শিবলী নোমান

ইংরেজি লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা-ই, ‘প্রযুক্তি’ নয়

শিবলী নোমান

ভাষাভাষীর হিসেবে বাংলা পৃথিবীতে বর্তমানে প্রচলিত ভাষাগুলোর ভেতর সপ্তম অবস্থানে আছে, এই তথ্য বেশ পুরনো। তবে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত এক সংবাদ থেকে তথ্যটি পুনরায় সত্যয়িত হয়েছে। এই সংবাদের তথ্য অনু্যায়ী পৃথিবীতে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত শীর্ষ ১০০টি ভাষার ভেতর বাংলার অবস্থান ৭ম, এই ভাষায় কথা বলে প্রায় সাড়ে ২৬ কোটি মানুষ। পৃথিবীর জীবন্ত ৭,১১১টি ভাষা নিয়ে কাজ করা এক গবেষণা প্রবন্ধ থেকে এই তথ্য পাওয়া যায়।

ভাষাভাষীর হিসেবে বাংলা ভাষার এই শীর্ষস্থানে থাকার বাস্তবতা আমলে না নিলেও আমাদের ইতিহাস থেকে আমরা এই কথাট বারংবার জেনে এসেছি যে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত ভাষা আন্দোলনই মূলত বাঙালি জাতীয়তাবাদের বীজ রোপন করেছিল। তাছাড়া এও বলা হয় যে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর যে কোন অন্যায্য আচরণের বিপরীতে আমাদের এই ভূখণ্ড থেকে যেসব প্রতিবাদ ও আন্দোলন হয়েছে তার সূচনাবিন্দু হলো ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন। তাছাড়া ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে ২১শে ফেব্রুয়ারি তারিখে বাংলাদেশের মানুষের ভাষা শহীদ দিবস বর্তমানে পালিত হচ্ছে বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। এসব বিবেচনায় ভাষাগত দিক থেকে আমাদের মাতৃভাষার ঐতিহ্য গর্ব করার মতোই।

কিন্তু বিপরীত চিত্রও কি নেই? আমাদের উচ্চ আদালতসহ বিভিন্ন দপ্তরে এখনও বাংলা ভাষার প্রবেশাধিকার নেই। বিভিন্ন বিভাজনে ক্লিষ্ট শিক্ষাব্যবস্থায় একটি ধারাই তৈরি হয়েছে ইংরেজি মাধ্যম তথা ইংলিশ মিডিয়াম হিসেবে, যা মূলত অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল কিংবা অতিস্বচ্ছল পরিবারগুলোর এক ধরনের মর্যাদার ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। কারণ ইংরেজি ভাষায় পারদর্শীতা অর্জনই যদি ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষার লক্ষ্য হয়ে থাকে, তাহলে প্রচলিত বাংলা মাধ্যমে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করা শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষায় সাফল্য অর্জনের যুক্তি দুর্বল হয়ে যায়, যেহেতু উচ্চশিক্ষার মাধ্যম মূলত ইংরেজি ভাষা (এ কথাও ঠিক যে উচ্চশিক্ষার ভাষা নিয়েও আলোচনা জরুরি)। অন্যদিকে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাব্যবস্থার বিপরীতে বাংলাকে অন্তত মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষার একমাত্র মাধ্যমে পরিণত তো আমরা করিই নি বরং ইংরেজি মাধ্যমের বিকল্প হিসেবে দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্যে উদ্ভব হয়েছে ইংরেজি ভার্সন নামক আরেক ধারার শিক্ষা ব্যবস্থার। ইংরেজি মাধ্যম কিংবা ভার্সন উভয় ধারার সমর্থকগণই ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জনকেই এসব ধারায় শিশুদের পাঠদানের কথা বলেন। তবে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা স্পোকেন ইংলিশ রপ্ত করতে পারলেও (যদিও সে প্রক্রিয়া বিতর্কের বাইরে নয় এবং অনেকটাই ঔপনিবেশিক) ইংরেজি ভার্সনের শিক্ষাদানের অবস্থা এখন পর্যন্ত বেশ বেগতিক মনে হয়, ফলে আগে বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা বাংলা ভাষার পাশাপাশি ইংরেজিতে প্রাথমিক দক্ষতা অর্জন করলেও এখন বাংলা ভাষাতেও অদক্ষ হয়ে বেড়ে উঠছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো কী আছে ইংরেজি ভাষায়?

