শিবলী নোমান

ওমরান দাকনিশ কিংবা কেট বোল্ডুয়ান প্রসঙ্গে!

শিবলী নোমান

গতবছর সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে এক আলোকচিত্র স্তব্ধ করে দিয়েছিলো আমাদের। ভূমধ্যসাগরের তীরে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা তিন বছরের শিশু আলান কুর্দির নিথর দেহ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছিলো বিশ্ব মানবতার বিপন্নতা। তুর্কি আলোকচিত্রী নিলুফার দেমিরের তোলা সেই ছবিটি ২০১৫ সালের অন্যতম আলোকচিত্র হয়ে আছে এখনো। আলান কুর্দির নিথর দেহ স্মৃতিপট থেকে মুছে যাওয়ার আগেই সামনে এসেছে ওমরান দাকনিশ। আলান কুর্দির স্বদেশী ভাই পাঁচ বছরের এই ওমরান দাকনিশ। আমাদের কিংবা ওমরানের সৌভাগ্য যে এখনো তিনি বেঁচে আছেন। বিশ্ব মানবতার বিপন্নতা প্রমাণ করার জন্যে তাকে মারা যেতে হয় নি। শুধু একাকী অবস্থায় তার ধুলোমাখা, রক্তরঞ্জিত শরীরটি একটি অ্যাম্বুলেন্সে দেখেই আমাদের মনে পড়েছে যে বিশ্ব মানবতা বিপন্ন। সাহস করে যদি ওমরানের চোখের দিকে তাকাতে পারেন তাহলে দেখতে পাবেন যে তিনি কিছু দেখাতে চান নি; তিনি বাবা-মা ভাই-বোনের সাথে এই বয়সের শিশুরা যেমন সময় কাটায় শুধু তাই চেয়েছিলেন।

আলান কুর্দি কিংবা ওমরান দাকনিশের ছবি দেখে আমাদের মানবিকতাবোধ তীব্র হয় কিংবা মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠে। কিন্তু মূহুর্তেই সেই মানবিকতাবোধ বিসর্জন দিয়ে নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে যেতে আমার বা আপনার কারোরই সময় লাগে না। এজন্যেই হয়ত শুধু আমার-আপনার মানবিকতাবোধকে সমুন্নত রাখতেই কিছুদিন পরপর আলান কুর্দি কিংবা ওমরান দাকনিশদের দেখা পাওয়া যায়। সিএনএন-এর সংবাদ উপস্থাপক কেট বোল্ডুয়ান সিরিয়া ইস্যুতে সংবাদ উপস্থাপনার সময় ওমরান দাকনিশের ফুটেজ আসলে কেঁদে ফেলেন। কেট বোল্ডুয়ানের মানবিকতাবোধ আছে বলতে হবে। তিনি যন্ত্রের মত সংবাদটি পড়েই মেক-আপ তুলতে ব্যস্ত হয়ে যান নি। কিন্তু এই মানবিকতাবোধ দিয়ে আমাদের কী হবে? কিছুই হবে না, যেমন হবে না আমার-আপনার মানবিকতাবোধ দিয়ে।

২০০১ ও ২০০৩ সালের আফগানিস্তান ও ইরাকে আগ্রাসন চালানোর মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই দুই দেশে তাদের স্বার্থসিদ্ধি করতে পেরেছে। আর এই স্বার্থসিদ্ধির প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী করতে ও নতুন আগ্রাসনের জন্যে তারা খেয়ে ফেলেছে আরব বসন্তের ফলাফল। ২০১১ সালে শুরু হওয়া আরব বসন্তের আশার আলোর সাথে আজকের সময়ের তুলনা করতে গেলে হতাশার অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। মিশরে মুসলিম ব্রাদারহুড বিপ্লবের ফলাফল ছিনতাই করেছে, এরপর ক্ষমতায় এসেছে সামরিক সরকার; লিবিয়া আজ জাতিবিদ্বেষে জর্জরিত; সিরিয়া আজ আন্তর্জাতিক প্রক্সি যুদ্ধের প্রধান ক্ষেত্র। অথচ দীর্ঘ স্বৈরশাসনের অবসানের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে একটু ভালোভাবে বাঁচতে চেয়েছিল এসব দেশের মানুষ। একটু খেয়াল করলেই দেখা যায় যে, যেসব দেশে মার্কিন স্বার্থে সরকার পরিবর্তন প্রয়োজন ছিল সেসব দেশে এই আন্দোলনের প্রাথমিক লক্ষ্যপূরণ অর্থাৎ শাসককে উৎখাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার বন্ধুমহল শক্তি প্রয়োগও করেছে মানবিকতার অজুহাতে। লিবিয়ায় নো ফ্লাই জোন প্রতিষ্ঠা ও এয়ার স্ট্রাইক এবং বাশার আল আসাদকে উৎখাতের নামে সিরিয়াকে আন্তর্জাতিক যুদ্ধের ময়দানে পরিণত করা এসবেরই দৃষ্টান্ত। এর সাথে যুক্ত হয়েছে আইএস নামক বিভীষিকা; যাদের ভিত্তিমূল ঐ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলেই প্রতীয়মান হয়।

