শিবলী নোমান

ধার করা বিদ্যার কতিপয় মুসিবত

শিবলী নোমান

ধার করা যে কোন কিছু নিয়েই নানা ধরনের সঙ্কট থাকে, বা সময়ের সাথে সাথে বিভিন্ন সঙ্কট দেখা দেয়। তো বিদ্যার্জনের ক্ষেত্রে ধার করা হলে এই সঙ্কট কোন কোন ক্ষেত্রে আরো বেশি গভীর হয়েই দেখা দিতে পারে, পরিণত হতে পারে মুসিবতে।

প্রথম কথা হলো, ধার করা বিদ্যা বলতে আসলে কী বুঝানো হচ্ছে? ধার করা বিদ্যা বলতে বুঝানো হচ্ছে আমাদের বিদ্যায়তনে আলোচিত এমন সব সমস্যার সমাধান বা ভাবনা, যেগুলো আমাদের স্থানীয় সমস্যাকে মাথায় রেখে তৈরি হয় নি। অর্থাৎ, ভিনদেশের তাত্ত্বিকগণ তাদের নিজস্ব বাস্তবতা ও অভিজ্ঞতার আলোকে যা করেছেন ও বলেছেন, পরিপ্রেক্ষিত ও প্রেক্ষাপট নির্বিশেষে আমাদের বাস্তবতায় শিক্ষার্থীদের তা গিলিয়ে দেয়াকেই ধার করা বিদ্যা বলা যেতে পারে।

যেহেতু মৌলিক বিজ্ঞানে মানুষের দৈনন্দিন জীবন অভিজ্ঞতা খুব গুরুত্বপূর্ণ চলক নয়, তাই ধার করা বিদ্যার অধিকাংশ মুসিবত সম্ভবত ঘুরেফিরে সেই সামাজিক বিজ্ঞান এবং কলা ও মানবিকী শ্রেণিভুক্ত বিষয়সমূহে ঘাড়েই বেশি পড়তে দেখা যায়। এক্ষেত্রে প্রয়োজন হলে বিদ্যা ধার করতে আদতে কোন সমস্যা নেই, বরং গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যাকে স্থানীয় পরিপ্রেক্ষিতে পরিচয় করিয়ে দেয়ার চর্চাটিই করণীয় হওয়ার কথা। কিন্তু তা করা হলে বিদ্যমান ব্যবস্থায় মুসিবত থেকে যায় অন্তত দুই জায়গায়।

প্রথমত, ধার করা বিদ্যা নিয়ে আমরা যা করি তা হলো মূলত অনুবাদ। দূর দেশের কোন এক ব্যক্তি কোন এক বিষয়ে কী বলেছেন তা শুধু নিজ মাতৃভাষায় (ক্ষেত্রবিশেষে পরের ভাষায়) কিছুটা অনুবাদ করে, শিক্ষকের মতে প্রয়োজনীয় অংশগুলো গড়গড় করে বলে যাওয়া হয়।

দ্বিতীয়ত, পাঠ্যক্রমে এমন কিছু কোর্স থাকে, যেখানে ধার করে বহু ব্যক্তির কথা বলতে হয় বা বলা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঐ ব্যক্তিদের বক্তব্য একে অপরের সাথে সাংঘর্ষিক, যা স্বাভাবিকও বটে। আবার যেহেতু তাদের আলোচনা স্থানীয় বাস্তবতাকে ধারণ করে না, তাই শিক্ষার্থীরাও দ্রুততম গতিতে এই যুক্তিটি আরোপ করে স্থানীয় বাস্তবতার সাথে ঐ সব আলোচনাকে মিলিয়ে দেখার সম্ভাবনাটিকে নাকচ করে দেন।

এই দুই প্রাথমিক মুসিবতের ফলে যে মহামুসিবত তৈরি হয় তা হলো আমাদের চিন্তার দৈন্যতা। দিনের পর দিন মাথা না খাটিয়ে, কোন বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করার সম্ভাবনাকে সচেতনভাবে অপ্রয়োজনীয় করে রাখার ফলে যা ঘটে তা হলো, নিজেদের ভাবনার সঙ্কট, সাংঘর্ষিকতা ও দুর্বলতা আমরা নিজেরাই আর চিহ্নিত করতে পারি না।

এ কারণেই পরীক্ষার খাতার দুই নম্বর প্রশ্নে স্টুয়ার্ট হলের দোহাই দিয়ে আমরা লিখতে থাকি তিনি বলেছেন পপ-কালচার বা জনসংস্কৃতির সকল আধেয় ক্ষতিকর হতে পারে না, আমি তাঁর বক্তব্যের সাথে একমত। আবার হয়তো চার নম্বর প্রশ্নেই কোক স্টুডিও বাংলা-র মান নির্ধারণ করতে গিয়ে পপ কালচারের নিকুচি করতেও ছাড়ছি না।

ধার করা হোক বা নিজেদের, বিদ্যা আসলেই কাজে লাগুক, মুসিবতের হাত থেকে আমাদের চিন্তাশক্তিই আমাদের রক্ষা করুক। মনে রাখা জরুরি যে চিন্তাহীন মস্তিষ্কে গজানো মাশরুম কেউ খায় না।

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।