শিবলী নোমান
(এই লেখাটি ২০১৭ সালে প্রকাশিত গণমাধ্যম বিষয়ক পত্রিকা \’মাধ্যম\’-এর (রাসেল রাব্বী সম্পাদিত) প্রথম সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে এই লেখার ধারাবাহিকতায় দেশীয় টিভি চ্যানেলের কোয়াসি ক্রিটিক্যাল তত্ত্ব শিরোনামে আরেকটি লেখা এই সাইটে প্রকাশিত হয়েছে যাকে এই লেখার দ্বিতীয় অংশ বলা যেতে পারে। প্রথম লেখাটি যারা খোঁজ করেন তাদের জন্য লেখাটি এই সাইটে আবার দিয়ে দেয়া হলো।)
প্রচারণার যুগে গণমাধ্যম শুধুই প্রচার কিংবা প্রোপাগান্ডার হাতিয়ার। অনেকক্ষেত্রে তা হাতিয়ার থেকে সহায়ক টুলে পরিণত হয়। অর্থাৎ প্রচারণার অনেক উপায়ের মধ্য থেকে গণমাধ্যম একটি প্রকরণ হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু মজার বিষয় হল আমরা যারা সাধারণ মানুষ গণমাধ্যম থেকে তথ্য কিংবা সংবাদ গ্রহণ করে নিজেদের তথ্যসমৃদ্ধ কিংবা আপডেটেড দাবি করি কিংবা মনের ভিতর নিজেদের আপডেটেড ভাবতে থাকি এবং ভেবে ভেবে তুষ্ট হই তা একদিকে যেমন গণমাধ্যমের ব্যবহার ও তুষ্টি তত্ত্বকে সমর্থন করে তেমনি এটিও ভুলে যাওয়া যায় না যে এই তুষ্টিবোধ আসলে এক ধরণের ঘোর লাগা অবস্থা তথা অবসেশন। আমরা প্রকৃতপক্ষেই ভুলে যাই যে গণমাধ্যমগুলো আমাদের তুষ্ট করার পাশাপাশি ভয়ানক দক্ষতায় যা করছে তা হল সম্মতি উৎপাদন। সমাজের সুপার স্ট্রাকচার অংশটির জন্যে প্রয়োজনীয় এবং আরো গুরুত্বপূর্ণভাবে তাদের মুনাফাবৃদ্ধির চলমান প্রক্রিয়া চলমান রাখার জন্যে গণমাধ্যমগুলো সচেতনভাবে সমাজের বেইস তথা ভিত্তি কিংবা যার ভিতর সাধারণ শ্রমজীবী (মূলত মুনাফাখোর শ্রেণী ছাড়া সবাই) শ্রেণীর বসবাস তাকে মেনিপুলেট করে বিরতিহীনভাবে। অন্যদিকে টেলিভিশন চ্যানেলের প্রকৃত উদ্দেশ্য যাই হোক, গণমাধ্যম হিসেবে এর জনপ্রিয়তা বাড়তে দেখা গিয়েছে বাংলাদেশে। ২০১১ সালে এসি নিলসেনের মিডিয়া সার্ভে রিপোর্টে দেখা যায় শহর এলাকার শতকরা ৯১ ভাগ মানুষ টেলিভিশনের আওতায় এসেছেন, যা আগে ছিল ৬৭ ভাগ। অন্যদিকে গ্রামীণ এলাকায় এই পরিবর্তন আরো দ্রুত, ২৪ ভাগ থেকে এক লাফে ৬৭ ভাগ।
এই লেখার মূল আলোকপাত কিংবা ফোকাস থাকবে বাংলাদেশের সম্প্রতি গড়ে ওঠা টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর উপর। বিটিভিকে ধরলে এটি প্রায় ৫০ বছরের পুরনো মাধ্যম কিন্তু এদেশে টেলিভিশনের বর্তমান বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা শুরু হয় সাধারণত বেসরকারি চ্যানেলগুলো থেকে। আবার গণমাধ্যমের ইতিহাস তথা সংবাদপত্রের ইতিহাস থেকে ধরলে গণমাধ্যম হিসেবে বাংলাদেশে টেলিভিশন চ্যানেলের বিকাশ আসলে সদ্য ঘটনাই। এই লেখায় আমরা দেখার চেষ্টা করবো বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো আসলে কিভাবে গড়ে উঠেছে এবং কিভাবে কাজ করছে। একই সাথে চেষ্টা থাকবে বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর মান নির্ধারণের (নরম্যাটিভ থিওরির আলোকে)।
বাংলাদেশে টেলিভিশন চ্যানেলের ইতিহাস:
১৯৫৯ সালে ভারতের অল ইন্ডিয়া রেডিওর নতুন কার্যক্রম হিসেবে ভারতে টেলিভিশন সম্প্রচার শুরু হয়। সেটি ছিল ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম টেলিভিশন সম্প্রচার। এরপর পশ্চিম পাকিস্তানে টেলিভিশন সম্প্রচার শুরু হলেও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে টেলিভিশন সম্প্রচার শুরু হয় ১৯৬৪ সালে। ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর পাইলট প্রজেক্টের অধীনে ঢাকায় ইস্ট-পাকিস্তান টেলিভিশনের সম্প্রচার উদ্বোধন করেন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান। ১৯৭১ সালের অগ্নিঝরা সময়ে পাকিস্তান দিবসে টেলিভিশনের পর্দায় একবারও পাকিস্তানের পতাকা প্রদর্শন না করে অনন্য প্রতিবাদ করেছিলেন এই টেলিভিশনের কর্মীরা। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হলে ইস্ট-পাকিস্তান টেলিভিশন পরিণত হয় বাংলাদেশ টেলিভিশন তথা বিটিভিতে। সরকারি চ্যানেল হিসেবে এটি কাজ করছে এবং ২০০৪ ও ২০১১ সালে বিটিভি ওয়ার্ল্ড ও সংসদ বাংলাদেশ টেলিভিশনের যাত্রা শুরু হয় সরকারি মালিকানায়।