ইংরেজি ভাষায় শিক্ষাদানের কিংবা ইংরেজি ভাষা চর্চার পক্ষের লোকেরা অহরহ যে কথাটি বলেন তা হলো বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় ইংরেজি আদতে কোন ভাষা নয়, বরং এটি একটি টেকনোলজি বা প্রযুক্তি। ইংরেজি সম্পর্কে এই অবস্থানের মূল অংশে যাওয়ার আগেই বলে নিতে হয় যে এই বক্তব্যের ‘বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা’ শব্দটিই আসলে ইংরেজির প্রতি গুরুত্বারোপের গুরুত্ব নিয়ে ঘোরতর প্রশ্ন উত্থাপন করে দিয়ে যায়। কারণ এই ‘বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা’ যে কোন মুহূর্তেই কিংবা একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে একেবারেই উল্টে যেতে পারে। ঠিক যেমনটি বলা যায় ল্যাটিন ভাষার ক্ষেত্রে। এক সময় যে কোন ধরনের বিদ্যায়তনিক চর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল এই ভাষা এবং বিদ্যায়তনিক চর্চার অংশ হিসেবেই এই ভাষায় শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহণ ছিল মর্যাদাপূর্ণ। এমনকি আফ্রিকার উপনিবেশিত এলাকায় প্রতিষ্ঠিত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কিছুকাল আগেও ল্যাটিন ভাষাকে আলাদা গুরুত্ব দেয়া হতো মধ্যযুগে এই ভাষার রাজকীয় মর্যাদা ও ক্ষমতার জন্যে। কিন্তু বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় তা কি কেবলই সেকেলে ও ক্ষেত্রবিশেষে অপ্রয়োজনীয় নয়?

অন্যদিকে ভেবে দেখা জরুরি যে, ইংরেজি ভাষা কি আদৌ টেকনোলজি বা প্রযুক্তি নাকি একটি পছন্দ বা চয়েজ? ভেবে দেখা এও জরুরি যে আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে বিশ্বস্তরে চর্চার জায়গায় পৌঁছে দিতে না পারা—যার একটি উদাহরণ হতে পারে গুগল ট্রান্সলেটরে বাংলার দুরবস্থা—ও ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার হিসেবে ইংরেজির আমাদের দেশের স্বীকৃত দ্বিতীয় ভাষা হওয়ায় এবং যে কোন ধারার শিক্ষাব্যবস্থায় দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ন্যুনতম ইংরেজি শিক্ষাদানের ফলেই কি আমরা ইংরেজি ভাষার সাথে পরিচিত হই না? অন্যদিকে আমাদের বাস্তবতায় তৃতীয়, চতুর্থ কিংবা পঞ্চম ভাষা রপ্ত করার বিষয়টি খুব বেশি প্রচলিত নয়। তাই বাংলার পরই আমাদের মূল ভরসার জায়গা ইংরেজি, তার অবস্থা যতই ভাঙাচোড়া ও অশুদ্ধ হোক না কেন। এছাড়া আকাশ সংস্কৃতির কারণে দেশে কথ্য হিন্দী ভাষা জানা একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী গড়ে উঠেছে, যারা মূলত ভোক্তাশ্রেণি।

