শিবলী নোমান
মেটা থিওরি নিয়ে এই আলাপের প্রথম পর্বে বস্তুনিষ্ঠ সত্য সম্পর্কে তাত্ত্বিকদের নিজেদের ধারণা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছিল। এ সংক্রান্ত ধারণা স্পষ্ট হওয়ার পরপরই তাত্ত্বিকদের সামনে উপস্থিত হয় দ্বিতীয় প্রশ্নটি। আর তা হলো, আমি পৃথিবী সম্পর্কে কী কী প্রশ্ন উত্থাপন করি?
পৃথিবী সম্পর্কে কী কী প্রশ্ন উত্থাপন করি?
পৃথিবীতে বিদ্যমান বিষয়াদির পেছনের সত্য আসলে কেমন ও কীভাবে তা উন্মোচন করা যায় সে বিষয়ে নিজস্ব অবস্থান তৈরি হওয়ার পর পৃথিবী বা বিশ্ব সম্পর্কে এই পর্যায়ে তিনটি আলাদা বিষয়ে আলোকপাত করা হয়। এগুলো হলো Ontology, Epistemology ও Axiology। এই তিনটি বিষয় নিয়ে একজন তাত্ত্বিকের অবস্থান কেমন হবে, তা নির্ভর করে প্রথম প্রশ্নের প্রেক্ষিতে ঐ তাত্ত্বিক এম্পিরিক্যাল, ইন্টারপ্রেটিভ বা ক্রিটিক্যাল, কোন ধারায় অবস্থান করছেন তার উপর।
Ontology হলো nature of reality বা বাস্তবতার প্রকৃতি। অনেকে একে দর্শনের প্রাথমিক বিষয় মনে করেন। কারণ, বাস্তবতা তথা বস্তুজগতের প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা নির্দিষ্ট না হলে একজন তাত্ত্বিক বা কোন মানুষই অন্য কোন বিষয়ে নিজের স্পষ্ট ধারণা তৈরি করতে পারেন না। বাস্তবতা সম্পর্কে এই ধারণা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হতেই পারে, কিন্তু একটি নির্দিষ্ট সময়ে একজন তাত্ত্বিকের এ বিষয়ে কোন একটি স্পষ্ট অবস্থান থাকতেই হয়।
এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় প্রশ্ন হলো একজন মানুষ আসলে কতটা স্বাধীন, কিংবা একজন মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা পোষণের ক্ষমতা আছে, নাকি নেই। স্বাধীন ইচ্ছা থেকে থাকলে তার মাত্রাই বা কেমন। অর্থাৎ যে কোন কাজ করার ক্ষেত্রে একজন মানুষ কতটা স্বাধীনভাবে সেই কাজটি করতে পারে।
এম্পিরিক্যাল ধারার তাত্ত্বিকরা যেহেতু নির্দিষ্ট সূত্র মেনে চলা ও বস্তুনিষ্ঠ সত্য থাকার বিষয়টিকে বিশ্বাস করেন, তাই তাদের মতে মানুষ চাইলেই যে কোন কাজ যেভাবে খুশি করতে পারে না। তাকে কোন না কোন সূত্র মেনে কাজ করতে হয়, অর্থাৎ মানুষ প্রকৃতি বা মানবসৃষ্ট সূত্রের অধীন।
একই কারণে ইন্টারপ্রেটিভ ধারার তাত্ত্বিকরা মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার ক্ষমতাকে বিশ্বাস করে। অন্যদিকে, ক্রিটিক্যাল ধারার তাত্ত্বিকরাও একই ধরনের বিশ্বাস পোষণ করলেও, তারা মনে করেন সমাজে বিদ্যমান ক্ষমতাবান শ্রেণি ও ক্ষমতা কাঠামো মানুষের এই স্বাধীন ইচ্ছার ক্ষমতাগুলো নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের বড় অংশটিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে।
