শিবলী নোমান
০৬ই ডিসেম্বর বিশ্বের একমাত্র ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে জেরুজালেমকে স্বীকৃতি দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। জাতিসংঘ, আরব রাষ্ট্রসমূহ এবং মার্কিন মিত্রদেশগুলোর অনেকের আপত্তির তোয়াক্কা না করেই এই স্বীকৃতি দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আপাত দৃষ্টিতে এমনটা মনে হলেও, এই সিদ্ধান্তকে নজিরবিহীন হিসেবে উল্লেখ করেছে বিশ্ব গণমাধ্যম। একই সাথে এই সিদ্ধান্তের ফলে ফিলিস্তিন প্রশ্নে শান্তি-আলোচনা বিঘ্নিত হবে বলে মনে করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক মিত্র দেশও। অন্যদিকে ফিলিস্তিনের অন্যতম সশস্ত্র রাজনৈতিক দল হামাস এই সিদ্ধান্তের ফলে ‘নরকের দরজা’ খুলে দেয়া হয়েছে, এমন উক্তির মাধ্যমে আসন্ন সময় সম্পর্কে এক ধরণের জানান দিয়ে দিয়েছে।
আগামী দিনগুলোতে তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে ইসরায়েলের রাজধানী সরিয়ে নেয়া প্রসঙ্গে বিশ্ব রাজনীতি এবং মধ্যপ্রাচ্য কিংবা ফিলিস্তিন ইস্যুতে কী ধরণের অমানিশা নেমে আসবে বা কোন পথে এগুবে এই সংকট, সেই বহুল আলোচিত প্রশ্নের উত্তর না খুঁজে একটু ভিন্নভাবে এই প্রসঙ্গে আলোচনার জন্যই এই লেখার সূত্রপাত। এই লেখার বিষয় জেরুজালেম, এই লেখার বিষয় আরব বিশ্ব।
জেরুজালেম, এ যেন এক স্বপ্নের নাম! আড়াই হাজার বছরের পুরনো এক শহর। যে শহর নিয়ে অভাব নেই ধর্মীয় ডিসকোর্সের, রয়েছে অনেক মিথ, রয়েছে শহর ও শহরটির মানুষের সুদীর্ঘ ইতিহাস। হাজার হাজার বছরের ইতিহাসে বারংবার সৃষ্টি আর ধ্বংসকে প্রত্যক্ষ করেছে শহরটি। ইতিহাস থেকে দেখা যায়, জেরুজালেমকে ধ্বংস করা হয়েছে দুইবার, অবরুদ্ধ করা হয়েছে ২৩ বার। এছাড়া আক্রমণ ও দখল করা হয়েছে যথাক্রমে ৫২ ও ৪৪ বার। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় এই শহর আক্রমণ ও ধ্বংস করেছে বেবিলনের রাজা নেবুচাঁদনেজার ও রোমান বাহিনী। শহরটিকে শাসন করেছে পারস্য, হেলেনিক গ্রীক, হাসমোনিয়া, রোম, বাইজান্টাইন, মুসলিম খলিফা, উমাইয়া, আব্বাসীয়, ফাতেমীয়, ক্রুসেডার, মামলুক, অটোম্যান ও মিশরীয়রা।
আব্রাহামিক ধর্ম অর্থাৎ ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের কাছে জেরুজালেম এক পবিত্র শহর। ইহুদিদের কাছে শুধু জেরুজালেমই নয় বরং বর্তমান ইসরায়েল, ফিলিস্তিন এবং মিশর, সিরিয়া ও জর্ডানের অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত এক ভূখন্ড হলো তাদের ‘প্রতিশ্রুত ভূমি’, যেখানে গঠিত হবে ইহুদি রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রের জেরুজালেম শহরেই ইহুদি রাজা সলোমন নির্মাণ করেছিলেন তাদের