অন্যদিকে ১৯৯৭ সালে দেশের প্রথম বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল হিসেবে যাত্রা শুরু করে এটিএন বাংলা। ১৯৯৮ সালে ডিজিটাল সম্প্রচার ব্যবস্থা নিয়ে যাত্রা শুরু করে চ্যানেল আই। এগুলো স্যাটেলাইট চ্যানেল হিসেবে কাজ করে। ২০০০ সালে টেরিস্ট্রিয়াল সম্প্রচার শুরু করে একুশে টেলিভিশন যা বাংলাদেশের টেলিভিশিন শিল্পে বিপ্লব নিয়ে আসে। নাটক, অনুষ্ঠান ও সংবাদে আসে নতুনত্ব। একইসাথে টেরিস্ট্রিয়াল সম্প্রচারের ফলে চ্যানেলটি অর্জন করে ব্যাপক অডিয়েন্স রিচ। ২০০২ সালের ন্যাশনাল মিডিয়া সার্ভেতে বিটিভি ও একুশে টেলিভিশনের জনপ্রিয়তা ‘প্রায় সমান’ দেখা যায়। ১৯৯৭ সাল থেকে বাংলাদেশে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের যে যাত্রা শুরু হয়েছে তা এখনো চলছে। এটি মূলত নতুন নতুন চ্যানেল প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে। দেশে বর্তমানে ২৪ থেকে ৩০টি চ্যানেলে সম্প্রচারিত হচ্ছে বলে তথ্য পাওয়া যায়। সম্প্রচার শুরুর অপেক্ষায় আছে আরো গোটা বিশেক চ্যানেল। আগেই বলেছি বাংলাদেশে টেলিভিশন চ্যানেলের যাত্রা অব্যাহত আছে। এও বলেছি এই যাত্রা হল নতুন নতুন চ্যানেলের যাত্রা। মানোন্নয়ন নিয়ে ভাবনা কিংবা তা নিয়ে কোন কাজ আদৌ হচ্ছে কিনা তা নিয়ে কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
রাজনৈতিক দলীয়করণ:
আগেই বলা হয়েছে বিটিভি দেশের সবচেয়ে প্রাচীন টেলিভিশন চ্যানেল। ২০১১ সালে এসি নিলসেন যে মিডিয়া সার্ভে পরিচালনা করে তাতে বিটিভির অডিয়েন্স রিচ দেখা যায় শতকরা ৯৭ ভাগ। টেরিস্ট্রিয়াল সম্প্রচারের ফলে দেশের প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতেও বিটিভি পৌঁছে যেতে পেরেছে অনেক আগেই। ১৯৮০ ও ’৯০-এর দশকে বিভিন্ন নাটক ও ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান প্রচারের মাধ্যমে ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা পায় চ্যানেলটি। কিন্তু একুশে টেলিভিশনের মাধ্যমে দেশের মানুষ যখন সংবাদের আসল স্বাদ পায় তখন থেকে বিটিভির সংবাদের জনপ্রিয়তা কমতে থাকে এবং এখন তা তলানিতে পৌঁছেছে। বিটিভির সংবাদে দেশের বিরোধী দল সম্পর্কিত কিংবা সরকারের পলিসিবিরোধী কোন সংবাদ কখনো দেখেছে তা কেউ বলতে পারবে না। গণমাধ্যম নিয়ে অধ্যয়ন শুরুর আগে থেকেই বিটিভির সংবাদকে আমার তরল পদার্থ মনে হত। কারণ এর সংবাদ তরল পদার্থের বৈশিষ্ট্যের মত যখন যে পাত্রে থাকে তখন তার আকার ধারণ করেছে। কিন্তু মজার বিষয় হল বিটিভির এই চর্চা বিটিভির প্রথম দিন থেকেই শুরু। অর্থাৎ ১৯৬৪ থেকেই। ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর যাত্রা শুরুর দিনে বিটিভি যে সংবাদ প্রচার করে তাতে ঐদিন ঢাকায় প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী মিস ফাতেমা জিন্নাহর কর্মসূচী সম্পর্কে কোন সংবাদই ছিল না।অর্থাৎ সংবাদ নিয়ে জনগণের সাথে বিটিভির বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস অনেক পুরনো। শুধু সংবাদ নিয়েই নয় বরং সরকারের ভাবমূর্তি একটু হলেও ক্ষুন্ন হতে পারে এমন যে কোন প্রচার থেকে বিটিভি সব সময় দূরে থেকেছে। গুলশানে জঙ্গি হামলার পর পুরো রাত যখন সেখান থেকে বিভিন্ন সংবাদের উপর আমরা চোখ রেখেছি তখন বিটিভি গুলশানে হামলার বিষয়ে কোন সংবাদ করে নি। এ বিষয়ে তাদের ক্রলেও কোন সংবাদ ছিল না। উপরন্তু তারা জাতির এই ক্রান্তিকালে সঙ্গীতানুষ্ঠান প্রচার করে জনগনকে শান্ত রাখার চেষ্টা করেছে! মূলত বিটিভি দূরবর্তী অতীত থেকে দৃশ্যমান বর্তমান পর্যন্ত নিঃস্বার্থভাবে সরকার ও সরকারি দলের লেজুড়বৃত্তি করেছে নিঃস্বার্থভাবে। নিকট ভবিষ্যতে তাদের এই চরিত্রের কোন পরিবর্তনের আভাস বা ইঙ্গিত কোনটাই দেখা যাবে বলে মনে হয় না।
