শিবলী নোমান

চে গেভারার প্রাসঙ্গিকতা

শিবলী নোমান

প্রথমেই লক্ষ্য করা যাক চের নামের বাংলা বানানের প্রতি। আমি যে বানান লিখেছি সেটি আর আমাদের প্রচলিত বানান ও উচ্চারণের ভিতর ব্যাপক তফাৎ রয়েছে তা স্পষ্ট। আমার ধারণা ইংরেজি Guevara শব্দটির সরল উচ্চারণ ও তা থেকে এর বাংলা বানান নির্ধারণের সহজ পদ্ধতি অনুসরণ করার ফলেই এমনটি হয়েছে। চের নাম বলার ক্ষেত্রে পৃথিবীর আর কোথাও ‘চে গুয়েভারা’ উচ্চারিত হয় কিনা তা আমার জানা নেই, তবে বিভিন্ন ডকুমেন্টারি দেখলে এটি স্পষ্ট হওয়া যায় যে সেখানে ‘গুয়েভারা’ বলতে কোন শব্দ নেই। চে গেবারা কিংবা চে গেভারা কিংবা চে কোবারা নামেই চের নাম উচ্চারিত হয়। আমরা কলম্বিয়ান ফুটবলারকে প্রথমে নামের বানান অনুযায়ী জেমস রদ্রিগেজ বলে পরে তাদের উচ্চারন অনুযায়ী হামেস রদ্রিগেজ বলতে পারলে চে গেভারার ক্ষেত্রে বিষয়টি আরো বেশি প্রযোজ্য বলে মনে হয়।

জন্ম হয়েছিল ৮৮ বছর আগে আর্জেন্টিনায়, মৃত্যু বলিভিয়ায় ৩৯ বছর আগে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে। এই ক্ষণকালের জীবনে চে এমন কিছু করে গেলেন যার জন্যে তার প্রাসঙ্গিকতা তৈরি হল বিশ্বব্যাপী। দুনিয়াজোড়া বিপ্লব, বিক্ষোভ আর আন্দোলনের অদৃশ্য অনুপ্রেরণা আজও চে গেভারা, যার পরিবার প্রদত্ত নাম আর্নেস্তো গেভারা ডে লা সেরনা।

জন্ম আর্জেন্টিনায়, বিল্পব কিউবায়, যুদ্ধ কঙ্গোতে, মৃত্যু বলিভিয়ায়। একজন মানুষের জীবনের এরকম চারটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার স্থাণ চারটি আলাদা দেশ, খুব সহজেই বলে দেয়া যায় চের জীবন ছিল বৈচিত্র্যময়। অথচ আমরা সাধারণ জীবন যাপন করেই আমাদের জীবনকে অনেক সময় বৈচিত্র্যময় বলতে সঙ্কোচ বোধ করি না। বলছি না সঙ্কোচ বোধ করতেই হবে কিন্তু বৈচিত্র্যময়তা কী জিনিস তা বুঝতে পারার জন্যে হলেও তো ফিরে তাকাতে হয় চের জীবনের দিকে। খুব অল্প বয়সে সাইকেল চালিয়ে পাড়ি দিলেন আর্জেন্টিনার পথ-প্রান্তর, দেখলেন স্বদেশের মানুষের দুর্দশা। মেডিকেল শিক্ষা ফেলে রেখে আবারও বেরিয়ে পড়া লাতিন আমেরিকা ভ্রমণে। এবার মোটর সাইকেলে, সঙ্গী আলবার্তো গ্রানাদো। প্রায় বছরখানেক দীর্ঘ ভ্রমণে বুঝতে পারলেন শুধু আর্জেন্টিনা নয় বরং গোটা লাতিন আমেরিকাই জর্জরিত সাম্রাজ্যবাদী শাসনের যাঁতাকলে। এই ভ্রমণই চেকে একজন জাতীয়তাবাদী থেকে আন্তির্জাতিকতাবাদী করে তুলেছিলো। এই ভ্রমণেই কুষ্ঠরোগীদের সাথে ফুটবল খেলে, তাদের সাথে নিজের জন্মদিন পালন করে চে গেয়েছিলেন জীবনের জয়গান।

