শিবলী নোমান
২০১১ সালের ২১ ডিসেম্বর যখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগের প্রথম আবর্তনের শিক্ষার্থী হিসেবে ক্যাম্পাসে আসি, তখন ভেবেছিলাম নতুন প্রতিষ্ঠিত একটি বিভাগের শিক্ষার্থী হিসেবে নতুন শ্রেণিকক্ষসহ বিভাগীয় সকল কাঠামোতে নতুনত্বের দেখা পাবো। কিন্তু এসেই জানতে পারলাম সদ্যপ্রতিষ্ঠিত বিভাগটির জন্য বরাদ্দ করা হয় নি কোন নিজস্ব শ্রেণিকক্ষ, নেই অন্যান্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামোও।
এই অবস্থায় কাজ চালিয়ে নেয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কলা ভবনের নিচতলার একটি কক্ষে সভাপতি ও শিক্ষকমণ্ডলীদের বসার জন্য এবং অন্যান্য দাপ্তরিক কাজের উদ্দেশ্যে ছোট ছোট খোপাকৃতির কক্ষ করা হয়েছিল, এটিই নাকি আমাদের বিভাগ! ওরিয়েন্টেশন ক্লাসে আমাদের মৌখিকভাবে জানানো হয়েছিল নতুন কলা ভবনের ৩য় তলার নির্মাণ কাজ শেষ হলে, সেখানে আমাদের বিভাগের জন্য স্থান বরাদ্দ করা হবে। সেই আশা নিয়েই প্রথমদিকে দুপুরের পর এবং পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র বা টিএসসি-র ভাষা শিক্ষা কেন্দ্রে ৩৩ জনের কক্ষে ৬৭ জন ক্লাস করেছি আমরা, মাসের পর মাস।
২০১৩ সালের শীতকালীন অবকাশ চলাকালীন এক রাতে বন্ধু আইমান উল্লাহ ফোন দিয়ে জানায় নতুন কলা ভবনের ৩য় তলার নির্মিতব্য একাংশ আমাদের বিভাগকে নয়, বরং অপর একটি বিভাগকে দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই তথ্যের ভিত্তিতে পরবর্তী করণীয় আলোচনা করতে ছুটির পর ক্যাম্পাস খুলে যাওয়ার প্রথম রাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার এলাকায় বসেছিলাম বিভাগের প্রথম আবর্তনের পাঁচ শিক্ষার্থী; তানজিদ বসুনিয়া, আইমান উল্লাহ, রাসেল রাব্বী, মঈনুল রাকীব ও আমি। এই আলোচনা থেকেই আমরা বিভাগের সঙ্কট নিরসনে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য ও সংশ্লিষ্ট অনুষদের ডিন বরাবর স্মারকলিপি পেশ করার কথা ভাবতে শুরু করি।
পরদিন আমাদের আবর্তনের সকল শিক্ষার্থীর সাথে আলোচনাকালে সবাই এই আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করে। এসময় আন্দোলনকে সফল করার জন্য প্রতিটি আবাসিক হলের জন্য একজন করে হল প্রতিনিধি নির্ধারণ করা হয়, যার মূল কাজ ছিল আমাদের কর্মসূচি সম্পর্কে তার হলের সবাইকে নিয়মিত জানানো ও সংগঠিত করা। শিক্ষার্থীদের দেয়া চাঁদা থেকেই তৈরি করা হয় হাতে লেখা দুইটি ব্যানার। আর সবার সাথে আলোচনার পর স্মারকলিপি পেশ করার তারিখ নির্ধারিত হয় ২৪ জানুয়ারি, ২০১৩।
সেই সময় আমরা কেউ স্মারকলিপি লেখার পদ্ধতি জানতাম না। মনে আছে, স্মারকলিপি প্রদানের নির্ধারিত তারিখের আগের রাতে আ ফ ম কামালউদ্দিন হলের ১০৯ নম্বর কক্ষে আমরা স্মারকলিপি লেখার উদ্দেশ্যে জড়ো হয়েছিলাম। নতুন কলা ভবনের ৩য় তলায় ক্লাস-রুম বরাদ্দ এবং সেমিনার লাইব্রেরি, ল্যাবসহ পূর্ণাঙ্গ বিভাগ স্থাপনের দুইটি দাবির সাথে আমরা বিভাগের ইংরেজি নামের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বাংলা নামকরণের দাবি যুক্ত করে আমাদের কর্মসূচিকে তিন দফা আন্দোলনে পরিণত করেছিলাম। এর ফলে বিভাগের বাংলা নাম হিসেবে সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন গৃহীত হলেও, এখনও আমরা বাংলা নামটির খুব বেশি প্রয়োগ দেখতে পাই না।
যাই হোক, ২৪ জানুয়ারি সকালে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে জমায়েত হই। এখান থেকেই মিছিল সহকারে প্রথমে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেনের হাতে স্মারকলিপি তুলে দেয়া হয়। এরপর স্মারকলিপি প্রদান করা হয় কলা ও মানবিকী অনুষদের সেই সময়ের ডিন অধ্যাপক ড. সৈয়দ মোহম্মদ কামরুল আহছান বরাবর।