অন্যদিকে বেসরকারি টেলিভিশনগুলোর উপর রাজনৈতিক দলীয়করণ ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ছায়া কিংবা অপছায়া আমরা দেখেছি বারংবার। ২০০১ সালে চার দলীয় জোট ক্ষমতায় এসেই বন্ধ করে দিয়েছে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা একুশে টেলিভিশন। নানা আইনি জটিলতা পার হয়ে ২০০৭ সালে আবার একুশে টেলিভিশন সম্প্রচারিত হয় স্যাটেলাইট চ্যানেল হিসেবে। বেসরকারি চ্যানেলের লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে দলীয় পক্ষপাতিত্ব দেখা যায় নগ্নভাবে। ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের ৮ম সংসদের সময় চ্যানেল চালু করেন মোসাদ্দেক আলী ফালু, মীর কাশেম আলী, এম.এন.এইচ বুলু, এম.এ.এইচ সেলিম, সাঈদ ইস্কান্দার প্রমুখ। সবাই ছিলেন চার দলীয় জোট সরকারের অংশীজন। একই সময় আওয়ামী লীগ তাদের যে কোন সভা-সমাবেশে এনটিভির সাংবাদিক ও ক্যামেরা-বুমের প্রবেশাধিকার বাতিল করে। ধার করা ফুটেজ কিংবা সভাস্থলের বাইরের ফুটেজ দেখিয়ে আওয়ামী লীগ বিট কাভার করতে বাধ্য হয় এনটিভি।
২০০৮ সালে ৯ম সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। অনেকে ধারণা করেছিলেন নতুন সরকার এসেই আগের সরকারের লাইসেন্স দেয়া সকল চ্যানেল বন্ধ করবেন। কিন্তু তা না করে এই সরকার আগের চ্যানেলগুলোর অনেকগুলোর মালিকানা পরিবর্তনে বাধ্য করেন। একই সাথে সাবের হোসেন চৌধুরী, কামাল আহমেদ মজুমদার, মোঃ নাসিরউদ্দিন, অ্যাডভোকেট কামরুল আহমেদ, সাংবাদিক মোজাম্মেল বাবু, সৈয়দ শাফায়াতুল ইসলাম, এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, একে আজাদ প্রমুখ সরকারের অংশীজন নতুন চ্যানেলের লাইসেন্স পান এবং চ্যানেল চালু করেন।
একই সাথে ২০০০ সালের পর থেকে বাংলাদেশের ব্যবসায়িক গ্রুপগুলো তাদের স্বার্থরক্ষায় ও নিজেদের প্রতিযোগিতা ধরে রাখতে নিজেদের গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠা করে। এসব গ্রুপের ভিতর ট্রান্সকম, ইমপ্রেস, যমুনা, বসুন্ধরা, বেক্সিমকো, মাল্টিমিডিয়া প্রোডাকশন, দিগন্ত, স্কয়ার, মেঘনা, গাজী, এসএ গ্রুপ নিজেদের গণমাধ্যম তথা সংবাদপত্র, এফএম রেডিও, টেলিভিশন চ্যানেল ও অনলাইন নিউজ পোর্টাল চালু করে। একটু ভালো করে লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারা যায় যে সরকারের সাথে যেসব ব্যবসায়িক গ্রুপগুলোর সম্পর্ক ভালো তারাই সুযোগ মত নিজেদের গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠা করেছে এবং করছে। সব প্রস্তুতি থাকার পরেও যমুনা টেলিভিশনের বিলম্বে সম্প্রচার কার্যক্রম শুরুর পিছনেও এসব বিষয়ই কাজ করেছে। এর ফলে তারা কিভাবে তাদের স্বার্থোদ্ধার করছে তা নিয়ে পরের অংশগুলোতে আলোচনা করা হবে।
চ্যানেলের প্রকরণ: আছে কি?
১৯৩২ সালে ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং করপোরেশন বা বিবিসির টেলিভিশন সম্প্রচারের মাধ্যমে পৃথিবীতে যে টেলিভিশন সম্প্রচারের রেওয়াজ ছড়িয়ে পড়ে এবং ছড়িয়ে পড়তে পড়তে তা এখন যে পর্যায়ে আছে তার বিভিন্ন চড়াই-উতরাই লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, বিবিসি নামক এই চ্যানেলটি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সূচনাকারী তথা পাইওনিয়ারের ভূমিকা নিয়েছে। সেই কারণে বৈশ্বিক (পশ্চিমা!) গণমাধ্যম হিসেবে বিবিসির ভূমিকা ভালো হোক বা খারাপ সেই বিতর্কের ঊর্দ্ধে থেকেই বিবিসি কিংবা বিবিসির ন্যায় চ্যানেলগুলোকে অনুসরণীয় হিসেবে প্রচার করার একটি প্রক্রিয়া আমাদের দেশেও চলমান আছে। ২০১৪ সালে জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা প্রকাশিত হলে আমাদের তথ্যমন্ত্রী একটি টক-শোতে বলেছিলেন বিবিসির মত চ্যানেল যেভাবে চলছে তা অনুসরণ করেই নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। শুধু এক্ষেত্রেই নয় বরং বিবিসি কিংবা সমধর্মী চ্যানেলগুলোর আদলে ইংরেজি সংবাদ, মূলত ইংরেজি সংবাদের প্রকাশভঙ্গি অনুসরণের চর্চাও আমাদের বিভিন্ন চ্যানেলের আছে। এখন চ্যানেল হিসেবে বিবিসির ভালো কোন