শিবলী নোমান
১৯৭৮ সালে প্রকাশিত এডওয়ার্ড সাঈদের বিখ্যাত রচনা অরিয়েন্টালিজম-এ সাঈদ দেখিয়েছিলেন কিভাবে ইঙ্গ-ফরাসি সাহিত্যজগতে প্রাচ্যকে চিত্রায়িত করা হয়েছে। সাঈদের এই বই প্রকাশের আগে ও পরে তাই অরিয়েন্টালিজম বা প্রাচ্যতত্ত্বের অর্থ আর এক থাকে নি। সাঈদ প্রাচ্যতত্ত্ব বলতে বিভিন্ন ধরনের রচনায়—যা হতে পারে সাহিত্যিক কিংবা বিদ্যায়তনিক—এক ধরনের ‘ভূরাজনৈতিক সচেতনতার সঞ্চার’-কে বুঝিয়েছেন। অর্থাৎ প্রাচ্য ও প্রাচ্যের মানুষকে নিয়ে ইউরোপীয়দের বিভিন্ন রচনার পেছনে মূল উদ্দেশ্য হিসেবে যখন এক ধরনের ভূ-রাজনৈতিক সচেতনতা কাজ করে, তাকেই সাঈদ বলতে চাচ্ছেন প্রাচ্যতত্ত্ব। ইউরোপ তথা ইঙ্গ-ফরাসিদের এই চেতনা মূলত ছিল ভৌগলিক আধিপত্য আদায়ের তথা উপনিবেশ স্থাপনের চেতনা। আর এই চেতনাকে বাস্তবে রূপ দেয়ার পরিস্থিতি বা শর্ত তৈরি করার জন্যেই তারা তাদের নিজেদের রচনায় প্রাচ্য ও প্রাচ্যের মানুষকে বছরের পর বছর নামানুষ বা অমানুষ বা উনমানুষ হিসেবে উপস্থাপন করে গিয়েছে।
যে মজার বিষয়টি এডওয়ার্ড সাঈদ তাঁর অরিয়েন্টালিজমে উল্লেখ করছেন তা হলো, ইঙ্গ-ফরাসিদের যেসব রচনার মাধ্যমে পাশ্চাত্যের মানুষের মস্তিষ্ক ও মনের ভেতর প্রাচ্য ও প্রাচ্যের মানুষের এহেন প্রতিচ্ছবি বা ধারণা গুজে দেয়া হলো, সেসব রচনার রচয়িতাদের অনেকেরই আসলে প্রাচ্য সম্পর্কে কোন ধারণা ছিল না, অনেকের ধারণা ছিল নানাভাবে ত্রুটিপূর্ণ। তারপরও শতাব্দীর পর শতাব্দী প্রাচ্যের এসব ত্রুটিপূর্ণ উপস্থাপনই মূলধারার উপস্থাপন হিসেবে টিকে থেকেছে এবং প্রাচ্যের মানুষের উপর পাশ্চাত্যের মানুষের প্রভাব বিস্তারের নানা প্রকল্পের পেছনে যুক্তি হিসেবে কাজ করেছে। এসব রচনা ও উপস্থাপনকে কাজে লাগিয়েই পাশ্চাত্য বা অক্সিডেন্টের মানুষজন প্রাচ্যকে শোষণের বৈধতা তৈরি করে নিয়েছে নিজেদের ভেতর। এ থেকে আরেকটি মজার বিষয়ে আলোকপাত করা যায় যে প্রাচ্য সম্পর্কে এই যে কখনো কাল্পনিক, কখনো আধা-কাল্পনিক কিংবা কখনো ত্রুটিপূর্ণ উপস্থাপন ও রচনা, তার টার্গেট অডিয়েন্স বা লক্ষ্য ছিল আসলে পাশ্চাত্যেরই মানুষজন। অর্থাৎ পাশ্চাত্যের মানুষেরা পাশ্চাত্যের মানুষদেরই প্রাচ্যের মানুষ সম্পর্কে ধারণা দেয়ার জন্যে, প্রাচ্য ও প্রাচ্যের মানুষের উপর নিজেদের আধিপত্য বিস্তারকারী প্রকল্পগুলো বৈধভাবে জারি রাখতেই এসব রচনার মাধ্যমে পাশ্চাত্যের মানুষদের তুলনামূলক শ্রেষ্ঠ ও সভ্য বলে প্রচার করেছে।
অরিয়েন্টালিজমে সাঈদ যেভাবে পাশ্চাত্যের দ্বারা প্রাচ্যের প্রাচ্যায়নের দিকে ইঙ্গিত করেছেন, সেই প্রাচ্যতত্ত্ব মূলত ইঙ্গ-ফরাসি ঔপনিবেশিক যুগের প্রাচ্যকে চিত্রায়নের চেষ্টাকে বেপর্দা করে। অর্থাৎ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত যে ঔপনবেশিক পৃথিবী বর্তমান ছিল এবং যার কেন্দ্রে ছিল ব্রিটিশ ও ফরসিরা, সেই ঔপনিবেশিক সময়ে প্রাচ্যকে উপস্থাপন রীতিই সাঈদ তাঁর অরিয়েন্টালিজমে তুলে ধরেছেন। সাঈদের অরিয়েন্টালিজম প্রকাশের পর পাশ্চাত্যের এই প্রকল্প নিশ্চিতভাবেই ধাক্কা খেয়েছে, কিন্তু থেমে যায় নি তা আরও বেশি নিশ্চিত। বরং আমাদের বর্তমান বাস্তবতা ও নিকট অতীতের অভিজ্ঞতা বলে প্রাচ্যের উপর ইউরোপের আধিপত্যর স্থলে বিশ্বব্যাপী মার্কিন আধিপত্য ছড়িয়ে পড়েছে আরও নগ্নভাবে। উদার পুঁজিবাদ পরিণত হয়েছে একচেটিয়া পুঁজিবাদে; যার ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছেলেন ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের ম্যাক্স হকহেইমার।
পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থায় স্থানীয় পণ্ডিত-সাহিত্যিকদের দিয়ে প্রাচ্য তথা যেখানে সাম্রাজ্যবাদ খুঁটি গেড়ে বসতে চায় তার চিত্রায়ন বা উপস্থাপনের রীতি এখন বেশ পুরনো হয়ে গেছে বলে মনে করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী ইরানি অধ্যাপক হামিদ দাবাশি। এক্ষেত্রে তিনি ‘বেনিয়া বুদ্ধিজীবী’ বা ‘কম্প্রেডর ইন্টেলেকিচুয়াল’ ও ‘স্থানীয় তথ্যদাতা’ বা ‘নেটিভ ইনফর্মার’ নামক দুইটি শব্দবন্ধের সাথে তাঁর পাঠকদের পরিচিত করাতে চান। দাবাশি বলতে চান, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে যে একমেরুর বিশ্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার সাম্রাজ্যবাদ চালিয়ে নেয়ার জন্যে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে এই বেনিয়া বুদ্ধিজীবী ও স্থানীয় তথ্যদাতাদের ব্যবহার করে চলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউরোপীয় মিত্ররাও করছে একই কাজ।
দাবাশি তাঁর প্রস্তাবনায় বলছেন ইউরো-মার্কিন অক্ষ তাদের প্রধান শত্রু ও ভীতি হিসেবে ইতোমধ্যেই ইহুদিদের থেকে সরে এসে ইসলামকে চিহ্নিত করেছে। ‘ইসলামোফোবিয়া’ তাঁর হিসেবে এখনকার সময়ের ‘অ্যান্টিসেমিটিজম’। আর নিজেদের জনগণের ভেতর এই ইসলামোফোবিয়া আরও বেশি মাত্রায় ছড়িয়ে দেয়ার জন্যে ইউরো-মার্কিন জোটের প্রয়োজন যত বেশি সম্ভব বেনিয়া বুদ্ধিজীবী ও স্থানীয় তথ্যদাতাদের। কেন?
এডওয়ার্ড সাঈদের মতে যেসব বুদ্ধিজীবী নির্বাসনে থাকতে বাধ্য হন, নির্বাসন তাঁদের জন্যে ইতিবাচক হয়ে দেখা দেয়। থিওডোর আডর্নোসহ আরও অনেকের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেছিলেন, এসব বুদ্ধিজীবীর নির্বাসনে থাকা সময়গুলোই কোন না কোনভাবে তাঁদের মূল অবদানকে প্রভাবিত করেছিল। সহজভাবে বললে ঐ নির্বাসনের প্রভাবেই এসব বুদ্ধিজীবী তাঁদের জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজগুলো করার প্রেরণা বা দৃষ্টিভঙ্গি বা অন্তর্দৃষ্টি লাভ করেছিলেন। সাঈদের এই অবস্থানের বিপরীতে দাঁড়িয়ে হামিদ দাবাশি বলতে চাচ্ছেন, নিশ্চিতভাবেই সাঈদ ভুল বলেন নি, কিন্তু বর্তমানে কিছু পরিবর্তিত পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে। ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এখন একদল বুদ্ধিজীবী দেখা যাচ্ছে যারা মূলত এমন সব দেশের বাসিন্দা যেসব দেশের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী লিপ্সা রয়েছে। এই বুদ্ধিজীবীরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে অবস্থান করে ইউরো-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের হয়ে কাজ করেন নিয়মিত। এই বুদ্ধিজীবীদের ভেতর মার্কিন যুদ্ধবাদীতার পরিণতিতে যে বেসামরিক ক্ষয়ক্ষতি