শিবলী নোমান
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রতিটি কোর্সের একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক মার্কস বা নম্বর ঐ কোর্সের ক্লাসগুলোতে একজন শিক্ষার্থীর উপস্থিতি/অনুপস্থিতির হারের বিপরীতে বণ্টন করার প্রথা বা নিয়ম দেখা যায় অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই। নিশ্চিতভাবেই কিছু কারণ ও যুক্তিকে ভিত্তি করেই এই ব্যবস্থাটি গ্রহণ করা হয়েছিল, যদিও তা আমার কাছে স্পষ্ট নয়, কিংবা এখনো অজানা।
তবে মোটাদাগে এরূপ ‘অ্যাটেনডেন্স মার্কিং’ প্রথাকে আমি সমর্থন করি না। যদিও এই মার্কিং প্রথার কারণে শিক্ষার্থীরা খুব সহজেই দুইটি গ্রেডের সমান মার্কস পেয়ে যান। তবুও কতিপয় কারণে বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় এই মার্কিং প্রথাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে অপ্রয়োজনীয়, অপাসঙ্গিক ও ক্ষেত্রবিশেষে অন্যায্য মনে করি।
এক্ষেত্রে প্রথমেই বলতে হয়, শিক্ষার্থীদেরকে ক্লাস করতে বাধ্য করার বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণার সাথে কোনভাবেই যায় না। বরং কোন্ কোন্ বিষয়ে পড়বেন, সে বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে একজন শিক্ষার্থীর পূর্ণ স্বাধীনতা ও নির্বাচনের অধিকার থাকার কথা। এই বিষয়টিকে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মোটাদাগে উপেক্ষা করেছে।
দ্বিতীয়ত, মনে রাখা জরুরি, স্বাভাবিক অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষায় বৃহৎ জনগোষ্ঠীর বড় অংশটির প্রবেশের কথা না। বরং গুরুত্বটি বেশি দেয়ার কথা ছিল কারিগরি শিক্ষায়। তা না করে যে কোন চাকরিতে আবেদনের ন্যূনতম যোগ্যতা হিসেবে স্নাতক (সম্মান), এমনকি বহু ক্ষেত্রে স্নাতকোত্তর পর্যায়ের সনদ থাকাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অথচ বলা হয়ে থাকে স্নাতকোত্তর পর্যায়ের পড়ালেখাটি মূলত শিক্ষা ও গবেষণা ক্ষেত্রে আগ্রহীদের জন্য। ফলে ইচ্ছার বিপরীতে হলেও শিক্ষার্থীদের আসলে উচ্চশিক্ষার একটি বা দুইটি সনদপত্র প্রয়োজন। অন্যদিকে সনদ পাওয়ার পর চাকরির জন্য আবারও পরীক্ষা দেয়ার ব্যাপার আছে। ফলে প্রাথমিক প্রয়োজন সনদপত্র ও চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি, ক্লাসের পাঠ্য নয়। আর বিদ্যমান ব্যবস্থায় সেটিই হওয়ার কথা। এরূপ বাস্তবতায় ভুলে গেলে চলে না যে, শারীরিক চাহিদা না মিটলে আপনি সৃজনশীল হওয়ার দিকে আগানোর কথা ভাবতে পারেন না।
তৃতীয়ত, পাঠ্য বিষয়ের প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ থাকলে শিক্ষার্থীরা নিজে থেকেই ক্লাসে আসবেন। এই আগ্রহের পেছনে প্রণোদনা হিসেবে জ্ঞানার্জনের ইচ্ছা কিংবা জীবিকা নির্বাহের নিশ্চয়তা, যেটিই থাকুক না কেন। সেক্ষেত্রে বড় একটি ভূমিকা শিক্ষকেরও থেকে যায়। ইন্টারনেটের কল্যাণে পাঠ্য বিষয়ের সবকিছুই এখন সহজলভ্য। কিন্তু সেই বিষয়গুলোকে সাবলীলভাবে শিক্ষার্থীদের সামনে উপস্থাপনই শিক্ষকতাকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। অ্যাটেনডেন্স মার্কিং প্রথা নিয়ে আলোচনা আসলেই এই বিষয়টি সামনে চলে আসে, আবার কোন এক অদ্ভুত কারণে খুব দ্রুতই আলোচনা থেকে সরেও যায়।
চতুর্থত, শুধুমাত্র ক্লাসে উপস্থিত থাকার কারণে একটি কোর্সের ১০ শতাংশ মার্কস নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার কারণে ক্লাসের আলোচ্য বিষয়ের প্রতি আগ্রহী শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি ঐ নম্বর প্রাপ্তির জন্য এক ঝাঁক অনাগ্রহী (অনাগ্রহের পেছনে যৌক্তিক ও অযৌক্তিক কারণসমেত) শিক্ষার্থীও ক্লাসে আসেন। কিন্তু আলোচ্য বিষয়ের প্রতি কোন আগ্রহ না থাকায় তারা আলোচনায় যুক্ত হন না কিংবা হতে পারেন না। যা কোন কোন ক্ষেত্রে শিক্ষককে যেমন হতাশ করে, তেমনি আগ্রহী শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন উত্থাপনকেও নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করে। কারণ অতিরিক্ত প্রশ্ন মানেই ক্লাসের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি, যদিও উপস্থিতি পাওয়া যাবে একটি, বা বেশি হলে দুইটি মাত্র।
সর্বোপরি, একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ মার্কসের জন্য শিক্ষার্থীদের ক্লাসে উপস্থিত থাকতে বাধ্য করা কি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিত্যদিন যে মুক্তবুদ্ধি চর্চা ও উদারতার বাণী উচ্চারণ করা হয়, তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আচরণ হতে পারে?
আমি মনে করি না, হতে পারে না।
তাই আমি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ‘অ্যাটেনডেন্স মার্কিং’ প্রথা সমর্থন করি না।