এমন পরিস্থিতিতে আমাদের জন্যে বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক গ্যাজেট ও অনলাইনে অপ্রচলিত ধরনের বাংলা ভাষা ব্যবহার না করে ইংরেজি ভাষা ব্যবহার ছাড়া আর কোন বিকল্প আছে? কারণ কথ্য হিন্দী ভাষা জানা মানুষের সংখ্যা বিপুল হলেও লেখ্য হিন্দী না জানা মানুষের সংখ্যাটাও তার সমানুপাতিকই বলা যায়। সেক্ষেত্রে ইংরেজি ছাড়া আমাদের বৃহৎ অংশের কাছে কোন বিকল্পই তো নেই। তাই এসব ক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার আমাদের জন্যে চয়েজ বা পছন্দের স্তরেও থাকে না, বরং হয়ে যায় ধ্রুব বাস্তবতা কিংবা বাধ্যবাধকতা, যার অন্য কোন ভালো বিকল্প নেই। আর এই দুর্বল স্থানের কারণেই অনেকের কাছে ইংরেজি ভাষা পরিণত হয় বা একে পরিণত করা হয় প্রযুক্তি হিসেবে। আবার একথাও পরিষ্কার যে ব্রিটিশ উপনিবেশের অংশ না হয়ে আমরা যদি ১৯০ বছর ফরাসি কিংবা পর্তুগিজ কিংবা ডাচ উপনিবেশ হিসেবে থাকতাম তাহলে ইংরেজি ভাষার স্থলে ফরাসি, পর্তুগিজ কিংবা ডাচ ভাষাকেই আমরা তথাকথিত প্রযুক্তি হিসেবে জাহির করার চেষ্টা করতাম, যদি এসব হলেও হতে পারতো ঔপনিবেশিক শক্তির ভাষিক ক্ষেত্রে শাসনপ্রক্রিয়া ব্রিটিশদের অনুরূপ হতো এবং আমাদের মনোজগতে বিদ্যমান উপনিবেশের আঙ্গিক অনুরূপ হতো।

তাই ইংরেজি ভাষা ছাড়া আজকের পৃথিবীতে চলা যায় না, এ এক ফাঁকিবাজি বুলি। বরং ইংরেজি ছাড়া আমরা চলতে পারছি না আমাদের দুইটি দুর্বলতার কারণে। প্রথমত, আভ্যন্তরীণ ও বহিঃস্থ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এখনও বাংলা ভাষার ব্যাপক ব্যবহারের প্রচলনে ব্যর্থ হয়ে বা তার জন্যে ন্যুনতম উদ্যোগই না নিয়ে; এবং দ্বিতীয়ত, অন্ততপক্ষে তৃতীয় কোন ভাষা জানা না থাকায় ইংরেজি ভাষার প্রতি অতিনির্ভরশীল হয়ে। যখনই দৈনন্দিন ক্ষেত্রগুলোতে বাংলা ভাষার ব্যাপক ব্যবহারের প্রচলন সম্ভব হবে এবং বিভিন্ন গ্যাজেট ও অনলাইনে শুদ্ধ ও চর্চিত বাংলা ভাষাকে স্থান দেয়া যাবে তখন যেমন এই অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব, একই সাথে যখনই ইংরেজির সাথে কিংবা ইংরেজিকে বাদ দিয়ে অন্য কোন ভাষা আমরা শিখে নিবো তখনই কিন্তু ইংরেজির প্রতি নির্ভরশীলতা কমতে শুরু করবে। মনে রাখা জরুরি ইংরেজি ভাষাকে একটি প্রযুক্তি হিসেবে জাহির করার ভেতর আমাদের কোন সুবিধা নেই, বরং সুবিধা নিহিত আছে বাংলা ভাষার ব্যবহার বৃদ্ধির ফলে ইংরেজি ও অপরাপর ভাষাগুলোকে আদতেই নিতান্ত চয়েজ বা পছন্দের ব্যাপারে পরিণত করতে পারায়।

আরেকটি কথা মনে রাখা জরুরি, ইংরেজি ভাষা যে সামনের দিনগুলোতে লিংগুয়া ফ্রাঙ্কা হিসেবে থাকবেই, বৈশ্বিক রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক পরিসরে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। ১০০ বছর আগেও খুব বেশি মানুষ ইংরেজির এভাবে লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কায় পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা দেখতে পায় নি। একইভাবে আগামীতে যদি মান্দারিন ভাষা বৈশ্বিক লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কায় পরিণত হয় (যেমনটা ভেবেছিলেন স্যামুয়েল পি. হান্টিংটন) তাহলে এই ইংরেজি ভাষা তথা প্রযুক্তির ভবিষ্যত কল্পনা করুন। তাহলেই অনেকটা পরিষ্কার হয়ে যেতে পারে নিজের ভাষায় দৈনন্দিন চর্চাবৃদ্ধি ও তাকে ছড়িয়ে দেয়ার পেছনের যুক্তিসমূহ।

(রচনাকাল: জানুয়ারি, ২০২১)

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।