তার প্রতি এক ধরনের সামষ্টিক স্মৃতিবিলোপ যেমন কাজ করে তেমনি নিজেদের দেশের ও সমাজের ব্যাপারেও থাকে কিছু নির্দিষ্ট স্মৃতি মাত্র; মূলত তাদের দেশের ভালো কোন কিছুই তাঁদের তৎপরতা বা কর্মকাণ্ডে প্রকাশ পায় না। আবার তাঁরা এ কারণে তাঁর দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির নিন্দা করেন না কারণ তাঁরা এর অবসান বা পরিবর্তন তথা তাঁর দেশের মানুষের প্রকৃত মুক্তি চান। বরং তাঁদের রচনা ও কর্মকাণ্ডের মূল উদ্দেশ্য থাকে ইউরো-মার্কিন সাধারণ জনগণকে এটি বুঝানো যে ঐসব ‘অসভ্য’ দেশের কারণে ইউরো-মার্কিন জনগণ হুমকিতে আছে এবং নিজেরদের ও ঐসব দেশের সাধারণ মানুষের মুক্তির জন্যে ঐসব দেশে মার্কিন সামরিক অভিযান জরুরি ও যুক্তিযুক্ত। এর বিনিময়ে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে এসব বুদ্ধিজীবী পাচ্ছেন আর্থিক নিশ্চয়তা, সামাজিক পরিচিতি ও নিয়মিত মিডিয়া কাভারেজ। এ কারণেই তাঁরা আসলে ‘বেনিয়া’। আর যেহেতু অসত্য বা মিথ্যা যাই হোক, নিজের দেশের বিষয়ে তথ্য দিয়ে থাকেন, তাই তাদের বলা হচ্ছে ‘স্থানীয় তথ্যদাতা’।
দাবাশি বিভিন্ন সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত এমন বেনিয়া বুদ্ধিজীবিদের নিয়ে লেখালেখি করেছেন। স্বাভাবিকভাবেই এদের অধিকাংশ ইরানি এবং ইরানের সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়ে এমনতর প্রচারণা চালিয়ে থাকেন যেন এই মুহূর্তেই ইরানে মার্কিন সামরিক অভিযান ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই। দাবাশি নিজেও ইসলামি বিপ্লব পরবর্তী ইরানি সমাজ ও রাজনৈতিক অবস্থার প্রতি ক্রিটিক্যাল, কিন্তু তাঁর মতে এর সমাধান মার্কিন আগ্রাসন হতে পারে না। বরং সমাধান আসতে হবে ইরানি সমাজের ভেতর থেকেই।
সাঈদের অরিয়েন্টালিজম মূলত সেমিটিক আরব ও মিশর নিয়ে আলোচনা করে কিংবা দাবাশির আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে আফগানিস্তান, ইরাক ও ইরানের প্রতি মার্কিন অভিসন্ধি। কিন্তু প্রাচ্যের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ইস্যুতেও নানা দেশের স্বার্থরক্ষাকারী বেনিয়া বুদ্ধিজীবীদের উত্থান ঘটার সম্ভাবনা নাকচ করে দেয়া যায় কি? কিংবা এরই ভেতর এমনতর বুদ্ধিজীবীদের উপস্থিত থাকার সম্ভাবনাও কি কোন না কোনভাবে থেকে যেতে পারে না? এসব ক্ষেত্রে মার্কিন অভিসন্ধি দূরের বিষয় মনে হলেও—যা আসলে দূরের নয়—ঐতিহাসিকভাবে ভারত বা পাকিস্তান কিংবা অধুনা চীন কিংবা রাশিয়ার স্বার্থসিদ্ধিতে উদ্ভূত বেনিয়া বুদ্ধিজীবীদের উপস্থিতি ও তৎপরতা নিয়ে কি ভাবা উচিত নয়?
আর যদি বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে ভাবা প্রসঙ্গে এই খেয়াল চাপে যে, আপনি-আমি-আমরা অতি সাধারণ মানুষ হয়ে কেন বুদ্ধিজীবীদের স্বরূপ নিয়ে ভাববো? তাহলে গ্রামসিকে স্মরণ করেই শেষ করা যাক। গ্রামসি বলেছিলেন সব মানুষই আসলে বুদ্ধিজীবী তবে সমাজে বুদ্ধিজীবী রূপে কাজ করার অবস্থা সবার জন্যে বিদ্যমান থাকে না।
তাই বলি কী, বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে ভাবা জরুরি, খুব বেশিই!
(রচনাকাল: নভেম্বর, ২০২০)