এবার যদি আরব বস্বন্তের ফলে গড়ে ওঠা আন্দোলন যেসব দেশে সফল হয় নি তেমন দেশের দিকে তাকাই তাহলে সৌদি আরব ও বাহরাইনের কথা বলা যায়। খেয়াল করে দেখতে পারেন এই রাষ্ট্রদ্বয়ের শাসকগণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ট মিত্র। শুধু তাই নয়, আরব বসন্তে বাহরাইনে আন্দোলনকারীরা তথ্যপ্রযুক্তি কিভাবে ব্যবহার করে আন্দোলন গড়ে তুলেছে তার উপর প্রতিবেদন তৈরি করতে চার সদস্যের দল পাঠিয়েছিলো সিএনএন। এ বিষয়ে একটি প্রামাণ্য চিত্র তৈরি করেন অনুসন্ধানী সাংবাদিক আম্বার লিয়ন ও তার দল। কিন্তু সিএনএন আন্তর্জাতিকভাবে তাদের এই প্রামাণ্য চিত্রটি একবারও প্রচার করে নি কারণ বাহরাইনের শাসকগোষ্ঠী সিএনএন-এর দাতা সদস্য। তারা সিএনএন-কে অর্থ দিয়ে থাকে নিজেদের সম্পর্কে ‘পজিটিভ নিউজ’ করার জন্যে। তাই আরব বসন্তের আন্দোলনে বাহরাইনে সরকার কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘনের সংবাদ বিশ্ববাসী জানতে পারে না।

সিএনএন-এর এমন কর্মকান্ডের উদাহরন আরো অনেক দেয়া যাবে। এর চেয়ে ফিরে আসি সংবাদ উপস্থাপক কেট বোল্ডুয়ানের কান্না প্রসঙ্গে। নিঃসন্দেহেই কেট বোল্ডুয়ানের কেঁদে ফেলা মানবিকতাকেই নির্দেশ করে। কিন্তু এই কান্নার জন্যে যদি তার চাকরি চলে যায় কিংবা তার পদোন্নতি আটকে যায় আমি একদমই অবাক হবো না; যদি না এই কান্নাও একটি সংবাদ নির্মাণের প্রয়াস হয়ে থাকে। ২০১০ সালে ২০ বছর সিএনএন-এ চাকরি করা জনমসূত্রে লেবানিজ অক্টাভিয়া নাসরের চাকরি চলে গিয়েছিলো সামাজিক মাধ্যমে হিজবুল্লাহ নেতার মৃত্যুতে দুঃখ প্রকাশ ও তার প্রতি সম্মানের কথা প্রকাশ করায়। তাই কেট বোল্ডুয়ানের কান্না আমাকে একটুও আশা দেখায় না। কারণ কেট বোল্ডুয়ান খুব ‘র’ ভাষায় সিএনএন-এর একজন শ্রমিক। তাকে দিয়ে সিএনএন যতদিন তাদের মত সংবাদ উৎপাদন করতে পারবে বা উপস্থাপন করতে পারবে ততদিন কেট সিএনএন-এ থাকতে পারবেন। কিন্তু একটু এদিক-সেদিক হলেই হয়ত তাকে চাকরি হারাতে হবে। তাই এভাবে কান্না নয় বরং বিশ্বব্যাপী পক্ষপাতমূলক সংবাদের বিরুদ্ধে সংবাদকর্মীদের অবস্থান গ্রহণই হতে পারে মানবিকতার প্রকৃত পরিচয়।

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।