শিবলী নোমান
তত্ত্ব নিয়ে বেশি কথা বলা এই অঞ্চলের মানুষ ভালো চোখে দেখে, অভিজ্ঞতা তেমনটা বলে না। ভালো-খারাপ বাইনারির বাইরে কথাটিকে কিছুটা ঘুরিয়েও বলা যায় এভাবে— তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা অনেকটাই খটমটে মনে হয় বলে তত্ত্ব নিয়ে কথা শুরু করার পরপরই শ্রোতার সংখ্যা কমে যেতে শুরু করে।
যদিও মজার বিষয় হলো, যেহেতু তত্ত্বের অর্থ দৈনন্দিন জীবনে ঘটে যাওয়া একটি বিষয় বা ব্যাপারকে ব্যাখ্যা করা ও ভবিষ্যত নিয়ে সম্ভাব্য অনুমান তৈরি করা— সেই অর্থে নিজেদের বাস্তবতায় আমরা প্রত্যেকে একেকজন তাত্ত্বিক হয়েও তত্ত্ব নিয়ে আলাপ থেকে দূরে থাকাটাই পছন্দ করি, যদিও অ্যাকাডেমিক তত্ত্ব এতটা সরলভাবে গড়ে ওঠে না। এমন একটি অবস্থায় তত্ত্বের কারিগর, তথা তাত্ত্বিকের দর্শন নিয়ে আলোচনা অজনপ্রিয় হওয়ার সম্ভাবনায় পরিপূর্ণ। তবে, তাত্ত্বিকের দর্শন স্পষ্ট হলে তত্ত্ব নিয়ে আলাপ কিংবা পড়ালেখা যাদের ভালো লাগে, তাদের জন্য তত্ত্বের খুঁটিনাটি বিষয় যে আরো চিত্তাকর্ষক হয়ে উঠবে, সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই।
একজন তাত্ত্বিকের এই দার্শনিক অবস্থান, যার উপর ভিত্তি করেই একটি তত্ত্বের গঠনপ্রক্রিয়া নির্ধারিত হয়, একে সাধারণত Meta Theory-র অধীনে আলোচনা করা হয়। গ্রিক শব্দ meta মূলত একটি prefix, যার অর্থ about the thing itself। অর্থাৎ, মেটা থিওরি মানে হলো তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা কিংবা তত্ত্ব নিয়ে তত্ত্ব। অথবা সহজ ভাষায় বললে, একটি তত্ত্ব কীভাবে তৈরি হলো ও সেই তত্ত্বের মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনাই হলো মেটা থিওরি।
যেহেতু তত্ত্ব মানেই হলো কোন একটি বিষয়কে ব্যাখ্যা করা, তাই ব্যাখ্যাটি বস্তুনিষ্ঠ হোক বা না হোক, গ্রহণযোগ্য হোক বা না হোক, ব্যাখ্যাটি প্রদানের পেছনে ব্যাখ্যাকারীর ব্যাখ্যার দৃষ্টিভঙ্গি বা ব্যাখ্যা সংক্রান্ত বিশ্বাসসমূহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটিই মূলত কোন একটি বিষয় জানার ক্ষেত্রে বা ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে একজন তাত্ত্বিকের দার্শনিক অবস্থান। বিষয়টি অনেকটা চশমা বা লেন্সের মতো, চশমা বা লেন্সের রঙ যেমন হবে, সেটি চোখে দিলে দুনিয়াটাও তেমনই দেখাবে। আর লেন্স দিয়ে আশেপাশের দুনিয়াকে লাল রঙের দেখালে, সেই লাল রঙের প্রেক্ষাপটেই দুনিয়াকে ব্যাখ্যা করা হবে।
তো, একজন তাত্ত্বিকের এই লেন্সটা আসলে কী রঙের, তথা কেমন হবে, তা নির্ভর করে তিনটা প্রশ্নের উত্তর হিসেবে তাত্ত্বিক কোন বিষয়গুলোকে গ্রহণ করছেন তার উপর। প্রশ্ন তিনটি হলো,
ক) আমি পৃথিবীকে কীভাবে দেখি ও কীভাবে এর সম্পর্কে কথা বলি?
খ) আমি পৃথিবী সম্পর্কে কী কী প্রশ্ন উত্থাপন করি?
গ) আমি কীভাবে তত্ত্ব তৈরির দিকে এগিয়ে যাই?
এক্ষেত্রে প্রথম দুইটি প্রশ্ন ও এর উত্তর একে অপরের সাথে এতটাই জড়িত যে, এগুলোর প্রতিটি বিষয় একে অপরকে প্রভাবিত করে ও তাত্ত্বিকের দর্শন তৈরিতে সমান ও পরস্পর সম্পর্কিত ভূমিকা রাখে। প্রথম দুইটি প্রশ্ন যেখানে তাত্ত্বিকের দার্শনিক মনস্তত্ত্ব তৈরি করে দেয়, সেখানে তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর থেকে একজন তাত্ত্বিক তার দার্শনিক মনস্তত্ত্বের আলোকে তত্ত্ব তৈরি করার পথটি খুঁজে নেন।
পৃথিবীকে কীভাবে দেখি ও কীভাবে এর সম্পর্কে কথা বলি?