এক্ষেত্রে, বারেল ও মরগান অন্টোলজির প্রকৃতিকে Realism—Nominalism (Empirical—Interpretive/Critical) মেরুতে ভাগ করেন।
অন্যদিকে, Epistemology-র অর্থ how we know things?, বা আমরা কোন একটি বিষয়ে কীভাবে জেনে থাকি? এক্ষেত্রে মূলত কোন একটি বিষয় জানার ক্ষেত্রে তাত্ত্বিকদের মনোভাব নিয়ে আলোচনা করা হয়।
এম্পিরিক্যাল ধারার তাত্ত্বিকরা বস্তুনিষ্ঠ সত্য বের করার জন্য নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ ও চলক ব্যবহার করে তাদের গবেষণাকর্ম চালিয়ে যান। এক্ষেত্রে একটি বিদ্যমান তত্ত্বকে কাঠামো হিসেবে গ্রহণ করে গবেষণালব্ধ ফলাফল থেকে নতুন তত্ত্ব আসতে পারে, কিংবা বিদ্যমান তত্ত্বের সংশোধন-সংযোজন-বিয়োজন-পরিমার্জন হয়তে পারে, কিংবা গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পেতে পারে।
অন্যদিকে, ইন্টারপ্রেটিভ ধারার তাত্ত্বিকরা নিয়ন্ত্রিত গবেষণার স্থলে গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের বক্তব্য ও অভিজ্ঞতার উপর গুরুত্বারোপ করে কোন একটি বিষয় সম্পর্কে জানতে চান। এক্ষেত্রে একটি তত্ত্বকে গবেষণার কাঠামো হিসেবে ধরে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং গবেষণা শুরুর একটি নির্দিষ্ট সময় পর গবেষণার সাথে সাথে নতুন তত্ত্বের সৃষ্টি চলতে থাকে।
অনেকটা একই পথে, ক্রিটিক্যাল ধারার তাত্ত্বিকরা তাদের গবেষণার মাধ্যমে বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থার সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে এগুলোর সমালোচনা করেন এবং কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের আহ্বান জানান।
বারেল ও মরগান এপিস্টেমোলজি নিয়ে বিভিন্ন ধারার তাত্ত্বিকদের প্রকৃতিকে Positivism—Anti-Positivism (Empirical—Interpretive/Critical) মেরুতে ভাগ করেন।
দ্বিতীয় প্রশ্নের ভেতর আলোচ্য সর্বশেষ বিষয়টি হলো Axiology, বা what is worth knowing? মেটা থিওরিতে অ্যাক্সিওলজি বলতে মূলত একটি তত্ত্ব তৈরির প্রক্রিয়ায় তাত্ত্বিক বা গবেষকের নিজ মূল্যবোধের উপস্থিতি/অনুপস্থিতি কিংবা গুরুত্বকে নির্দেশ করা হয়। অর্থাৎ তত্ত্ব বা গবেষণার পেছনে তাত্ত্বিক বা গবেষকের নিজস্ব বিশ্বাস-আদর্শ-মূল্যবোধের কোন ভূমিকা আদৌ থাকবে কি না, থাকলে তার মাত্রাই বা কেমন হবে, তাই হলো অ্যাক্সিওলজির আলোচনার ক্ষেত্র।
