শিবলী নোমান

সৌদি আরবের পরিবর্তন বিষয়ক খসড়া প্রস্তাবনা

শিবলী নোমান

সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোচনায় এসেছে সৌদি আরব প্রসঙ্গ। মূলত সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদের সৌদি সিংহাসনে আরোহণের পর থেকেই নতুন নতুন কারণে সংবাদ হিসেবে সামনে এসেছে সৌদি আরবের অভ্যন্তরীন বিষয়াদি। তবে সালমান বিন আবদুল আজিজের সিংহাসন অধিকারের চেয়েও অধিক পরিমাণে সৌদি আরব নিয়ে আলোচনা হয়েছে মোহাম্মদ বিন সালমানকে সৌদি আরবের ‘ক্রাউন প্রিন্স’ বা সিংহাসনের পরবর্তী উত্তরাধিকারের স্বীকৃতি দেয়ার পর থেকে। মোহাম্মদ বিন সালমান ক্রাউন প্রিন্স হওয়ার পর থেকেই সৌদি আরবে একের পর এক পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। এসব পরিবর্তন ছিল রাজনৈতিক এবং সামাজিক। সৌদি নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি প্রদান কিংবা স্টেডিয়ামে গিয়ে খেলা দেখার অনুমতি প্রদানকে সৌদি আরবে এক ধরণের সামাজিক পরিবর্তনের সূচনা বলে অভিহিত করা হচ্ছে। অন্যদিকে সৌদি আরবের অভ্যন্তরীন রাজনীতিতে দুর্নীতি দমনে মোহাম্মদ বিন সালমানকে একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রদান এবং এর ফলশ্রুতিতে ১১ সৌদি প্রিন্সসহ সাবেক মন্ত্রী ও কয়েক শতাধিক সৌদি নাগরিককে গ্রেপ্তার কিংবা কাতারের ওপর অবরোধ আরোপ কিংবা হালের লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরির সৌদি আরবে থেকে পদত্যাগ ঘোষণা ও সৌদি আরবে তাঁর গৃহবন্দিত্বের গুজবের সাথে লেবানন ও হিজবুল্লাহর দ্বন্দ্ব নতুন করে উসকে দিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর পারস্পরিক সম্পর্কের বৈরিতাকে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে যেই প্রশ্ন সামনে চলে আসছে তা হলো, সৌদি আরব কি এক ধরণের পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে? কিংবা সৌদি আরবে কি পরিবর্তন আসন্ন?

আপাত দৃষ্টিতে মোহাম্মদ বিন সালমানের কার্যক্রম লক্ষ্য করলে মনে হতেই পারে যে, সৌদি আরব ইতিমধ্যেই এক ধরণের পরিবর্তন চাক্ষুষ করছে। তবে ভিন্নভাবে কিংবা বিপরীত দিক থেকে চিন্তার সুযোগ গ্রহণ করলে আরো কথা থেকে যায়। সৌদি আরবের সাম্প্রতিক পরিবর্তনের দিক থেকে নজর দেয়ার আগে আমাদের উচিত হবে সৌদি আরব আসলে কী ধরণের রাষ্ট্র সেদিকে নজর দেয়া। তাহলে বোঝা যাবে যে, সৌদি আরবের বর্তমান পরিবর্তনগুলোর ফলে আদতেই কোন ধরণের পরিবর্তন হবে কিনা।

খেয়াল রাখতে হবে যে, আমরা যে সৌদি আরব নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি তা প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ের সৌদি আরব। এর আগে সৌদি আরব ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে, তথা তুর্কি শাসকদের অধীনে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তির পরাজয়ের ফলে অটোমান সাম্রাজ্যেরও পতন ঘটে। এর ফলে অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে থাকা ভূখন্ডগুলো ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলা হয়। এর ফলে যেসব নতুন রাষ্ট্র বা অঞ্চলের সৃষ্টি হয় তার বেশিরভাগেই উপনিবেশ তৈরি করে ব্রিটেন ও ফ্রান্স। তবে স্বাধীনতা দেয়া হয় সৌদি আরব ও ইয়েমেনকে।

১৯৩২ সালে ইবনে সৌদ হেজাজ দখলের মাধ্যমে সৌদি রাজতন্ত্রের সূচনা করেন এবং সময়ের সাথে সাথে কিংডম অব সৌদি অ্যারাবিয়ার উত্থান ঘটে। সৌদ পরিবার এর আগে ১৭৪৪ সালেও সৌদি আরবে সাম্রাজ্য বিস্তারের চেষ্টা করেছিল, তবে তা দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। ১৯৩২ সালে গঠিত সৌদি রাজতন্ত্রের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি ছিল হজ ব্যবসা ও সৌদি মরুভূমির যৎসামান্য কৃষি উৎপাদন। ইসলাম ধর্মমতে, হজ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব মুসলিম জাহানের খলিফার ওপর বর্তিত হলেও, কামাল আতাতুর্ক কর্তৃক খিলাফতের অবসানের ফলে হজ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বের দখল সৌদি আরব তথা সৌদি রাজপরিবারের কাছে চলে আসে। সেই থেকে সৌদি আরব হজ ব্যবস্থাপনা করছে এবং এর ফলে তাদের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রেখেছে।

