শিবলী নোমান
গত ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ তারিখ অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বহুল আকাঙ্ক্ষিত’ ৬ষ্ঠ সমাবর্তন। আট বছর পর অনুষ্ঠিত এই সমাবর্তন ঘিরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সকল অংশীজনের উৎসাহ-উদ্দীপনা প্রকাশ পেয়েছে তাদের আলোচনা-সমালোচনা-উচ্ছ্বাস-হতাশাসহ আরো বহুবিধ অনুভূতির প্রকাশে, অনলাইন বা অফলাইন উভয় মাধ্যমে।
২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ সমাবর্তনের পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণির সনদ লাভ করায় ২০২৩ সালের এই সমাবর্তনে আমার একজন গ্র্যাজুয়েট হিসেবে অংশ নেয়ার সুযোগ ছিল। তবে একেবারেই ব্যক্তিগত কিছু ভাবনা থেকে সমাবর্তনে অংশ নেই নি।
সমাবর্তনের তারিখ নিশ্চিত হওয়ার পর আমার যেসব বন্ধু-জুনিয়র ও শিক্ষার্থীরা জানতে পেরেছেন আমি সমাবর্তনে অংশ নিচ্ছি না, তারা কারণ জানতে চেয়েছেন। বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন কারণ আমি তাদের বলেছি। তো এই সুযোগে সবগুলো কারণ এক জায়গায় তোলা থাকতে পারে।
অর্থাৎ রাষ্ট্র-সমাজ কিংবা নিদেনপক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণগত মান পরিবর্তনের মহৎ কিংবা অতিমহৎ চিন্তাবিষ্টতায় মগ্ন না থাকা এসব ব্যক্তিগত ভাবনাগুলো তুলে ধরার একটি সুযোগ পাওয়া গেলো আশেপাশের বন্ধু-শুভানুধ্যায়ীদের কৌতুহলের কারণে।
প্রথমত, আমি মনে করি সবকিছুর একটি নির্দিষ্ট সময় থাকে। অর্থাৎ সনদ লাভের এক থেকে দুই বছরের ভেতর সমাবর্তনকে ঘিরে একজন সমাবর্তনপ্রত্যাশীর ভেতর যে ধরনের আকাঙ্ক্ষা ও উৎসাহ থাকার কথা, সাড়ে পাঁচ বছর পর এসে আমার সেই উৎসাহে ভাটা পড়েছে অনেকটাই। আর সমাবর্তনের অর্থ যদি সিনিয়র-বন্ধু-জুনিয়রদের সাথে আরেকবার দারুণ সময় কাটানোর সুযোগ হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে বলতেই হয় সমাবর্তনের জন্য নিবন্ধন না করেও সেই আনন্দ তো পেয়েছি পুরোটাই। এই যেমন সমাবর্তনের পর যখন একে একে সবাই আমার বাসা ছেড়ে নিজ নিজ গন্তব্যের পথে, তখন আমার ভেতর হু হু ডাক এই বলে যে, “আয় আর একটিবার আয়রে সখা…”।
দ্বিতীয়ত, আমার বাবা প্রায়শই বলতেন, “কামাই করলে বুঝবা টাকা কামাইতে কেমন কষ্ট!” আবার তার কাছেই শুনছি ‘বাপের হোটেল’-এর নাম নাকি ‘আনন্দ হোটেল’, অর্থাৎ যে হোটেলের সবকিছুতেই আনন্দ। তো সমাবর্তন পেতে পেতে যেহেতু নিজের কর্মজীবনে প্রবেশের প্রায় ছয় বছর হয়ে গেলো, আর যেহেতু শিক্ষকতার চাকরি ব্যতীত অন্য কোন উপার্জনের উৎসও আমার নেই, তাই এই মুহূর্তে হাজার চারেক টাকা খরচ করে সমাবর্তন নেয়ার বিষয়ে দ্বিতীয়বার ভাবার সুযোগ ছিল। যদিও সামনের দিনগুলোতে আসলেই যদি মূল সনদের প্রয়োজন পড়ে, তাহলে হয়তো টাকা ধার করে হলেও তা তুলে ফেলবো। অর্থাৎ এই সময়ে মূল সনদ উত্তোলনের জন্য সমাবর্তন নেয়া আমার অগ্রাধিকার তালিকায় ছিল না।
তৃতীয়ত, আমার সমাবর্তনের সময় আমার মা-বাবাকে ক্যাম্পাসে নিয়ে আসবো, এমন কোন ভাবনা আমার ভেতর ছিল কিনা তা নিয়ে আমি নিশ্চিত নই। আমি কখনো গভীরভাবে এই বিষয়ে ভাবি নি। তবে সমাবর্তন নিয়ে আমার ছোট বোনের বহু পরিকল্পনা ছিল। যার ভেতর অন্যতম ছিল সমাবর্তনের সময় মা-বাবাকে ক্যাম্পাসে নিয়ে যাওয়া। গত নভেম্বরে নিজের সমাবর্তন পাওয়ায়, আর তার মাস দুয়েক আগে মা চলে যাওয়ায় তার সেই ইচ্ছা বা স্বপ্ন, কোনটাই পূরণ হয় নি। পরে তার সমাবর্তনে সে একাই গিয়েছে। যেহেতু দাঁত হারালে দাঁতের মর্ম বুঝি, তাই এখন সমাবর্তনের কথা আসলে অবচেতন মনেই মাথায় আসে, হয়তো মা-কে নিয়ে আসতাম; ফলে সমাবর্তন নেয়াটা এক দিক থেকে অর্থহীন মনে হয়েছে।
তবে জীবন অদ্ভুত! যেখানে মায়ের মৃত্যুকে বলছি সমাবর্তনে অংশ না নেয়ার একটি কারণ হিসেবে, সেখানেই বাবার ইচ্ছা পূরণের জন্য সমাবর্তনের গাউন ধার করে ছবিও তুলে রাখতে হয়েছে বটে!