দিক আমাদের কোন চ্যানেল অনুসরণ করতেই পারে, কিন্তু সমস্যায় পড়তে হয় তখন, যখন আমাদের দেশের চ্যানেলগুলো আসলে কেমন চ্যানেল তা সহজে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। এখন প্রশ্ন আসতে পারে চোখের সামনে আমরা যখন নিউজ চ্যানেল ও মিক্সড চ্যানেলের মত প্রকরণ দেখছি তাহলে সংজ্ঞায়নে সমস্যা কোথায়? সমস্যা হল আমাদের দেশে বিনোদন অনুষ্ঠান আর তথ্যভিত্তিক অনুষ্ঠান একসাথে মিলিয়ে আমরা চ্যানেলগুলোতে একটা জগাখিচুড়ি তৈরি করেছি। মিক্সড চ্যানেলের অস্তিত্ব তাত্ত্বিকতার বাইরে ব্যবহারিক জায়গাতেও খুঁজে পাওয়া কঠিন। আমাদের পাশের দেশ ভারতের চ্যানেলগুলো দেখলে বিষয়টি বুঝতে পারা যায়।
অর্থাৎ সব জায়গায় যেখানে থিম অনুযায়ী চ্যানেল হচ্ছে, সেখানে আমরা থিমেটিকভাবে চ্যানেল না করে মিক্সড চ্যানেল তৈরি করছি একের পর এক। এক্ষেত্রে নিউজ চ্যানেলগুলো আলাদা স্থান করে নিয়েছে ঠিক কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে মিক্সড চ্যানেলের সংখ্যা বাড়ছেই। চ্যানেল নাইনের প্রথমে শুধুমাত্র স্পোর্টস চ্যানেল হিসেবে যাত্রা শুরুর কথা থাকলেও আদতে সেটিও এখন মিক্সড চ্যানেলে রূপান্তরিত হয়েছে। মূলত এটিএন বাংলা এবং চ্যানেল আই বিনোদন চ্যানেলে হিসেবেই কাজ শুরু করেছিল। একুশে টেলিভিশনের সংবাদ বিপ্লবের ফলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতেই হয়ত চ্যানেল দু’টি অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় থেকে সংবাদ প্রচার শুরু করে। এরপর থেকেই আমাদের চ্যানেলগুলো মিক্সড চ্যানেল হয়ে যায়, হতে চায়। আমি বলছি না কোথাও মিক্সড চ্যানেল নেই বলে থাকতে পারবে না। কিন্তু থিমেটিক চ্যানেলগুলোকে আমরা প্রকৃত মানসম্মত করতে পেরেছি কিনা সেই প্রশ্নের উপর দাঁড়িয়ে থিমেটিক চ্যানেল ব্যবস্থা থেকে বের হয়ে মিক্সড চ্যানেলে যাওয়াটা সেই মানসম্মত হওয়ার প্রশ্নটি সঠিকভাবে উতড়ে যেতে পারবে কিনা সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।
অনুষ্ঠানের তথ্যনির্ভরতা:
লেখার আগের অংশে আমাদের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো চ্যানেল হিসেবে কোন প্রকারের তা বোঝার চেষ্টা করছিলাম। সেটি বুঝতে পারি আর না পারি এটুকু খুব সহজেই বুঝতে পারা যায় যে সংবাদ বা তথ্যনির্ভর অনুষ্ঠানগুলোর দিকে আমাদের চ্যানেলগুলো বেশ আগ্রহের সাথে ঝুঁকে পড়েছে। সেটি সংবাদ নিয়ন্ত্রনের প্রয়াস কিনা সেই আলাপ আপাতত দূরে রেখে আমাদের মিক্সড চ্যানেলগুলো আসলে কতটুকু মিক্সড চ্যানেল নাকি এর ভিতরেও কিছু কিন্তু রয়ে গিয়েছে তা দেখার চেষ্টা করি।
আসলে একটি মিক্সড চ্যানেলে কী কী প্রচার করবে তা ‘চ্যানেল টু চ্যানেল’ পরিবর্তিত হতে পারে। কিন্তু তারপরও এ বিষয়ে একটি বৈশ্বিক ধারণার আশ্রয় নেয়াই যায়। ইউনেস্কো তাদের ১৯৭১ সালের স্ট্যাটিসটিক্যাল ইয়ারবুকে চার ধরণের অনুষ্ঠানের কথা বলে। এগুলো হল বিনোদন (Entretainment) অনুষ্ঠান, তথ্যভিত্তিক (Informative) অনুষ্ঠান, শিক্ষামূলক (Educational) অনুষ্ঠান এবং প্ররোচনামূলক (Persuasive) অনুষ্ঠান (বিজ্ঞাপন, ধর্ম বিষয়ক)। আমরা খেয়াল করলে দেখবো যে আমাদের দেশের চ্যানেলগুলো যত অনুষ্ঠানই সম্প্রচার করুক না কেন, কোন না কোনভাবে অনুষ্ঠানগুলোকে এই চার প্রকরণের কোন একটিতে তাকে ফেলে দেয়া সম্ভব। আসলে আমাদের মিক্সড চ্যানেলের অনুষ্ঠানগুলো এই চার ধরণের অনুষ্ঠানের সমন্বয়েই চলছে। কিন্তু প্রশ্ন হল এই সমন্বয় সুষম কিনা।
