শিবলী নোমান

ফুকো ও নয়া-মাধ্যমে নজরদারি!

শিবলী নোমান

সমাজবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক বা অ্যাকাডেমিক পরিসরে মিশেল ফুকো খুব আলোচিত একটি নাম। ফরাসি এই তাত্ত্বিক তাঁর বিভিন্ন তত্ত্ব, মতামত ও লেখনীর মাধ্যমে এই অঙ্গনে নিজের জন্য স্থায়ী আসন তৈরি করে নিয়েছেন। তাঁকে নিয়ে বা তাঁর কাজ নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে আমরা ক্ষমতা ও ক্ষমতা বিন্যাস বা ক্ষমতা কাঠামো, যৌনতার ইতিহাস, কারাগারের ইতিহাস, পাগলাগারদের ইতিহাস কিংবা রেপ্রিজেন্টেশন নিয়ে তাঁর কাজগুলোকে অন্যতম মনে করে থাকি। কিন্তু এর বাইরেও তাঁর সর্বেক্ষণবাদ বা প্যান-অপটিমিজমের ধারণাটি আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। ফুকো বলেছেন, প্রাচীনকালের কারাগার বা পাগলাগারদগুলোতে সেখানে থাকা বন্দীদের চলাফেরার উপর নজরদারি করার জন্য বড় বড় আলো বা ফ্লাড লাইট জাতীয় বস্তু থাকতো। এগুলো চারদিকে ঘুরিয়ে একই সাথে সবদিকে বা ৩৬০ ডিগ্রি নজরদারি করা যেত। এই নজরদারির সাথে ফুকো আমাদের প্রচলিত সমাজব্যবস্থাকে ব্যাখ্যা করেছেন তাঁর প্যান-অপটিমিজমের আলোচনায়। তাঁর মতে, সমাজে বিদ্যমান সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহ যেমন পরিবার, স্কুল, ধর্মীয় উপাসনালয় এমনকি হাসপাতালগুলোর প্রধান কাজ হলো সমাজের সদস্য অর্থাৎ মানুষের উপর নজরদারি করা। এই নজরদারির ফলে কোন মানুষ যেন সমাজের বিদ্যমান রীতি-নীতি, কৃষ্টি-কালচার বা প্রচলিত ব্যবস্থার বাইরে যেতে না পারে বা সেই প্রয়াসে যেন কিছু করতে না পারে তা নিশ্চিত করা হয়।

ফুকো যখন প্যান-অপটিমিজম নিয়ে আলোচনা করেছেন তখন নয়া-মাধ্যমের উত্থান ঘটে নি। তাই ফুকোর আলোচনায় নয়া-মাধ্যম কোন আলোচ্য বিষয় নয়। কিন্তু ফুকোর ব্যাখ্যাকে যদি সম্প্রসারিত করা হয় তাহলে নয়া-মাধ্যমের চরিত্র নিয়ে আলোচনাও সহজ হয়ে যায়। এক্ষেত্রে নয়া-মাধ্যমগুলোকেও আমাদের তথা সমাজের সদস্য হিসেবে মানুষকে নিয়ন্ত্রণের আরেকটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। নয়া-মাধ্যম বা নিউ মিডিয়া হচ্ছে সেই সব মিডিয়া যা ব্যবহার করতে কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা হলো পূর্বশর্ত। এসব মিডিয়ায় ইন্টারঅ্যাক্টিভিটি বা তাৎক্ষণিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এবং মিথষ্ক্রিয়ার সুযোগ অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে সামনে আসে। বর্তমানে নয়া-মাধ্যম বলতে ইন্টারনেট নির্ভর যেসব মাধ্যম নিয়ে আলোচনা করা হয় তা মূলত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এর ভেতর ফেইসবুক, টুইটার, ইউটিউব, ইন্সটাগ্রাম প্রভৃতি অন্যতম। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আলোচনা করতে গেলে টুইটারকে আমরা সরিয়ে রাখতে পারি।

নয়া-মাধ্যমকে নজরদারির মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার এই আলোচনা নিয়ে বিতর্ক বা ভিন্নমত থাকতে পারে। তবে এই আলোচনাকে আরো যৌক্তিক করা যায় এ সংক্রান্ত জনসংযোগ বা পাবলিক রিলেশন সংক্রান্ত একটি আলোচনার আলোকে। ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট বা সংকট নিরসন সংক্রান্ত জনসংযোগের আলোচনায় সামাজিক মাধ্যমেকে বর্তমানে বেশ গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হয়। বলা হয়ে থাকে যে, কোন প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের সামাজিক মাধ্যমে তৎপরতা নজরদারি করার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে তাদের মনোভাব খুব সহজে বুঝতে পারা যায়। আবার সংকট নিরসনের জন্য যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয় তার ফলাফল মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও সামাজিক মাধ্যমে অংশীজনদের তৎপরতা নজরদারি করা হয়।

