শিবলী নোমান

তাত্ত্বিকের দর্শন, কিংবা মেটা থিওরি সংক্রান্ত (৩)

শিবলী নোমান

মেটা থিওরি নিয়ে এই আলাপের প্রথম পর্বে বস্তুনিষ্ঠ সত্য সম্পর্কে তাত্ত্বিকদের নিজেদের ধারণা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছিল। আর দ্বিতীয় পর্বে ছিল পৃথিবী সম্পর্কে তাত্ত্বিকগণ কী কী প্রশ্ন উত্যহাপন করেন, তা নিয়ে আলোচনা। এই দুইটি প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাওয়ার পরই একজন তাত্ত্বিক তত্ত্ব তৈরির দিকে এগিয়ে যান। আজকের আলোচনায় থাকছে সর্বশেষ প্রশ্ন, তাত্ত্বিক কীভাবে তত্ত্ব তৈরির দিকে এগিয়ে যান?

কীভাবে তত্ত্ব তৈরির দিকে এগিয়ে যাই?

এক্ষেত্রে তত্ত্ব তৈরির তিনটি চিরাচরিত ধারার কথা বলা হয়। এগুলো হলো Covering Law Approach, Rules Approach ও Critical Approach।

এক্ষেত্রে কাভারিং ল অ্যাপ্রোচ ও রুলস অ্যাপ্রোচ হলো বিপরীতমুখী দুইটি ধারা। আর সিস্টেম অ্যাপ্রোচ হলো বিভিন্ন উপায়ে প্রথম দুইটি ধারার ভেতর সমন্বয় সাধন করে এগিয়ে যাওয়ার একটি প্রয়াস।

একজন তাত্ত্বিক যখন মনে করেন, সকল ঘটনাই কোন না কোন সূত্র মেনে চলে এবং সেই সূত্রটি ধরতে পারলে অন্য সকল স্থানের সমরূপ ঘটনাগুলোকে একই সূত্রে ফেলে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ তথা সাধারণীকরণ করা যায়, তখন তিনি কাভারিং ল অ্যাপ্রোচ ব্যবহার করে তত্ত্ব তৈরির দিকে এগিয়ে যান। অর্থাৎ এই অ্যাপ্রোচে মনে করা হয় জগতের সবকিছুই কোন কোন কোন ল বা আইন বা সূত্র মেনে চলে।

এক্ষেত্রে সাধারণ ভাবে মেনে নেয়া হয় যে, কোন বিষয়ে মানুষের একটি কাজ করার বা একটি বিষয়কে বাছাই করে নেয়ার পেছনে কোন না কোন কারণ থাকে। অর্থার পুরো বিষয়টি হয় cause and effect বা কার্যকরণ সম্পর্কপূর্ণ।

কাভারিং ল অ্যাপ্রোচের মাধ্যমে কোন একটি ঘটনাকে সম্পূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম, এমন তত্ত্ব নির্মাণের চেষ্টা করা হয়।

অন্যদিকে রুলস অ্যাপ্রোচে তত্ত্ব তৈরি করতে হলে একজন তাত্ত্বিক ধরে নেন যে, কোন ঘটনাই অকাট্য আইন বা সূত্র মেনে চলে না। বরং মানুষের প্রতিটি কাজ কিংবা যে কোন ঘটনাই আসলে কিছু নিয়ম মেনে চলে।

এক্ষেত্রে আইন (ল) ও নিয়মের (রুল) ভেতর পার্থক্য নিশ্চিতের জন্য বলে নেয়া ভালো যে, নিয়ম বা রুলস বলতে এখানে সেসব বিষয়কেই বুঝানো হচ্ছে যেগুলো সাধারণভাবে মানা হলেও, মানুষ তার খেয়াল-খুশিমতো এসব নিয়ম পরিবর্তন করতে পারে, ভাঙতেও পারে। অর্থাৎ প্রতিটি ঘটনার পেছনে সাবজেক্টিভ বিষয়টিকে এই অ্যাপ্রোচ গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করে।