মিক্সড চ্যানেলের অনুষ্ঠান তার মূল চার প্রকারের কতটুকু সমন্বয় তা উপলব্ধির সুযোগ পেয়েছিলাম একাডেমিক প্রয়োজনে দেশীয় মিক্সড চ্যানেলের অনুষ্ঠান বিশ্লেষণ করতে গিয়ে। এটিএন বাংলা ও চ্যানেল আই, দেশের সর্বপ্রথম দু’টি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের এক সপ্তাহের অনুষ্ঠানসমূহ বিশ্লেষণে দেখা যায় গড়ে চ্যানেল দু’টি সম্প্রচারিত সময়ের শতকরা ৩৬.০৯ ভাগ বিনোদন অনুষ্ঠান, ১.৫০ ভাগ শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান ও ৪.৬৭ ভাগ প্ররোচনামূলক অনুষ্ঠান প্রচার করে। অন্যদিকে শুধুমাত্র তথ্যভিত্তিক অনুষ্ঠান প্রকাশের সময় শতকরা ৫৭.৭৪ ভাগ। সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানের পুনঃপ্রচারিত পর্বগুলোকে ধরলে পাঁচ প্রকার অনুষ্ঠানের ভিতর ৪৫.৯৪ ভাগ সময় শুধুমাত্র তথ্যভিত্তিক অনুষ্ঠান প্রচারিত হতে দেখা যায়। এখানে সংবাদ, টক-শো, শিশু সংবাদ, ব্যবসা, কৃষি, স্বাস্থ্য সংবাদ, চ্যানেলগুলোর দুই বেলা নিয়মিত আয়োজনকে তথ্যভিত্তিক অনুষ্ঠান হিসেবে ধরা হয়েছে। তবে চ্যানেলগুলো বিজ্ঞাপনের পিছনে কত সময় ব্যয় করে তার হিসাব ব্যতিরেকে এই ফল পাওয়া যায় তা বলে নেয়া ভালো।
অর্থাৎ আমরা দেখতে পাচ্ছি যে নামে মিক্সড চ্যানেল হলেও সম্প্রচারিত সময়ের অর্ধেক অংশের বেশি সময় চ্যানেলগুলো তথ্যভিত্তিক অনুষ্ঠান প্রচার করছে। অন্যান্য চ্যানেল কয়েকদিন দেখলে তাদের ক্ষেত্রেও বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে। ফলে বলতে হয় যে আমাদের মিক্সড চ্যানেলগুলো আসলে অর্ধেক তথ্যভিত্তিক চ্যানেল, বাকি অর্ধেক সময় মিক্সড চ্যানেল হিসেবে কাজ করছে। যেহেতু দেখাই যাচ্ছে অনুষ্ঠান হিসেবে তথ্যভিত্তিক অনুষ্ঠানগুলো বেশি প্রচারিত হচ্ছে তাই সংবাদ এবং টক-শোর ঘনঘটা দেখা যাচ্ছে। প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় সংবাদের পাশাপাশি রাত দশটার পর সব চ্যানেলেই একের পর এক টক-শো প্রচারিত হচ্ছে। আবার সেই টক-শো আরো দুইবার পুনঃপ্রচারিত হচ্ছে। যদিও এই লেখার মূল উদ্দেশ্য ছিল আমাদের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর প্রকৃতি অনুসন্ধান করতে করতে এর সংবাদ নির্মাণের রাজনীতির দিকে যাওয়া, কিন্তু এক্ষেত্রে এসে বলতেই হচ্ছে যে, মিক্সড চ্যানেলগুলোর এত বেশি সংবাদ ও টক-শো নির্ভরতা আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে যে, আমাদের চ্যানেলগুলোতে পর্যাপ্ত বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান নেই। অন্যদিকে একের পর এক চ্যানেল চালু হওয়ায় অনুষ্ঠানের চাহিদা বাড়ছে কিন্তু তার সাথে পাল্লা দিয়ে দক্ষ কলাকুশলী বাড়ছে না। ফলে বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের সংখ্যা কমে যাওয়ার পাশাপাশি অনুষ্ঠানের মানের সংকট দেখা যাচ্ছে। এই ধারা চলতে থাকলে আমাদের সংবাদ ও টক-শোগুলোরও যে একই পরিণতি হবে তা সহজেই অনুমেয়। তাই অনুষ্ঠানের এই অপ্রয়োজনীয় তথ্যনির্ভরতা কমানো নিয়ে ভাবা উচিত। কিন্তু ভাববে কারা?
সংবাদের রাজনীতি:
আমাদের দেশের কিংবা বিশ্বব্যাপী চ্যানেল কিংবা সংবাদমাধ্যমগুলো যতই বলুক না কেন যে তারা সংবাদ প্রকাশ করে সাধারন মানুষের স্বার্থে কিংবা জনগণের কল্যাণে, আমি বিশ্বাস করি যে সংবাদ যেই প্রকাশ করুক না কেন তার পিছনে অন্যতম কারণ হল নিজের অবস্থান ধরে রাখা এবং নিজের অবস্থানের পক্ষে জনমত তৈরি করা। সংবাদের মাধ্যমে নিজের অবস্থানের পক্ষে জনমত তৈরি সবাই করে সেটি আমি খুব সচেতনভাবেই বলছি। আমাদের দেশের বামপন্থী দলগুলোর মুখপত্র দেখা যায়। এসব মুখপত্র সাধারণত কোন বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে না এবং এসব মুখপত্রে মূলত মুখপত্রটি যে দলের তার নিকট অতীতের কর্মসূচীর বিস্তারিত সংবাদ দেখা যায়। যেহেতু মূলধারার গণমাধ্যমে তাদের সংবাদ উপেক্ষিত তাই জনগণের কাছে তাদের কথা পৌঁছে দেয়ার জন্যে তারা তাদের নিজস্ব মুখপত্র ব্যবহার করছে। কিন্তু মূলধারার গণমাধ্যম কিংবা বামপন্থীদের মুখপত্র, খেয়াল করে দেখুন, সবাই নিজের পক্ষে লোক টানতে চায়। এই বিষয়টাকে নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যান বলেছেন ‘ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট’, বাংলায় একে বলা হচ্ছে সম্মতি উৎপাদন।
