শিবলী নোমান
পৃথিবী এখন কাঁপছে পানামা পেপারস জ্বরে। পুরো পৃথিবীই কাঁপছে বলা যায়। কর না দেয়া ও অর্থ পাচারের অভিযোগ এসেছে যাদের বিরুদ্ধে তারা কাঁপছেন দুই কারণে, হয় ভয়ে নাহলে মজায়। ভয় এই কারণে যে এতদিন ধরে তাদের গড়ে তোলা সম্পদ ও সম্মান দুইই এখন হুমকির মুখে। আর যারা ভয় পান না তারা হয়ত মজায় কাঁপছেন এই ভেবে যে পানামা পেপারসের ঘটনায় তাদের কিছু আসবে যাবে না। আর আমরা, মানে যারা নিয়মিত পানামা পেপারস বিষয়ে গুগল করছি কিংবা পত্রিকায় নিয়মিত নজর রাখছি তারা কাঁপছি উত্তেজনায়। পৃথিবীর যেসব মানুষকে টেলিভিশনের পর্দায় দেখে আমরা অভিভূত হয়, সেটা ইতিবাচক বা নেতিবাচক যে কোন কারণেই হতে পারে, তাদের বিষয়ে যখন কর ফাঁকির মত অভিযোগ ফাঁস হয়ে যায় তখন উত্তেজিত হতেই হয়।
উত্তেজনার পারদ নিয়ন্ত্রণের বড়ি খেয়ে চলুন পানামা পেপারস নিয়ে কথা বলি। তেসরা এপ্রিল পানামা পেপারস ফাঁস হওয়ার দিন দুয়েক পর থেকে বিষয়টা অনুসরণ করছি। ২০১৫ সালে কোন এক অজানা সূত্র থেকে জার্মানভিত্তিক সংবাদপত্র সুদুশে জেইতুং (Suddeutsche Zeitung) ও যুক্ত্ররাষ্ট্রভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন ‘ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট’ বা আইসিআইজে ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত পানামাভিত্তিক আইনি প্রতিষ্ঠাণ মোসাক ফনসেকার প্রায় সাড়ে এগারো মিলিয়ন নথি পেয়ে যায়। সুদুশে জেইতুং বিষয়টি প্রকাশ করার সাহস না দেখালেও আইসিআইজে গত প্রায় এক বছর ধরে ৮০ দেশের ১০৭টি মিডিয়া হাউজের ৪০০ সংবাদকর্মীর মাধ্যমে অনুসন্ধান চালিয়ে এরপর গত তেসরা এপ্রিল এসব নথি প্রকাশ করে বলে প্রচার করা হচ্ছে। পানামা পেপারস ফাঁস হওয়ার প্রথম ফলাফল স্বাভাবিকভাবেই ছিল ‘ম্যাসিভ’। একসাথে এত নথি এবং এত এত জনপ্রিয়, নিন্দিত, নন্দিত মানুষের কর ফাঁকি দেয়ার সংবাদ ম্যাসিভ হবে এটাই স্বাভাবিক। এখন পর্যন্ত যতটুকু জানি ফাঁস হওয়া নথিতে অস্ট্রেলিয়ার ৮০০, ভারতের ৫০০, পাকিস্তানের ২০০ জনের নাম রয়েছে। চীনের ক্ষমতাসীনদের একটা অংশ, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘনিষ্ট বন্ধুমহল, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের পিতার কর ফাঁকি দিয়ে করা অফশোর প্রতিষ্ঠানের তথ্যও ফাঁস হয়েছে। এই কেলেঙ্কারি ফাঁসের পর পদত্যাগ করেছেন আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সিগমন্ডুর ডেভিড গুলনাগসন। দৈনিক সমকালের অনলাইন ভার্সন বলছে ফাঁস হওয়া নথিতে রয়েছে অন্তত ৩০ বাংলাদেশির নাম (লিংক লেখার শেষে)।