এছাড়া চাকরির বাজারের যে বাস্তবতায় আমরা আমদের গ্র্যাজুয়েটদের ছেড়ে দিচ্ছি, সেই বাস্তবতা মাথায় থাকলে সমাবর্তন ঘিরে এত আনন্দ-উচ্ছ্বাসে ভাটা পড়তেই পারে। তবে চাকরির বাজার বুঝে গ্র্যাজুয়েট তৈরি করা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কিনা, সেই অনন্ত বিতর্ক তো বহুকাল ধরেই চলে আসছে।
আরেকটি কথা লিখে শেষ করতে চাই, বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববদ্যালয়েই শিক্ষকতা করায় গ্র্যাজুয়েট হিসেবে সমাবর্তন না নিয়ে, শিক্ষক হিসেবেও সমাবর্তনে অংশ নেয়ার একটি সুযোগ আমার সামনে ছিল। সেক্ষেত্রে উপরোক্ত কারণগুলো বাধা হতে পারতো না, যেহেতু এই অংশ নেয়া হতো কর্মসূত্রে। তবে গ্র্যাজুয়েট হিসেবে সমাবর্তনে অংশ না নেয়ার পেছনে থাকা ব্যক্তিগত কারণগুলো নিয়ে কোন ধরনের সন্দেহ বা প্রশ্ন উঠুক, তা চাইনি বলেই কর্মসূত্রেও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ সমাবর্তন সম্পর্কিত অনেক কিছু থেকেই কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখেছিলাম।
তবে দিনশেষে বলতেই হয়, সমাবর্তনকে ঘিরে এত এত সিনিয়র-বন্ধু-জুনিয়রের সাথে দেখা হওয়া এক বিশেষ ঘটনা। বন্ধু ও প্রিয়জনদের নিয়ে গত দুইদিন যেন ছিল এক টাইম ট্রাভেল, আমাদের ছাত্রজীবনের দিনগুলোতে। যদিও দিন শেষে অমোঘ বাস্তব এই যে, “এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর”। তবু কী এক নিরন্তর চেষ্টা আমাদের ফিরে যাওয়ার, অতি নিশ্চিন্ত এক অতীত জীবনে।
আগামী সমাবর্তনে দেখা হবে, প্রিয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। আশা করি সেই দেখা হওয়াটা হবে খুব দ্রুতই!
পড়লাম। বেশকিছু অংশের সাথে আমার চিন্তার মিল আছে। কারণ যাই হোক, ‘নিজের ইচ্ছায় বেঁচে থাকা’ সহজ হোক। শুভ কামনা।
কঠিনেরে ভালোবাসিলাম। অনেক ধন্যবাদ!
আপনার সকল ব্যাখ্যা আমার বিশেষ ভালো লেগেছে। এটা এবার আমিও লক্ষ্য করেছি। যেহেতু আমার খুব কাছের কয়েক জন বন্ধু ব্যবসায় প্রশাসন ও আইন ও বিচার বিভাগের হয়ে এই সমাবর্তনে অংশ নিয়েছে ফলে তাদের মাঝে যে উচ্ছাস দেখেছি, সে উচ্ছাস আমার কাছের সিনিয়রদের দেখিনি যারা পেশা জীবনে সফল তবুও। কোথাও যেন আনন্দের ঘাটতি রয়েছে।
সর্বোপরি, আপনার আশার বাণী সত্য হোক। আমরা খুব শীঘ্রই আবার আরেকটি সমাবর্তনে মিলিত হই, এই কামনা।
শুভকামনা থাকলো। ধন্যবাদ!