প্রথম মন্দির বা সলোমন টেম্পল। খ্রিস্টানদের কাছে এই জেরুজালেম পবিত্র কারণ যিশু খ্রিস্ট এই সলোমন টেম্পলের ভেতরেই তারঁ বাণী প্রচার করতেন। আর এই সলোমন টেম্পল, যা মুসলিমদের কাছে বায়তুল মোকাদ্দাস নামে পরিচিত, এটি হলো তাদের প্রথম কেবলা। আর এর পশ্চিম দিকের দেয়ালেই পবিত্র শবে মেরাজের রাতে ইসলাম ধর্মের মহানবী (সা) এর বাহন ‘বোরাক’ অবতরণ করেছিল বলে বিশ্বাস করা হয়।
ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় নানা উত্থান-পতন প্রত্যক্ষ করেছে এই শহর। এই শহর থেকে কখনো ইহুদিদের বিতাড়িত করা হয়েছে, কখনো তারা বিতাড়িত করেছে অন্যদের। তবে এই অঞ্চলে দীর্ঘকাল ধরে ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলমানদের বসতি ছিল। এক পর্যায়ে ইহুদিরা বিতাড়িত হয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়লেও তাদের আজন্ম লালিত স্বপ্ন ছিল প্রতিশ্রুত ভূমি ইসরায়েলে ফিরে যাওয়া ও জেরুজালেমের দখল নেয়া। এই উদ্দেশ্যে তাদের উৎসব ‘ইয়ম-কিপুর’-এর প্রার্থনা তারা শেষ করতো ‘আগামী বছর জেরুজালেমে’ বলার মাধ্যমে।
১ম বিশ্বযুদ্ধকালীন বেলফোর ঘোষণা, ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ ম্যান্ডেট ব্যবস্থা এবং ১৯৪৮ সাল ও তার পূর্ববর্তী সময়ের ঘটনাবলীর কারণেই ফিলিস্তিন প্রশ্নে আরব বিশ্বের সংশ্লিষ্টতা থেকে যায়। অটোম্যান সাম্রাজ্য ভেঙে আরব রাষ্ট্রগুলো তৈরি হওয়ায় এবং জেরুজালেম মুসলিমদের কাছেও সমান পবিত্র হওয়ায় ফিলিস্তিনে আসলে কী হবে বা হতে যাচ্ছে তা নিয়ে আরব দেশগুলোর কাজ করার সুযোগ ছিল। আরব বিশ্বের দেশগুলো ফিলিস্তিন অঞ্চলে ইহুদি বসতি স্থাপন কিংবা ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল স্থাপনের মৌখিক বিরোধিতা করলেও গত প্রায় ৭০ বছরে ফিলিস্তিনের সাধারণ মানুষের জন্য কিছু করতে পেরেছে বলে দৃশ্যমান কোন উদাহরণ নেই।
ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র গঠিত হলে আরব রাষ্ট্রগুলো একত্রিত হয়ে এর বিরুদ্ধে কাজ করবে এমনটাই ছিল সবার মনোভাব। ইসরায়েলের স্বাধীনতা ঘোষণার আগে আগে প্যালেস্টাইনের আরব নেতা মুসা আলামী অন্যান্য আরব রাষ্ট্র সফর করেন সম্ভাব্য পরিস্থিতি মোকাবেলায় করনীয় ঠিক করতে। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট তাকে জানান যে ইসরায়েলকে মোকাবেলার জন্যে তাদের যথেষ্ট অস্ত্র রয়েছে এবং তাদের নিজেদের তৈরি একটি আণবিক বোমাও আছে। ইরাকের প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন যে ইহুদিদেরকে সমুদ্রে ফেলতে তার কিছুই নয় বরং শুধু ঝাড়ু প্রয়োজন হবে। মিশরীয়রা বলেছিল যে ব্রিটিশরা সবুজ সংকেত দিলেই তারা ইহুদিদেরকে উপড়ে ভূ-মধ্যসাগরে ফেলবে।