বিভিন্ন বাধা-বিপত্তি থাকার পরও প্রতিটি কাজের জন্য মানুষকেই active choice maker হিসেবে স্বীকার করে নেয় হয় এই অ্যাপ্রোচটিতে। আর সেভাবেই তত্ত্ব তৈরির চেষ্টা করা হয়।

সর্বশেষ, সিস্টেম অ্যাপ্রোচে নির্মিত তত্ত্বগুলো রুলস অ্যাপ্রোচকে স্বীকার করে নিলেও মানুষের স্বতন্ত্র সাবজেক্টিভিটিকেই একমাত্র ও চূড়ান্ত বলে মনে করে না। বরং এই অ্যাপ্রোচ বলতে চায়, একটি মানুষ বা ঘটনা যেই সিস্টেম থেকে উদ্ভূত, সেই সিস্টেম দ্বারা ঐ মানুষ বা ঘটনার প্রতিটি আচরণ ও ফলাফলসমূহ প্রভাবিত হয়।

এক্ষেত্রে একটি সিস্টেমের সামগ্রিকতা, সিস্টেমে বিদ্যমান সকল অংশের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা, পদক্রম (suprasystem ও subsystem), সীমানা, মান যাচাই ও ফিডব্যাককে ঐ সিস্টেমটির উপাদান মনে করা হয়। যে কোন সিস্টেমের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো equifinality, এর অর্থ হলো বিভিন্ন সিস্টেম একই ধরণের সমস্যা সমাধানে আলাদা আলাদা পথ বেছে নিতে পারে। অর্থাৎ একই লক্ষ্য ভিন্ন ভিন্ন পথে অর্জন করা সম্ভব। ঠিক এ কারণেই একটি বিষয় ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা তত্ত্বও দেখা যায় হরহামেশাই।

যোগাযোগ অধ্যয়নে বিদ্যমান তত্ত্বসমূহের ভিত্তিতে বলা যায়, কাভারিং ল অ্যাপ্রোচে মানব যোগাযোগের ক্ষেত্রে যে অপরিবর্তনীয় ও সাধারণ বৈশিষ্ট্যসমূহের সন্ধান করা হয়, তা অর্জনকে সিস্টেম অ্যাপ্রোচ অসম্ভব মনে করে। এতে ধরা হয় যে মানবীয় যোগাযোগে কোন সার্বজনীন কিংবা একক ধরণ বা নিয়ম নেই। এটি সিস্টেমেটিক, কিন্তু অসার্বজনীন একটি বিষয়।

অর্থাৎ সিস্টেম অ্যাপ্রোচে কোন বিষয়ের নির্দিষ্ট কারণ বা ব্যাখ্যা খুঁজে বের করার মতো বিষয়াদি থাকে না, বরং থাকে একটি বিষয়ের আংশিক ব্যাখ্যা, কিংবা একই বিষয়ের সম্ভাব্য কিন্তু আলাদা আলাদা ব্যাখ্যা। অর্থাৎ কাভারিং ল অ্যাপ্রোচ ও রুলস অ্যাপ্রোচের এক ধরনের মিশ্রণ রয়েছে এই অ্যাপ্রোচে।

শেষ বিচারে, সিস্টেম অ্যাপ্রোচ হলো তাই যা ঘটমান একটি বিষয়কে বুঝতে বা ব্যাখ্যা করতে একটি মডেল তৈরির জন্য তাত্ত্বিক উপায় উন্মোচন করে, যেখানে নানা ধরণের বাহ্যিক প্রভাবকের দ্বারা পরিবর্তনের সম্ভাবনাকে মেনে নেয়া হয়।