মোটর সাইকেল ভ্রমণের পর চের জীবন আর আগের মত থাকে নি। সমাজ পরিবর্তনের নেশায় চে মেক্সিকো চলে গেলেন। সেখানে নিজের যোগ্যতার চেয়ে অনেক নিম্নমানের কাজ করে দিন পার করতে থাকেন আর খোঁজ করতে থাকেন বিপ্লবের কাঙ্খিত সেই পথের। মনের থেকে চাইলে সব পাওয়া যায়, চে পেয়ে গিয়েছিলেন ফিদেল ক্যাস্ট্রোকে। এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয় নি। ডাক্তার গেভারার সময় লাগেনি কমরেড চে হয়ে উঠতে। তিন বছরের কিউবা বিপ্লবের সফল পরিসমাপ্তির পর কিউবায় নতুন কমিউনিস্ট সরকারের নতুন সংগ্রাম শুরু হয়। বিশ্বসভায় নিজেদের অধিকার ও স্বীকৃতি আদায়ের এই সংগ্রামের অগ্রগামী সৈনিক হিসেবে দেশে দেশে ঘুরে বেড়ালেন চে। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে এর অংশ হিসেবে গোপনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা আমাদের বাংলাদেশেও এসেছিলেন তিনি। সাক্ষাৎ করেছিলেন আদমজী পাটকলের শ্রমিকদের সাথে। কিউবার পক্ষে কাজ করতে বের হলেও যেখানেই গিয়েছেন, প্রকাশ্যে বা গোপনে যেভাবেই হোক সেখানকার কৃষক ও শ্রমিক সমাজের সাথে মিশে গিয়েছেন চে ক্ষণকালের জন্যে হলেও। এখানেই চের অনন্যতা, এখানেই চের প্রাসঙ্গিকতা।

কিউবার হয়ে এই যে চের দেশে দেশে ঘোরা, জাতিসংঘে বক্তব্য প্রদান করা আর তার জীবন যাপনের স্টাইল, সবই চেকে বিশ্বের শোষিত, নিপীড়িত মানুষের কাছে পরিণত করেছিল নিজেদের নেতা হিসেবে। পৃথিবী প্রত্যক্ষ করল একজন জাতীয় নেতাকে যিনি রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকেও শ্রমিকদের সাথে চিনির বস্তা বহন করেন কিংবা স্কুল নির্মাণে কায়িক পরিশ্রম করেন কিংবা বিমানবন্দরে স্বেচ্ছাশ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। কিউবায় সফল বিপ্লবের পর ক্ষমতার চর্চায় থেকে একটি সুন্দর, নিরাপদ জীবন কাটিয়ে দিতে পারতেন চে গেভারা। কিন্তু এখানেই চের বিচিত্রতা, এখানেই তার আলাদা হয়ে ওঠা। চে শুধু কিউবার মানুষের মুক্তি চান নি, চে চেয়েছিলেন পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের মুক্তি। এজন্যেই স্বপ্ন দেখেছিলেন আরো দু’টি, তিনটি ভিয়েতনামের। স্বপ্ন দেখে থেমে থাকেন নি, কঙ্গো যুদ্ধে ছুটে গিয়েছেন যোদ্ধা হিসেবে, বলিভিয়ার জঙ্গলে চলে গিয়েছেন আরেকটি বিপ্লবের নেশায়। চে তাঁর স্বপ্ন পূরণের নেশায় ছুটে বেরিয়েছেন পথ থেকে পথে, ডাক দিয়ে গিয়েছেন বিপ্লবের। এভাবেই তিনি নিজেকে নিজের স্বপ্নের চেয়েও বড় হিসেবে গড়ে তুলেছেন।

চের জীবন আমাদের শিহড়িত করে, চের কুখ্যাতি আছে রোমান্টিসিজমের জন্যে। কিন্তু রোমান্টিসিজম যদি মানুষের মুক্তির জন্যে হয় তাতে দোষ কোথায়! রোমান্টিসিজম না থাকলে চে কোনদিন মেক্সিকো হয়ে কিউবায় আসতেন কি? হতে পারতেন আর্নেস্তো গেভারা থেকে কমরেড চে? হতে পারতেন বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের প্রতিবাদের শক্তি? চের এই রোমান্টিসিজম আজ আমাদের খুব দরকার, বড় বেশি দরকার।

১৪ জুন, চে গেভারার জন্মদিন। শুভ জন্মদিন বন্ধু, পথ দেখাও চিরকাল।

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।