কিন্তু ইসরায়েলের স্বাধীনতা ঘোষণার পর দেখা গেল, জর্ডান ছাড়া প্রত্যক্ষ এবং আপামর সহায়তায় কেউ তেমন একটা এগিয়ে আসেনি। মিশর তাদের পরিকল্পনাই ঠিক করতে পারেনি তখনো। আর পুরো আরব বিশ্ব ইউরোপের মতোই ইসরায়েলের সমর সজ্জায় হতবাক হয়ে গয়েছিল। পরিণতি, আরবদের পরাজয়। ১৯৫৬ সালে সুয়েজ খাল জাতীয়করণ ইস্যুতে ব্রিটেন-ফ্রান্সের ইন্ধনে ইসরায়েল মিশরকে আক্রমন করলেও ফলাফল ছিল অপরিবর্তিত। ১৯৬৭ সালে তিরাণ প্রণালী বন্ধ করে দিলে পুনরায় ছয়দিনের ৩য় আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু হয়। প্রচন্ডভাবে ধরাশায়ী হয় আরব বাহিনী, ইসরায়েল দখল করে নেয় মিশরের সিনাই উপত্যকা, সিরিয়ার গোলান মালভূমি, ফিলিস্তিনের পূর্ব জেরুজালেম ও পশ্চিম তীরের কিছু অংশ।
১৯৭৩ সালে কোন উস্কানি ছাড়াই মিশর ও সিরিয়া ইহুদিদের পবত্র দিন ‘ইয়ম-কিপুর’-এ ইসরায়েল আক্রমন করলে ১৮ দিনের ৪র্থ আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু হয়। এ যুদ্ধেও ইসরায়েল আরব বাহিনীকে পরাস্ত করে। এত যুদ্ধের পর ইসরায়েলের সাথে মিশর যখন ১৯৭৮ সালে ‘ক্যাম্প-ডেভিড চুক্তি’ করে, তাতে মিশর ফিরে পায় তার সিনাই উপত্যকা। বিনিময়ে ইসরায়েলের সাথে আর সংঘর্ষে না যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় আর ফিলিস্তিনিদের চলাফেরার জন্য যে মিশর সীমান্ত খোলা থাকতো তা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু চারটি যুদ্ধে ফিলিস্তিনের যেসব অংশ ইসরায়েল দখল করে নিয়ছিল তা ফিরিয়ে দেয়ার কোন তাগাদা বা উদ্যোগ নেয়নি মিশর।
মূলত প্রতিটি যুদ্ধে মিশরই আরবের প্রতিনিধিত্ব করলেও চুক্তির ফলে কোন ক্ষতিপূরণই পায় নি ফিলিস্তিন। বরং ভূমি দখল করতে করতে ইসরায়েল ফিলিস্তিনকে পরিণত করেছে ক্ষুদ্র এক উপত্যকায় যার এক অংশ আরেক অংশ থেকে পৃথক আর সারাবছর থাকে অবরুদ্ধ। মূলত আরবের মুসলিমদের অনৈক্যের সুযোগকে শতভাগ ব্যবহার করেছে ইসরায়েল এবং এখনো করছে। কিন্তু সবসময়ই এর করুন ফল ভোগ করতে হয়েছে ফিলিস্তিনিদের।
তাই নতুন করে যখন জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণাকে কেন্দ্র করে আরেকবার সামনে এলো ফিলিস্তিন সংকট, এখন আরব বিশ্ব আরেকটি সুযোগ পাচ্ছে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই সংকট সমাধানের উদ্যোগ নেয়ার। এই সুযোগটি আরব বিশ্ব গ্রহণ করবে নাকি আবারও ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হবে তাই এখন দেখার বিষয়। আরব বিশ্ব ইস্যুটিকে একটি পরীক্ষা হিসেবে গ্রহণ করুক বা নাই করুক, গুরুত্ব দিক বা নাই দিক, জেরুজালেমে অধিকার ধরে রাখার জন্য ফিলিস্তিনিদের সামনে সম্ভবত এটিই শেষ সুযোগ।