এ থেকে অন্তত এই অবস্থানে আসা যায় যে, নয়া-মাধ্যম তথা সামাজিক মাধ্যমে নজরদারির বিষয়টি নিছক কোন কল্পনা নয়। এবার একটু অন্যভাবে ভাবা যাক। আমরা যদি আমাদের সামাজিক মাধ্যম বিষয়ে খুব সচেতনভাবে ভাবি তাহলে দেখা যাবে যে, আমাদের সামাজিক মাধ্যমের নিজস্ব অ্যাকাউন্টগুলো আমরা নিজেরা যেই দর্শন, আদর্শ, মূল্যবোধে বিশ্বাস রাখি সেই ধরনের মানুষ দিয়ে ঘেরা। আমাদের সামাজিক মাধ্যমের হোম পেইজে ‘স্পনসরড’ যেসব পেইজ বা অ্যাকাউন্ট চলে আসে সেগুলোর সাথেও আমাদের ঐসব দর্শন, আদর্শ বা মূল্যোবোধের মিল বা দ্বন্দ্ব থাকে। যার ফলে আমরা ঐসব কনটেন্টের প্রতি আকর্ষিত হই। আর এই আকর্ষণের ফলে আমরা ঐসব ‘স্পনসরড’ কনটেন্টগুলোর সাথে যুক্ত হই এবং ফেইসবুকের ব্যবসার পালে হাওয়া দেই।

আবার একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে যে, আমি বা আপনি বা আমরা যখন যে বিষয়ে আলোচনায় থাকি তখন ঠিক সেই সংক্রান্ত বিষয়গুলো আমাদের সামাজিক মাধ্যমে উঠে আসে। যদি দিন কয়েক আমরা কাঠের চেয়ার নিয়ে আমাদের সামাজিক মাধ্যমে আলোচনা করি তাহলে দেখা যাবে কোন এক অদ্ভুত কাকতালীয় কারণে আমাদের সামনে ফার্নিচারের বিজ্ঞাপন আসা শুরু করবে। বিষয়টি অদ্ভুত হলেও কাকতালীয় নয়। বরং জুকারবার্গের নজরদারিতে ঘেরা জগতে আপনাকে স্বাগতম!

কেন বিনা পয়সায় সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারের পরও সামাজিক মাধ্যমগুলো সবচেয়ে বেশি লাভজনক প্রতিষ্ঠান তা এই আলোচনা থেকে বুঝতে পারা যায়। আপনার সামাজিক মাধ্যমটি আপনি যা দেখতে চান ঠিক তাই আপনার সামনে নিয়ে আসে। আর এজন্যই আমরা কখনো এই জগতটাকে দুর্বিষহ মনে করি না। বিশ্বাস না হলে কাছের কোন বন্ধুর বা প্রিয় কোন পেইজের পোস্টগুলোতে কিছুদিন রিঅ্যাকশন দেয়া বা কমেন্ট করা বন্ধ করে দেখুন। দেখবেন তা আর আপনার সামনে আসছে না। আবার রিঅ্যাকশন দেয়া বা কমেন্ট করা শুরু করুন, দেখবেন তা আবার আপনার সামনে এসে হাজির হচ্ছে।

বিটিআরসির হিসেবে আমাদের দেশে নয় কোটির বেশি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী আছে। আর সামাজিক মাধ্যমগুলো যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় তা নানা সময় আলোচনা ও গবেষণায় উঠে এসেছে। সামাজিক মাধ্যমে একদিকে যেমন আমরা সামাজিক মাধ্যম কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ জুকারবার্গ গংদের নজরদারিতে থাকি তাদের ব্যবসা রক্ষার প্রয়োজনে, আবার ঠিক আমাদের বাস্তব জীবনের নানা অংশীজনদের নজরদারিতেও থাকি নিজস্ব বা অপরের ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠি স্বার্থে। অর্থাৎ সকল ক্ষেত্রে এই নজরদারি একটি বিরতিহীন ও চলমান প্রক্রিয়া। ফলে যেই সামাজিক মাধ্যমকে আমরা ব্যক্তি ও তথ্য স্বাধীনতার হাতিয়ার হিসেবে মনে করি তা ব্যবহৃত হয় আমাদের আরেক ধরনের শৃঙ্খলে আবদ্ধ রাখার উদ্দেশ্যে। কী আজব প্যারাডক্সে আমাদের বসবাস!

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।