চমস্কি ও হারম্যান তাদের গ্রন্থ “ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট, দ্য পলিটিক্যাল ইকোনমি অব দ্য মাস মিডিয়া”-য় প্রোপাগান্ডা মডেল উপস্থাপনের মাধ্যমে দেখিয়েছেন কিভাবে গণমাধ্যমগুলো সমাজের বিদ্যমান অবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে কাজ করে। চমস্কি ও হারম্যান বলেন পাঁচটি ফিল্টার পার হয়ে আসার পরই কোন একটি ঘটনা সংবাদ আকারে দর্শকের সামনে আসে। পাঁচটি ফিল্টারই বাংলাদেশের টেলিভিশন সংবাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে দেখা যাচ্ছে (অন্যান্য মাধ্যমে তো বটেই)।
প্রথমত, মালিকানা। এটি খুব স্পষ্ট কিংবা নগ্নভাবে চোখে পড়ে। বিটিভিতে আপনি যেমন সরকার বিরোধী কোন সংবাদ দেখবেন না কখনো, ঠিক তেমনি এটিএন বাংলায় শেষ কবে মাল্টিমিডিয়া গ্রুপের নেতিবাচক সংবাদ দেখেছেন মনে পড়ে? কিংবা ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনে বেক্সিমকোর? কিংবা সময় টেলিভিশনে মেঘনা গ্রুপের? দেখেন নি। আর দেখবেন সেই সম্ভাবনা শূণ্যের কোঠায় নয় বরং হিমাঙ্কের নিচে। বরং এটিএন বাংলার সংবাদে আপনি দেখতে পাবেন কোন অনুষ্ঠানে ইভা রহমান সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন আর ইনডিপানডেন্টে হয়ত দেখতে পাবেন এ বছর বেক্সিমকো গ্রুপ কত শত কোটি টাকা সিএসআর খাতে ব্যয় করেছে।
দ্বিতীয়ত, বিজ্ঞাপন। এটি মালিকানার সাথে সরাসরি যুক্ত। একই সাথে যুক্ত বিজ্ঞাপনদাতাদের উপর। বিজ্ঞাপন ও বিজ্ঞাপনদাতাদের চাপ নিয়ে পরের অংশে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। তবে বিজ্ঞাপনই এদেশে টেলিভিশন চ্যানেলের একমাত্র আয়ের উৎস বলে বিজ্ঞাপনদাতারা চ্যানেলের উপর কতটা ছড়ি ঘুরাতে পারেন তা সহজেই অনুমেয়।
তৃতীয়ত, তথ্যের সূত্র। চমস্কি ও হারম্যান বলতে চেয়েছেন সংবাদকর্মী ও মাধ্যমগুলো সংবাদের সূত্র হিসেবে তাদের কাছেই যায় যেখানে গেলে সহজেই সংবাদ পাওয়া যায় এবং যারা সমাজে বিশিষ্ট অবস্থানে রয়েছেন। এটি অনুসরণ করে আমরা যদি আমাদের চ্যানেলের সংবাদগুলো দেখি তাহলে দেখতে পাব সংবাদের শুরুতেই সরকার প্রধান কিংবা সরকারের অংশীজনের সংবাদ, এরপরই বিরোধী দলের সংবাদ, এরপর বিষয়ভিত্তিক কিছু সংবাদ দেখিয়ে সংবাদগুলো শেষ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সংবাদে সাধারণ মানুষের সাথে সম্পর্কিত, তার জীবনের সাথে সংযোগ করবে এমন সংবাদ আমরা পাচ্ছি কি? যদি পেয়েই থাকি তাহলে শহরের রেল লাইনের পাশে গড়ে ওঠা বস্তিবাসীর খবর আমরা কেন সেখানে উচ্ছেদ অভিযান হলেই পাই নাহলে নয়? কেন বস্তির মানুষ আমার পাশের এলাকায় থাকে তা আমি জানতে পারি বস্তিতে আগুন লাগার সংবাদ দেখে?
চতুর্থত, হুমকি। এখানে দুই ধরণের হুমকি দেখা যায়। আভ্যন্তরীন হুমকি হিসেবে বলাই যায় যে মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে সংবাদ তৈরি করলেই অনেকের চাকরি হারানোর শঙ্কা থাকে। আবার বাহ্যিক হুমকি হিসেবে থাকে বিজ্ঞাপনদাতাদের চাপ। একইসাথে অনেক সময় বিভিন্ন প্রভাবশালী মহল থেকে হুমকির সম্মুখীন হতে হয় নানা ভাবে। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আমাদের গণমাধ্যমগুলো হুমকি পেয়েছে প্রেস অ্যাডভাইস নামে। আবার বাগেরহাটের মংলায় সেনা কল্যাণ সংস্থার সিমেন্ট ফ্যাক্টরির ভবন ধসে ছয় শ্রমিক মৃত্যুর সংবাদ প্রচার বন্ধ হয়ে যায় এখন পর্যন্ত অপ্রকাশিত কোন হুমকির ফলেই হয়ত।
পঞ্চমত, আদর্শভীতি। এখানে মূলত বামপন্থার প্রতি ভীতির কথা বলা হয়েছিল। সোভিয়েত পতনের পর এটি সন্ত্রাসবাদ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে। বামপন্থী সংবাদ এখনো আমাদের গণমাধ্যমে আসে না তা আগেই বলা হয়েছে যা এই ফিল্টারের উপস্থিতির জানান দিচ্ছে। আবার বর্তমানে সন্ত্রাসবাদ অন্যতম সংবাদ উৎস তাও দেখাই যাচ্ছে।
এখন কথা হল, আমি বা আমরা শেষ কবে এমন একটি সংবাদ দেখেছি যা এই পাঁচটি ফিল্টার পার না হয়েই প্রকাশিত হয়েছে? যদি উত্তর হয় যে আমরা এমন সংবাদ দেখি নি, তাহলে এটি স্পষ্ট যে এখানে সংবাদ এক ধরণের রাজনৈতিক হাতিয়ার যা দিয়ে অর্থনৈতিক মুনাফাকে ধরে রাখা যায়। এখানে গণমাধ্যম তথা টেলিভিশন চ্যানেল ও এর সংবাদ প্রচার জনসেবা নয় বরং একটি বিনিয়োগ যা প্রোফিট ম্যাক্সিমাইজিং-এর আশা থেকে প্রসূত। এ বিষয়ে সেলিম রেজা নিউটন এক গবেষণায় দেখেছেন যে বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো সংবাদ ও সাংবাদিকতার নামে মূলত পাঁচটি কাজ করে যাচ্ছে।