এটুকু হল এখন পর্যন্ত পানামা পেপারসের তথ্য। এবার আসেন আবার উত্তেজিত হই। পানামা পেপারসের ঘটনা দেখে প্রথমে মনে হয়েছিল জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের উইকিলিকসের আদলেই আবারো কিছু হল। কিন্তু দুইটা বিষয় কোনভাবেই ফেলে দেয়া যাচ্ছে না। প্রথমত, পানামাকে বিশ্বের অন্যতম কর রেয়াত এলাকায় পরিণত করে এসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সেটাও প্রায় একশ বছর আগে থেকে। দ্বিতীয়ত, পানামা পেপারসে এখন পর্যন্ত মার্কিনীদের নাম খুব একটা শোনা যাচ্ছে না। এই দুই বিষয়ের আবার দুইটি মানে থাকতে পারে। একটি হতে পারে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ, মানে যারা বিত্তবান কারণ সাধারণ মানুষ মানুষ নয়, কর ফাঁকি দেয় না এবং অফশোর কোম্পানি প্রতিষ্ঠার কথা চিন্তাও করে না তাই পানামা পেপারসে যুক্তরাষ্ট্রের তেমন কারো নাম নেই। অপর কারণটি হতে পারে, যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ ভালো এবং তারা কর ফাঁকি দেয় না, কিন্তু তারা যেহেতু ভালো এবং অন্যদের উপকার করতে চায়, তাই গত একশ বছর ধরে তারা পানামাকে কর রেয়াত এলাকা হিসেবে প্রতিষ্ঠার কাজ করেছে যেন বিশ্বব্যাপী যারা কর ফাঁকি দিয়ে তাদের সম্পদ নিরাপদে রাখতে চায় তাদের একটু উপকার করা যায়।
এটা তো খুব স্থূল হাইপোথিসিস ছিল, বিষয়টা আরো সূক্ষ্ম ও জটিল হয়ে যাচ্ছে তখনই যখন খোদ উইকিলিকস বলছে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে বিতর্কিত করতেই পানামা পেপারস নামক নাটক সাজানো হয়েছে। উইকিলিকসও পানামা পেপারসে যুক্তরাষ্ট্রের কারো নাম না থাকার বিষয়টি আলোচনায় এনেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আমার মাইন্ড সেটের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আমার বিশ্বাস একটু কমই আছে তাই উইকিলিকসকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছে।
বিশ্বাস-অবিশ্বাসকে তুলে রেখে আসেন একটু অন্যদিকে তাকাই। বিশ্ব রাজনীতির ঘোলাটে জলে কর্দমাক্ত না হয়ে পানামা পেপারসে আসা অভিনেতা-তারকাদের নিয়ে কথা বলি। পানামা পেপারসে প্রচুর অভিনেতা ও ফুটবল তারকার কর ফাঁকির কথা উঠে এসেছে। এসব নিয়ে হয়ত তদন্তও হবে। তদন্তে হয়ত সব মিথ্যা পরিণত হবে, কিন্তু বিষয়টা হল প্রশ্ন উঠেছে। প্রতিনিয়ত টেলিভিশনের রঙিন দুনিয়ায় যেসব অভিনয় শিল্পীদের অভিনয় দেখে আমরা, মানে সাধারণ মানুষরা যখন লড়াই করে বাঁচার কথা ভাবি, তাদের অভিনয়ে আবেগ দেখে চোখের পানি ফেলি, সেই তারা যদি কর ফাঁকি দিয়ে বিদেশে নামমাত্র প্রতিষ্ঠান খুলে অবৈধ সম্পদের পাহাড় তৈরি করে ফেলেন বিষয়টা ভাবলে নিজেদের বোকা ছাড়া কিছু মইনে হয় না। তবে বোকা আমরা আগেই হয়েছি টেলিভিশন নামক বোকা বাক্সে দেখানো মিথ্যা জীবনকে সত্য মনে করে নিজের সত্য জীবনে সেই মিথ্যা জীবন স্থাপনের চেষ্টা করে। পানামা পেপারস তাই রাজনীতি থেকে নিজেকে খুব দূরে সরিয়ে রাখা সাধারণ মানুষের জীবনে নতুন হতাশার নাম, পানামা পেপারস একটি প্যারাডক্সও হতে পারে।
এ সংক্রান্ত: তালিকায় ৩০ বাংলাদেশি