শিবলী নোমান
বাংলাদেশের কোন নাগরিকের কাছে যদি কখনো জানতে চাওয়া হয় তার বা তাদের জাতীয় জীবনে সবচেয়ে অন্ধকার মূহুর্ত কোনটি, তাহলে নিশ্চিতভাবেই কোন রকম দ্বিতীয় চিন্তা ছাড়াই যে কোন বাংলাদেশি বলবে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ কালোরাতের কথা। একটি দেশের আপামর নিরীহ ও বেসামরিক সাধারণ জনতার উপর কোন পূর্বঘোষণা ব্যতিরেকে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামক সামরিক পদক্ষেপ নেয়ার এমন উদাহরণ পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল না হলেও, যে নৃশংসতার শিকার বর্তমান বাংলাদেশের বাঙালি জনগোষ্ঠী সে সময় হয়েছিল, তার উদাহরণ পৃথিবীর ইতিহাসে খুব বেশি নেই।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে আসলে কত জন বা কী পরিমাণ বাঙালি প্রাণ হারিয়েছিল সেই নিশ্চিত সংখ্যা কখনোই জানা যাবে না। আসলে পৃথিবীর কোন গণহত্যার ক্ষেত্রেই হত্যার সঠিক সংখ্যা জানা সম্ভব হয় না। শুধু হত্যাই নয় বরং ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজের মাধ্যমে যে কোন জাতিকে পরিকল্পিতভাবে নির্মূল করার বা জাতিগত নিধন অর্থাৎ ‘এথনিক ক্লিনিজিং’-এর উদ্দেশ্যে চালানো কার্যকলাপকে যখন একত্রে ‘গণহত্যা’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, তখন যে কোন গণহত্যায় প্রকৃত নিপীড়িতের সংখ্যা জানা হয়ে ওঠে অসম্ভব একটি বিষয়। সেক্ষেত্রে একটি সংখ্যাকে প্রতীকি বা ‘সিম্বলিক ফিগার’ হিসেবে ধরে নেয়া হয়। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিদের উপর চালানো গণহত্যায় এই ‘সিম্বলিক ফিগার’টি হলো ৩০ লাখ হত্যা এবং অন্তত দুই লাখ ৬৯ হাজার মা-বোনের সম্ভ্রম বিসর্জন। এর সাথে যুক্ত হয় সংখ্যায় প্রকাশ করা সম্ভব নয় এমন পরিমাণের অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ।
ভিন্ন ডিসকোর্স হলেও জাতি হিসেবে আমাদের জন্য এটি দুঃখজনক ও লজ্জাষ্কর যে, এখনো কিছু মানুষ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে নিহত ও শহীদের সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে। সেক্ষেত্রে ‘জেনোসাইড ডিনায়াল ল’ প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। কিন্তু তার আগে প্রয়োজন গণহত্যার স্বীকৃতি।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম যুদ্ধে নিহত ও শহীদ বাঙালির সংখ্যা প্রকাশ করেছে। ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এই সংখ্যা তিন লাখ থেকে ৩০ লাখ হিসেবে বর্ণিত হয়েছে সময় ও গণমাধ্যমভেদে। শেষ পর্যন্ত আমরা গণহত্যার প্রতীকী পরিমাণ হিসেবে অন্তত ৩০ লাখ শহীদকে গ্রহণ করেছি যুদ্ধ শেষ হওয়ার অব্যবহতি পরই। কিন্তু দুঃখের বিষয়, স্বাধীনতা ও বিজয় অর্জনের ৪৭ বছর পূর্ণ হয়ে গেলেও বাঙালিদের উপর চালানো নির্মম ও নৃশংস গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এখনো পাওয়া যায় নি।
আমরা যদি বিংশ শতাব্দীর বড় গণহত্যাগুলোর আন্তর্জাতিক তালিকাগুলোর দিকে তাকাই তাহলে কোন তালিকাতেই ১৯৭১ সালে বাঙালিদের উপর চালানো পাকিস্তানি শাসক ও সেনাবাহিনীর গণহত্যার বিষয়টির উলেখ দেখা যায় না। উইকিপিডিয়ার বর্ণনায় সম্প্রতি ইরাকে ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের উপর চালানো জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটসের গণহত্যার উলেখ থাকলেও, সেখানেও নেই ১৯৭১ সালের গণহত্যার বিষয়ে কোন কথা। অথচ জাতিসংঘের এক পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে যে, ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর মাসের প্রতিদিন গড়ে ছয় হাজার থেকে ১২ হাজার বাঙালি গণহত্যার শিকার হয়েছে। ২য় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদিদের উপর পরিচালিত হলোকাস্ট নামে পরিচিত গণহত্যার পর আর কোন গণহত্যায় এত মানুষ নিহত হয় নি। হলোকাস্টে নিহত ৬০ লাখ ইহুদি মৃত্যুবরণ করেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ছয় বছর সময়ের ভেতর। আর মাত্র নয় মাসে মৃত্যুবরণ করেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার শিকার মানুষেরা। বিংশ শতাব্দীতে সময়ের হিসেবে এত কম সময়ে এত বেশি মানুষকে হত্যার শিকার হতে হয় নি অন্য কোন গণহত্যার ক্ষেত্রে। তারপরও এখন পর্যন্ত সেই গণহত্যার স্বীকৃতি বাংলাদেশ পায় নি।
জা পল সার্ত্রে তাঁর ‘গণহত্যা’ শীর্ষক বক্তব্যে বলেছিলেন, যখন সংঘর্ষ বা যুদ্ধে লিপ্ত দু’টি সম্প্রদায় বা গোষ্ঠী বা জাতির ভেতর একটি জাতি সর্বাত্মক যুদ্ধে লিপ্ত হয় ও অপর জাতি শুধুমাত্র সামরিক যুদ্ধে লিপ্ত থাকে, তখনই সর্বাত্মক যুদ্ধে লিপ্ত থাকা দেশটির সাধারণ মানুষের উপর গণহত্যা পরিচালিত হয় বা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রেক্ষিতে এ কথা বলা হলেও সার্ত্রের এই বক্তব্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রেও সমানভাবে সত্য। কারন, ভুলে গেলে চলবে না যে, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাংলাদেশের জন্য একটি জনযুদ্ধ, যেখানে বাংলাদেশের মানুষ তাদের নিজস্ব অবস্থান থেকে সর্বাত্মক যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছে, অস্ত্র হাতে না নিয়েও।
গেলো কয়েক বছর ধরে ২৫শে মার্চকে আমরা পালন করছি জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে। কিন্তু এই পালন করার ভেতরই সকল আয়োজন সীমাবদ্ধ না রেখে আমাদেরকে বাংলাদেশের মানুষের উপর চালানো গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় করতে হবে। পাকিস্তান এখনো প্রচার করে যে, ১৯৭১ সালের যুদ্ধে মাত্র ২৭ হাজার বাঙালি হত্যার শিকার হয়েছে। তাদের এই অপপ্রচারের বিরুদ্ধে আমাদের সোচ্চার হতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না যে, গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির মাধ্যমেই বিশ্বসভায় বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সঠিক স্বীকৃতি মিলতে পারে। এর মাধ্যমেই বিশ্ববাসী জানতে পারবে কী মহান আত্মত্যাগের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষ অর্জন করেছে কাঙ্খিত স্বাধীনতা। তাই স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে আমাদের সবার দাবি হোক একটাই, গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চাই।