প্রথমত, নিজ নিজ ব্যবসায়িক গ্রুপের ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষা করা।
দ্বিতীয়ত, সাধারনভাবে বাংলাদেশের ব্যবসায়িক খাতের সামগ্রিক স্বার্থ রক্ষা করা।
তৃতীয়ত, দেশি-বিদেশি করপোরেট পুঁজির অনুকূলে মার্কিন কায়দায় একটি ভোগবাদী সমাজ গঠন করা।
চতুর্থত, পশ্চিমা ঢঙের দ্বি-দলীয় ‘গণতান্ত্রিক’ ব্যবস্থাকে কার্যকরভাবে চালুর চেষ্টা করা এবং রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির বাইরে অবস্থান গ্রহণ করা।
পঞ্চমত, শক্তিশালী বুর্জোয়া শ্রেণীর অনুপস্থিতিতে বিভিন্ন পরিসরের এলিটদের নিয়ে রাজনীতিবিদদের বাদ দিয়ে রাজনৈতিক দলের বিপরীতে ব্যবসায়ীদের পরিচালনাধীন ‘সুশীল সমাজ’ গঠন করে তার নিয়ন্ত্রণ ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধি হিসেবে সংবাদপত্র বা মিডিয়ার হাতে রাখা।
এক্ষেত্রে সেলিম রেজা নিউটন শেষ দু’টি কাজকে বিশেষত প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের বেলায় প্রযোজ্য বলেছেন। তবে সার্বিকভাবে আমাদের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর সংবাদগুলো বিশ্লেষণ করে এটি স্পষ্টভাবেই বুঝতে পারা যায় যে, প্রচারিত সংবাদগুলো যতটা না জনবান্ধব মোটিভ নিয়ে করা হয় তার চেয়ে অনেক বেশি ব্যবসা ও মুনাফাবান্ধবভাবে করা হচ্ছে। আর এটি হতেই থাকবে। সমসাময়িক সময়ে এই অবস্থা থেকে উত্তরণের সুযোগ খুব বেশি দৃশ্যমানও নয়। এক্ষেত্রে সার্বিকভাবে আমাদের গণমাধ্যম কোন নীতি অনুসরণ করবে তা জরুরি। কিন্তু তার আগে প্রশ্ন থেকে যায়, আমাদের গণমাধ্যম কিংবা টেলিভিশন চ্যানেলগুলো আসলে কোন নীতি অনুসরণ করছে?
বিজ্ঞাপন: চাপ? ধোঁকা? নাকি উভয়ই!
লেখার পূর্বের অংশে বলেছিলাম বিজ্ঞাপন এখন টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর উপর বড় চাপ। কিন্তু এই চাপ কী ধরণের বা এর শক্তি কতটা তা সাধারণ মানুষের ধারণার ধরা ছোঁয়া বা নাগালের বাইরে। সাধারণ মানুষ অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে বিজ্ঞাপনের স্থলে বিজ্ঞাপনের ফাঁকে ফাঁকে অনুষ্ঠান দেখে বিরক্ত। তাদের এর থেকে একটু মুক্ত করতে পারলেই তারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। কিন্তু বিজ্ঞাপনের চাপ কি আদৌ কমেছে একটুও?
গণমাধ্যম তথা সংবাদমাধ্যমের উপর চাপ বিষয়ে তাত্ত্বিক পড়ালেখায় সবার আগে চলে আসে আইনি চাপের কথা। বাংলাদেশে প্রায় ১৪টি আইনের কতিপয় ধারা সংবাদমাধ্যমের জন্য চাপ তৈরি করতে পারে বলে বলা হয়। একই সাথে আছে বিভিন্ন নীতিমালার চাপ। গণমাধ্যমের উপর মালিকানার চাপ নিয়ে আগে আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় চাপ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এই বিজ্ঞাপন। যেহেতু বিজ্ঞাপনই এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর আয়ের একমাত্র মাধ্যম তাই টিকে থাকার জন্যেই চ্যানেলগুলো বিজ্ঞাপন প্রচার করতে বাধ্য। সেখানে আপনি-আমি অনুষ্ঠানের মাঝে বিজ্ঞাপনের বহর দেখে বিরক্ত হয়ে চ্যানেল বদলে দিলেও তাতে ঐ চ্যানেল কর্তৃপক্ষের কিছু যায় আসে না। সাংবাদিকতার শিক্ষার্থী হিসেবে আমরা ‘নিউজ হোল’ শব্দের সাথে পরিচিত। সকল আনুষ্ঠানিকতার পর একটি সংবাদ বুলেটিন যেটুকু সময় পায় সংবাদ প্রচারের জন্য তাই হল নিউজ হোল। আমাদের চ্যানেলগুলোতে বিজ্ঞাপনের আধিপত্য দেখে চ্যানেলগুলোকে ফাহমিদুল হক বলেছেন ‘বিজ্ঞাপন বৌল’। অর্থাৎ আমাদের চ্যানেলগুলো এক বিশাল গামলায় করে বিজ্ঞাপনের যোগান নিয়ে বসে এবং তা প্রচার করতেই থাকে, করতেই থাকে।