আমাদের চারপাশে নিত্যদিন ঘটে যাওয়া বিষয়গুলোকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে বিদ্যমান সঠিক, বস্তুনিষ্ঠ ও সত্য ব্যাখ্যার সংখ্যা বা পরিমাণই এই প্রশ্নের মূল আলোচ্য।
এক্ষেত্রে মোটাদাগে দুইটি উত্তর বা চিন্তাধারা দেখা যায়।
প্রথমত, তাত্ত্বিকদের একটি দল মনে করেন, নির্দিষ্ট সূত্র মেনে যে কোন বিষয় বা ঘটনার পেছনের বস্তুনিষ্ঠ সত্য বা কারণ উদঘাটন করা সম্ভব। আর এই ধারায় বিশ্বাসী তাত্ত্বিকরা সেটিই করতে চান। বস্তুনিষ্ঠ সত্য উদঘাটনের লক্ষ্যে এই ধারার তাত্ত্বিকরা অনেকসময় তাদের গবেষণা চলাকালে বিভিন্ন চলক ও পরিবেশ নিয়ন্ত্রণও করে থাকেন, ল্যাবরেটরি রিসার্চ এ ধরণেরই গবেষণা।
বলে রাখা ভালো যে, এই ধারার তাত্ত্বিক ও গবেষকরা তাদের গবেষণাকে একটি তাত্ত্বিক ভিত্তি ধরে এগিয়ে নিয়ে যান। সেখান থেকে নতুন ফলাফল বা তত্ত্ব আসতে পারে। এই ধারাটিকে অনেকে বৈজ্ঞানিক ধারা বা পদ্ধতি বলে থাকেন, যা একটি বিতর্কিত ডিসকোর্সও বটে।
এই ধারার তাত্ত্বিকরা আরেকটি বিষয় বিশ্বাস করেন। আর তা হলো, যে কোন তত্ত্বই আসলে গবেষণালব্ধ ফলাফল থেকে তৈরি হয়।
তাত্ত্বিকদের এই ধারাটিকে Empirical, Objective, Positivistic প্রভৃতি পরিচয়ের মাধ্যমে নির্দেশ করা হয়। যোগাযোগ ও গণমাধ্যম অধ্যয়নে Agenda Setting Theory, Two Step Flow Theory, Social Learning Theory-র মতো তত্ত্বগুলো এরূপ ধারা থেকে উদ্ভূত।
অপরদিকে, তাত্ত্বিকদের অপর দলটি মনে করেন যে কোন বিষয়ে সত্য আসলে বস্তুনিষ্ঠ নয়, বরং ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে সত্যের রূপ ও ধরণ বদলে যায়। তারা এটিও মনে করেন যে, নিয়ন্ত্রিত গবেষণা নয়, বরং যে ঘটনা ব্যাখ্যার চেষ্টা করা হচ্ছে, তাতে অংশগ্রহণের মাধ্যমেই সত্যের একটি দিক উন্মোচন করা যেতে পারে। কোন বিষয়ে পূর্ণ বস্তুনিষ্ঠ সত্য উন্মোচনকে এই ধারার তাত্ত্বিক ও গবেষকগণ অসম্ভব মনে করেন, কারণ তাদের মতে চরম বস্তুনিষ্ঠ কোন কিছুর অস্তিত্ব আসলে নেই।
তাত্ত্বিকদের এই ধারাটিকে বলা হচ্ছে Interpretive ধারা। এক্ষেত্রে তত্ত্বের পেছনে গবেষণা থাকার পাশপাশি তাত্ত্বিকের মতাদর্শিক অবস্থান সক্রিয় ভূমিকায় থাকে। তাত্ত্বিকের মতাদর্শ থেকে এসব তত্ত্ব উদ্ভূত এবং মতাদর্শের প্রভাবে সত্য ঢাকা পড়ে যেতে পারে, ইন্টারপ্রেটিভ ধারার এমন সমালোচনা করে থাকেন এম্পিরিক্যাল ধারার সমর্থকেরা।
এক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো, সত্য প্রতিটি ব্যক্তির জন্য আলাদা হতে পারে ধরে নেয়ার ফলে এই ধারার তত্ত্বে যে কোন ধরনের বস্তুনিষ্ঠতাই থাকে না, তা ভেবে নেয়া যাবে না। বরং এই ধারার তাত্ত্বিকরা গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের থেকে প্রাপ্ত তথ্যসমূহকে নানাভাবে যাচাই-বাছাই ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে এক ধরণের বস্তুনিষ্ঠতার দিকে এগিয়ে যেতে চান।