এম্পিরিক্যাল ধারার তাত্ত্বিকরা মনে করেন যে কোন গবেষণাকে অবশ্যই ভ্যালু ফ্রি হতে হবে, অর্থাৎ গবেষণায় গবেষক বা তাত্ত্বিকের নিজস্ব মূল্যবোধের কোন ভূমিকা রাখার সুযোগ একেবারেই নেই। যেহেতু এই ধারার তাত্ত্বিকরা মনে করেন বস্তুনিষ্ঠ সত্য উদঘাটন সম্ভব এবং সত্যের রূপ সর্বত্রই এক, তাই গবেষণায় নিজেদের মূল্যবোধকে তারা বস্তুনিষ্ঠ সত্য উদঘাটনের অন্তরায় হিসেবেই বিবেচনা করেন। তবে আসলেই নিজের কোন ধরণের মূল্যবোধ প্রয়োগ না করে কোন গবেষণা কর্ম চালিয়ে নেয়া সম্ভব কিনা, সেটিই একটি বিতর্কের বিষয়।
ইন্টারপ্রেটিভ ধারার তাত্ত্বিকরা তাদের গবেষণা ও তত্ত্বকে নিজেদের মূল্যবোধ অনুযায়ী পরিচালিত করেন। তারা এটিও বিশ্বাস করেন যে, একটি গবেষণার কোন অংশ থেকেই মূল্যবোধকে বাদ দেয়া সম্ভব নয়।
অন্যদিকে, ক্রিটিক্যাল ধারার তাত্ত্বিকরা গবেষণা বা তত্ত্বে গবেষক বা তাত্ত্বিকের মূল্যবোধের উপস্থিতিকে শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় ও অবিচ্ছেদ্য অংশই মনে করেন না, বরং তারা একে সকল গবেষণার আকাঙ্ক্ষিত বিষয় হিসেবে আখ্যা দেন। সমাজ পরিবর্তনই ক্রিটিক্যাল তাত্ত্বিকদের মূল্য লক্ষ্য হওয়ায় তারা গবেষণা ও তত্ত্বে নিজেদের মূল্যবোধের প্রতিফলনকে অত্যাধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।
বারেল ও মরগানের ব্যাখ্যায় অ্যাক্সিওলজিকে human nature হিসেবে উল্লেখ করে একে Determinism—Voluntarism (Empirical—Interpretive/Critical) মেরুতে ভাগ করা হয়েছে।
Ontology, Epistemology ও Axiology-কে বারেল ও মরগান সামাজিক বিজ্ঞানের চরিত্র বা প্রকৃতি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এগুলোর মাধ্যমে তারা এসব ধারার গবেষণা পদ্ধতিকে Nomothetic—Ideographic (Empirical—Interpretive/Critical) মেরুতে ভাগ করেছেন। উপরোক্ত ব্যাখ্যা অনুযায়ী, সামগ্রিকভাবে সামাজিক বিজ্ঞানকে ভাগ করেছেন Objective—Subjective (Empirical—Interpretive/Critical) মেরুতে।
সমাজকে Regulation—Radical Change ও সামাজিক বিজ্ঞানকে Objective—Subjective মেরুতে ভাগ করার মাধ্যমে বারেল ও মরগান সামাজিক বিজ্ঞানের চারটি প্যারাডাইম চিহ্নিত করেন। এক্ষেত্রে Stanley Deetz প্রণীত সামাজিক বিজ্ঞানের ধারাসমূহকে দুইটি অক্ষের মাধ্যমে চারটি ডিসকোর্সে ভাগ করার বিষয়টিও দেখা যেতে পারে।
এর মাধ্যমে আমরা তাত্ত্বিকদের দার্শনিক মনস্তত্ত্ব তৈরিতে ভূমিকা রাখা বিষয়গুলোর সাথে পরিচিত হলাম।
এরপরই আছে সর্বশেষ প্রশ্ন, যা আসলে একজন তাত্ত্বিকের দার্শনিক মনস্তত্ত্ব তৈরি হয়ে যাওয়ার পর কীভাবে তিনি তত্ত্ব তৈরির দিকে এগিয়ে যেতে পারেন, সে সংক্রান্ত প্রস্তাবনা।
(চলবে)
Pingback: তাত্ত্বিকের দর্শন, কিংবা মেটা থিওরি সংক্রান্ত (১) – শিবলী নোমান
Pingback: তাত্ত্বিকের দর্শন, কিংবা মেটা থিওরি সংক্রান্ত (৩) – শিবলী নোমান