সৌদি আরব আজকের অবস্থানে কখনোই আসতে পারতো না, যদি না তাদের ভূ-অভ্যন্তরে তেলের বিশাল মজুদ আবিষ্কার না হতো। তেলের এই আবিষ্কারের ফলেই সৌদি আরব একটি উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পেরেছে। একই সাথে এই পেট্রো ডলারের কল্যানেই সম্ভব হয়েছে সৌদি আরব-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মৈত্রী বন্ধন।

হজ ব্যবস্থাপনা এবং পেট্রো ডলারের কল্যাণে সৌদি অর্থনীতি চাঙা হওয়ার পাশাপাশি সৌদি রাজতন্ত্র তার ভিতকে মজবুত করেছে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে অতিরিক্ত দহরম মহরম সম্পর্কের কারণে ব্যাপক সমালোচিত হলেও তা সৌদি শাসকগণ খুব একটা পাত্তা দিয়েছেন, তা বলা যাবে না। বরং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইতিবাচক সম্পর্কের কারণে সৌদি আরব মুসলিম বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতে পারবে না, এমন তাত্ত্বিক অবস্থানও অনেকে প্রকাশ করেছে।

সৌদি রাজপরিবারের পক্ষ থেকেই দেশটির সকল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অন্যদিকে ধর্মীয় বিষয়গুলোর ক্ষমতা রয়েছে মহাম্মদ বিন ওয়াহাবের পরিবারের অধীনে। ১৭৪৪ সালে প্রথম সৌদি রাজতন্ত্রের সময় মুহম্মদ বিন সৌদ ও মুহাম্মদ বিন ওয়াহাবের ভিতর যে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বোঝাপড়া কিংবা সন্ধি হয়, তা এখনো চলছে এই দুই পরিবারের ভেতর। যার ফলে সৌদি রাজপরিবার এখনো ওয়াহাবি মুসলিম বা কট্টর সুন্নিবাদের অনুসারী। মূলত, এই মুহাম্মদ বিন ওয়াহাবের পরিবারের ধর্মীয় পথপ্রদর্শনের বিষয়টি সৌদি রাজতন্ত্রে স্বীকৃত এবং সৌদি রাজপরিবার এ বিষয়ে কোনরূপ হস্তক্ষেপ করবে না, সে বিষয়ে প্রাচীন সময় থেকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বলা বাহুল্য, জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস-ও এই ওয়াহাবি ধারার জিগির তুলে ইসলামি খেলাফতের নামে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের সাধারণ মুসলিম ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের কচুকাটা করেছে।

এখন যদি বর্তমান সময়ে চলা সৌদি পরিবর্তনগুলোর দিকে চোখ ফেরাই তাহলে বলতে হয় যে, নারীদের নতুন নতুন যে অধিকার সৌদি আরবের পক্ষ থেকে দেয়া হচ্ছে তা সৌদি নারী সমাজকে কতটা এগিয়ে নেবে তা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও বা সন্দেহের অবকাশ থাকলেও এর ফলে সৌদি নারীরা পুরুষের সমান অধিকার পেয়ে যাবে তা বলা যাচ্ছে না। মূলত সৌদি রাজপরিবারের নিয়ন্ত্রণ থেকে বের হতে না পারলে শুধু সৌদি নারীরাই নয় বরং সাধারণ সৌদি নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো আদায় করা বেশ কষ্টসাধ্য। ২০১১ সালের তথাকথিত আরব বসন্তের যে ছোঁয়া সৌদি আরবে লেগেছিল, তা সৌদি রাজপরিবারের পক্ষ থেকে শেকড়সহ উপড়ে ফেলার কথা আমরা নিশ্চয়ই ভুলে যাই নি।

তাই ক্ষমতা সংহত করতে সৌদি রাজপরিবারের নৈতিক অবস্থান এবং একইসাথে ওয়াহাবি মতবাদের পক্ষে তাদের অবস্থানের পরিবর্তন ব্যতিরেকে সৌদি আরবে জনকল্যানমূলক কোন পরিবর্তন আসন্ন, তা ভাবার ক্ষেত্রে কিছু বাধা থেকেই যায়। এই পরিবর্তনকে বরং আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমে যাওয়ার ফলে সৌদি অর্থনীতির সাময়িক দুর্বলতার ক্ষতিপূরণ বলা যেতে পারে। হতে পারে সাম্প্রতিক ঘটনাবলির ফলে সৌদি আরবে ইতিবাচক কিছু ঘটবে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তা সৌদি আরবের সাধারণ মানুষের জীবনে কী এবং কোন ধরণের পরিবর্তন নিয়ে আসে, তা নিয়ে একটি প্যারাডক্সের সৃষ্টি কিন্তু হতেই পারে।

 

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।