যোগাযোগ অধ্যয়নে Muted Group Theory, Standpoint Theory, Cultural Studies-এর মতো তত্ত্বগুলো এই ধারার অনুসারী।
এই দুই ধারার বাইরে আরেকটি ধারার তত্ত্ব ও তাত্ত্বিক রয়েছে যা স্বতন্ত্র কিছু বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। অনেক তাত্ত্বিক এই ধারাটির আলাদা অস্তিত্ব স্বীকার করতে চান না এবং এই ধারাটিকে ইন্টারপ্রেটিভ ধারার অন্তর্ভুক্ত দাবি করেন। কিন্তু এই ধারার তাত্ত্বিকদের সক্রিয় তৎপরতার জন্য এই ধারাটি আলাদা আলোচনার দাবি রাখে।
আলোচ্য তৃতীয় এই ধারাটিকে বলা হয় Critical ধারা। এই ধারার তাত্ত্বিকরা সমাজে বিদ্যমান জ্ঞান ও ক্ষমতা কাঠামোর সম্পর্ক বিশ্লেষণপূর্বক নিজেদের বোঝাপড়া তথা তত্ত্ব তৈরি করেন। এই ধারায় মনে করা হয় মতাদর্শ ছাড়া বিজ্ঞান থাকতে পারে না। একই সাথে ক্ষমতা কাঠামোর উপরে অবস্থান করা ব্যক্তিরাই সমাজে অবস্থিত জ্ঞানকে আকার দেয় ও টিকিয়ে রাখে, এমনটাই বিশ্বাস করেন এই ধারার তাত্ত্বিকরা। আর তাই এই ধারার তাত্ত্বিকদের কাছে বিদ্যমান ব্যবস্থা বা স্ট্যাটাস-কো ভেঙে সমাজ পরিবর্তন নিয়ে আসা জরুরি একটি বিষয়।
এই ধারার তাত্ত্বিকদের কাছে তাদের তাত্ত্বিক কর্মকাণ্ড এক ধরনের রাজনৈতিক তৎপরতাও বটে। যোগাযোগ অধ্যয়নে Frankfurt School-এর অধিকাংশ তাত্ত্বিকই এই ঘরানার বলে মনে করা হয়।
অর্থাৎ, এম্পিরিক্যাল ধারা যেখানে পৃথিবীকে ব্যাখ্যা করতে চায়, ইন্টারপ্রেটিভ ধারা চায় ব্যক্তিকেন্দ্রিক ব্যাখ্যাকে প্রমাণ করতে; আর ক্রিটিক্যাল ধারা চায় সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন। এক্ষেত্রে প্রথম ধারায় গবেষণার বিষয়ের থেকে তাত্ত্বিকের নিজস্ব ভাবনার কোন সম্পর্ক থাকে না; পরের দুই ধারায় গবেষণা ও গবেষকের ভাবনা থাকে সম্পর্কযুক্ত। আর এরূপ তত্ত্বের মাধ্যমে এম্পিরিক্যাল ধারা যেখানে প্রাপ্ত তথ্যের সাধারণীকরণ করতে চায়, ইন্টারপ্রেটিভ ধারা চায় আলাদা আলাদা কেইসে আলোকপাত করতে; আর ক্রিটিক্যাল ধারার মূল লক্ষ্য থাকে বিদ্যমান একটি নির্দিষ্ট অবস্থার সমালোচনা করা।
Gibson Burrell ও Gareth Morgan উপরোক্ত ভাবনার আলোকে সমাজের প্রকৃতিকে Regulation—Radical Change (Empirical—Interpretive/Critical) মেরুতে ভাগ করেন।
পৃথিবীকে দেখার প্রশ্নে এরূপ ভিন্ন ভিন্ন ধারাসমূহ বিদ্যমান থাকলেও এটি মনে করা একদমই ঠিক হবে না যে, কোন একটি তত্ত্ব হয় বিশুদ্ধ এম্পিরিক্যালই হবে, অথবা বিশুদ্ধ ইন্টারপ্রেটিভই হবে; বরং বহু তত্ত্ব আছে যা এই দুই ধারার মাঝামাঝি কোথাও অবস্থান করে।
বস্তুনিষ্ঠ সত্য সম্পর্কে নিজেদের ধারণা স্পষ্ট হওয়ার পরপরই তাত্ত্বিকদের সামনে উপস্থিত হয় দ্বিতীয় প্রশ্নটি। আর তা হলো, আমি পৃথিবী সম্পর্কে কী কী প্রশ্ন উত্থাপন করি?
(চলবে)
সহজবোধ্য আলাপ। চলুক। পড়ছি।
ধন্যবাদ পড়ার জন্য, প্রতিক্রিয়ার জন্য…
Pingback: তাত্ত্বিকের দর্শন, কিংবা মেটা থিওরি সংক্রান্ত (২) – শিবলী নোমান
Pingback: তাত্ত্বিকের দর্শন, কিংবা মেটা থিওরি সংক্রান্ত (৩) – শিবলী নোমান