয়া বিষয়ে পরিণত হয়।

যে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের কথা থিয়োঙ্গো বলেন তার একটি মূল শর্তই হলো প্রতিটি আফ্রিকান ভাষাকে তার যোগ্য অবস্থানে স্থাপিত করতে হবে আর অন্য সকল ভাষার অবস্থান স্বীকার করে নিতে হবে। অর্থাৎ একটা পর্যায়ের পর আসলে ছাড় দিতে হবে, দিতে হয়। নাহলে সেখানে এমন এক ধরনের ভুল হয়ে যায় যার ইতিবাচক সমাধান পরবর্তী সময়ে খুঁজে পাওয়া কঠিন। থিয়োঙ্গোর ডিকলোনাইজিং দ্য মাইন্ড বইতে জাতীয়তাবাদী চেতনার এই রাশ টেনে ধরার প্রয়োজনীয়তার কথাটি খুব একটা স্পষ্ট করে থিয়োঙ্গো বলেননি। হয়তো যে সময় থিয়োঙ্গো বইটি লিখেছেন তখন এই ছাড়টুকু দেওয়ার কথা উল্লেখ করার বাস্তবতা থিয়োঙ্গোর সামনে ছিল না। কিন্তু যে কোনো ধরনের উগ্রতার মতো উগ্র জাতীয়তাবাদকেও প্রতিহত করা ছাড়া কি মানুষের পৃথিবী গড়ে তোলা সম্ভব?

(রচনাকাল: অক্টোবর, ২০২০)

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।