সতর্কীকরণ

একজন তাত্ত্বিক কীভাবে তার তত্ত্বটি তৈরি করবেন সে সংক্রান্ত তিনটি অ্যাপ্রচকে যদি এই আলোচনার পূর্ববর্তী অংশের তিনটি ধারার সাথে মেলানোর চেষ্টা করা হয়, তাহলে সেটি থেকে বিভ্রান্তি তৈরির সুযোগ থেকে যাবে। অর্থাৎ, এটি কোনভবেই ধরে নেয়া যাবে না যে এম্পিরিক্যাল, ইন্টারপ্রেটিভ ও ক্রিটিক্যাল ধারার তাত্ত্বিকরা তত্ত্ব তৈরির জন্য সর্বদা যথাক্রমে কাভারিং ল, রুলস ও সিস্টেম অ্যাপ্রোচই বেছে নিবেন। এই আলোচনায় মেটা থিওরির আলোচ্য তিনটি প্রশ্নের সকল স্থানেই তিনটি ধারা ও তিনটি অ্যাপ্রোচ নিয়ে আলোচনা থাকায় এই বিভ্রান্তির সুযোগ থেকে যায়।

বস্তুত আলোচ্য তিনটি প্রশ্নের ভেতর প্রথম দুইটিকে একটি সত্তা ও সর্বশেষ প্রশ্নটিকে একটি পৃথক সত্তা হিসেবে বিবেচনা করলে তাত্ত্বিকের দর্শন নিয়ে পাঠকের বোঝাপড়া তুলনামূলক স্পষ্ট হতে পারে।

কারণ, যেখানে উপরোক্ত আলোচনা তিনটি ধারার তত্ত্বে আলোকপাত করে, সেখানে বারেল ও মরগান ক্রিটিক্যাল ধারার কোন উল্লেখ ছাড়াই Objective—Subjective এবং Regulation—Radical Change মেরুকরণের মাধ্যমে সামাজিক বিজ্ঞানের চারটি প্যারাডাইম চিহ্নিত করেছেন। এগুলো হলো, Functionalist, Interpretive, Radical Humanist ও Radical Structuralist প্যারাডাইম।

বারেল ও মরগান কর্তৃক চিহ্নিত সামাজিক বিজ্ঞানের চার প্যারারডাইম

পরবর্তীতে ডিটজ আবার তার মতো করে সামাজিক বিজ্ঞানের ডিসকোর্সগুলোকে Normative, Interpretive, Critical ও Dialogic Studies-এ ভাগ করেন।

ডিটজ প্রদত্ত সামাজিক বিজ্ঞানের চার ডিসকোর্স

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি

Introducing Communication Theory: Analysis and Application (6th Ed.) by Richard West and Lynn H. Turner

Theories of Human Communication by (11th ed.) by Stephen W. Littlejohn, Karen A. Foss and John G. Oetzel

A First Look at Communication Theory (10th ed.) by Em Griffin, Andrew Ledbetter and Glenn Sparks

Mass Communication Theories: Explaining Origins, Processes, and Effects by Melvin DeFleur

(সমাপ্ত)

৪ thoughts on “তাত্ত্বিকের দর্শন, কিংবা মেটা থিওরি সংক্রান্ত (৩)”

  1. Pingback: তাত্ত্বিকের দর্শন, কিংবা মেটা থিওরি সংক্রান্ত (২) – শিবলী নোমান

  2. Pingback: তাত্ত্বিকের দর্শন, কিংবা মেটা থিওরি সংক্রান্ত (১) – শিবলী নোমান

  3. এই পর্বটা একটু জটিল লাগলো প্রথম পাঠে। আবার পড়লে সহজ হয়ে আসতে পারে। যদি সম্ভব হয়, লেখার একাডেমিশিয়ান অ্যাপ্রোচ থেকে আরেকটু জনবোধ্য করা যায় কিনা, ভাবা যেতে পারে বলে মনে করি। তবে, ভালো লাগছে। খন্ড করে বিভিন্ন থিওরী/থটস্কুল নিয়ে লেখা পেলে ভালো লাগবে।

    ধন্যবাদ!

    1. তৃতীয় প্রশ্নটাতে এসেই বিষয়টা বেশ জটিল হয়ে যায়, বিশেষ করে যখন কাউকে বুঝানোর চেষ্টা করি। বেশ ভালো সম্ভাবনা আছে যে এটি হয়তো আমারই দুর্বলতা। তবে এই পর্বটা আবারও পুনর্লিখন করার কথা ভাবতে হবে।
      অনেক ধন্যবাদ মতামত দেয়ার জন্য।

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।