২৬ জানুয়ারি, ২০১৩ তারিখ ক্যাম্পাসে ৪২তম আবর্তনের শিক্ষার্থীরা প্রবেশ করলে স্বাভাবিকভাবেই বিভাগের যাবতীয় সঙ্কট গভীরতর হয়। এই পরিস্থিতিতে ২৭ জানুয়ারি তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণার মাধ্যমে বিভাগের শিক্ষকগণও আন্দোলনে নামলে শিক্ষার্থীদের শুরু করা আন্দোলনটি যুগপৎ আন্দোলনে পরিণত হয়। এরই অংশ হিসেবে ২৮, ২৯ ও ৩০ জানুয়ারি বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মচারীদের অংশগ্রহণে যথাক্রমে মানববন্ধন, মৌন মিছিল ও কলা ও মানবিকী অনুষদ ভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালিত হয়।
এই দিনগুলোতে যুগপৎ আন্দোলনে নির্ধারিত কর্মসূচির পর শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন ক্যাম্পাসে নিজস্ব বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করে, একই সাথে প্রচার করা হয় নিজেদের দাবিসংবলিত প্রচারপত্র বা লিফলেট।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে প্রবেশ করে বিভাগের ৪২তম আবর্তনের শিক্ষার্থীদের যখন নিজেদের বন্ধুদের সাথে ক্যাম্পাসে আনন্দ করার কথা কথা, তখন তারা বিভাগের জন্য আন্দোলনে অংশ নিয়ে দিন কাটিয়েছে, মিছিল আর স্লোগানে স্লোগানে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিয়েছে, সর্বোপরি বিভাগের এই আন্দোলনের শক্তি বাড়িয়েছে।
০২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ তারিখ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বনির্ধারিত সিন্ডিকেট সভা। দাবি আদায়ে সিন্ডিকেট সভার দিন সকাল থেকে প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচির কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। কিন্তু আগের রাতে আমরা জানতে পারি যে, নতুন কলা ভবনের নির্মিতব্য ৩য় তলায় স্থান বরাদ্দের দাবিতে অপর দুইটি বিভাগও ঐদিন একই কার্যক্রম ঘোষণা করেছে। তাই নির্ধারিত সময়ের প্রায় দেড় ঘণ্টা আগেই ভোর বেলায় আমরা প্রশাসনিক ভবনের মূল ফটকে অবস্থান নেই। কিছুক্ষণ পর পৃথকভাবে অপর দুই বিভাগ প্রশাসনিক ভবনের অন্য দুই ফটকে অবস্থান নেয়। এই অবস্থায় দুপুরে উপাচার্য মহোদয় তিন বিভাগের শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলতে আসলেও, সমস্যার কোন বাস্তবমুখী সমাধান না হওয়ায় আমরা কর্মসূচি চালিয়ে যেতে থাকি।
শেষ বিকেলে সিন্ডিকেট সভায় নতুন কলা ভবনের নির্মিতব্য ৩য় তলা ঐ দুই বিভাগকে দেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে আমরা তৎক্ষণাত প্রশাসনিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেই এবং ভবনের তিনটি ফটকেই তালা দেয়া হয়। ঘণ্টাখানেক সিন্ডিকেটের সকল সদস্যসহ উপাচার্য তালাবদ্ধ থাকার পর, আমাদের বিভাগ নতুন কলা ভবনেই অবস্থান করবে এবং নতুন কলা ভবনের নির্মিতব্য ৪র্থ তলায় আমাদের বিভাগের জন্য প্রয়োজনীয় স্থান বরাদ্দ করা হবে, এই আশ্বাসের ভিত্তিতে আমরা তালা খুলে দেই।
ঐ সময়ে প্রশাসনিক ভবনের তালা খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত হঠকারিতা ছিল, নাকি ছিল আপোসকামিতা, তা নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে। তালা খুলে না দিলে আরো কম সময়ের ভেতর বিভাগের জন্য আরো ভালো কিছু আদায় করা যেতো কিনা, তা নিয়েও বিতর্ক চলতে পারে। আবার পরবর্তী সময়ে আমাদের বন্ধুদের কেউ কেউ পুরাতন কলা ভবনে যাওয়ার পক্ষেও কথা বলেছেন। কিন্তু ঐ আন্দোলনের সময় বিভাগের সকলে যেভাবে ঐক্যবদ্ধ ছিল, সেটিই হয়তো ছিল এই আন্দোলনের অন্যতম সফল একটি দিক। এই ঐক্যের জন্য ধন্যবাদ ৪১তম আবর্তনের সবাইকে। ধন্যবাদ ৪২তম আবর্তনের ভাই-বোনদের, যারা ক্যাম্পাসে আসায় আমরা অনুভব করেছিলাম আমরা একা নই। আর ধন্যবাদ আমাদের শিক্ষকদের, যারা আন্দোলন চলাকালে বলেছিলেন, “আমাদের বেইমানি করতে হতে পারে, তোমরা বেইমানি করবা না।”