আমাদের বিজ্ঞাপনের ধরণও পরিবর্তিত হচ্ছে সময়ের সাথে সাথে। এক সময় শুধুমাত্র অনুষ্ঠনের মাঝে বিজ্ঞাপন দেখা যেত। এরপর দেখা গেল বিজ্ঞাপনদাতারা সংবাদের বিভিন্ন অংশ তাদের কোম্পানির নামে কিনে নিচ্ছেন, সংবাদের জনপ্রিয়তা এক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে থাকতে পারে। অনুষ্ঠানের নামও কোম্পানিগুলো কিনে নিলো একসময়। তারপরই আমরা দেখলাম অনুষ্ঠান চলাকালীন পর্দার এক অংশ ছোট হয়ে গিয়ে সেখানে বিজ্ঞাপন আসছে। গত দুই বছরে ধরে ঈদে বিরতিহীন অনুষ্ঠানের চাহিদা বেড়েছে। কিন্তু এতে বিজ্ঞাপন কমেছে তা ভেবে নিলে ভুল হবে। প্রথমত, প্রতিটি অনুষ্ঠানের নামের শুরুতেই দেখবেন ‘অমুক কোম্পানি বিরতিহীন নাটক’, ‘তমুক কোম্পানি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান’ নামক বিজ্ঞাপনের প্রাচুর্য। দ্বিতীয়ত, এবং আরও ভয়াবহ ভাবে ফুটে উঠেছে অনুষ্ঠানের ভিতর ‘প্রোডাক্ট প্লেসমেন্ট’-এর বিষয়টি। ২০১৬ সালের ঈদের একটি নাটকে দেখলাম ছোট ভাই তার বোনকে পরামর্শ দিচ্ছে একটি মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানির প্যাকেজ ব্যবহার করতে। বলাই বাহুল্য ঐ নাটকের নামের আগে ঐ কোম্পানির নাম ও লোগোই ছিল। অর্থাৎ বিরতিহীন অনুষ্ঠানের নামে আরো সূক্ষ্ণ ও সুদূরপ্রসারীভাবে পণ্যের তথ্য দর্শকের মস্তিষ্কে প্রবেশ করিয়ে দেয়া হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন প্রতিনিয়ত সংবাদের উপরও নানামুখী চাপ প্রয়োগ করছে। আমিনা ইসলামের এক গবেষণায় দেখা যায়, গবেষণায় অংশ নেয়া শতকরা ৯০ ভাগ হেড অব নিউজ বলেন বিজ্ঞাপনদাতাদের সংবাদ প্রচার করতে হয়; ৯০ ভাগ হেড অব নিউজ বলেন বিজ্ঞাপনদাতাদের কারণে সংবাদে প্রভাব পড়ে, এর ফলে সংবাদের সময় কমে যায়, স্টোরি ছোট হয় বা ‘কিল’ করা হয়, আদর্শগত আপোস করা হয়; ৭০ ভাগ হেড অব নিউজ বলেন বিজ্ঞাপনদাতাদের নেতিবাচক সংবাদ এড়িয়ে যাওয়া হয়। ১০০ ভাগ হেড অব নিউজ বলেন বিজ্ঞাপনদাতাদের সংবাদগুলো হয় প্রচারণামূলক, অতিদীর্ঘ, সংবাদমূল্যহীন ও মানহীন। গবেষণার এই ফলাফল থেকে সহজেই বুঝতে পারা যায় যে বিজ্ঞাপনদাতাদের কারণে আমাদের প্রচারিত সংবাদে প্রায়ই প্রভাব পড়ছে এবং জনগণ সত্য তথ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। একই গবেষণায় আরো বলা হয়েছে যে, ২০১১ সালে ১২টি টেলিভিশন চ্যানেল সর্বমোট ১৯,৭৪৪ ঘণ্টা বিজ্ঞাপন প্রচার করে। গড়ে প্রায় ৫ ঘন্টা এবং ৬৪১ টি বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয়। ভাবতে পারছেন, দিনের এক-পঞ্চমাংশের বেশি সময় আমাদের চ্যানেলগুলো বিজ্ঞাপনই প্রচার করেছে!
বিজ্ঞাপনদাতাদের চাপ যত বেশিই হোক না কেন, এর দায় নিতে হবে আমাদের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকে। এর কারণ হল একের পর এক চ্যানেল চালু হওয়ার পর থেকে চ্যানেলগুলো বিজ্ঞাপন পাওয়ার জন্যে বিজ্ঞাপনের দর কমাতে থাকে। এই দর কমতে কমতে এখন এতই কমেছে যে একটি এক ঘন্টার অনুষ্ঠান প্রচার করতে হলে চ্যানেল কর্তৃপক্ষকে অন্তত আধা ঘন্টা বিজ্ঞাপন প্রচার করতেই হবে। নাহলে তার মুনাফা কিংবা বিনিয়োগও উঠে আসবে না। আমাদের জাতীয় সংবাদপত্র ও কতিপয় চ্যানেল ছাড়া কোন চ্যানেলের বিজ্ঞাপনের মূল্য বাড়ে নি। বরং ২০১৪ সালে কোন কোন চ্যানেলে অফ-পিক আওয়ারে মাত্র দুই হাজার টাকা প্রতি মিনিট দরে বিজ্ঞাপন প্রচার করতে দেখা যায়, নরমাল স্লটে এটি ছিল মাত্র ছয় হাজার টাকা। এখন অবস্থা এমন হয়েছে যে, যেই বিজ্ঞাপন পাওয়ার জন্যে চ্যানেলগুলো বিজ্ঞাপনের দাম কমিয়েছিল, সেই বিজ্ঞাপনই এখন ফ্রাঙ্কেস্টাইন হিসেবে আবির্ভূত হয়ে চ্যানেলগুলোকে গিলে খাচ্ছে। অন্যদিকে কোন কার্যকর টিআরপি ব্যবস্থা ও পে-চ্যানেল না থাকায় চ্যানেল কর্তৃপক্ষের হাতে আসলে কোন উপায়ও দেখা যাচ্ছে না এই অব্যবস্থাপনা থেকে উত্তরণের। তাই বিজ্ঞাপনকে বিনোদন হিসেবে গ্রহণ করুন, সংবাদ ও অনুষ্ঠানকে বিজ্ঞাপন হিসেবে, আপাতত এখানেই সমাধান নিহিত!
মান কিংবা চরিত্র নির্ধারণ:আদৌ সম্ভব কি?
গণমাধ্যমের চরিত্র কেমন হবে তা নির্ধারণে কিংবা গণমাধ্যমের চরিত্র সংজ্ঞায়নের জন্যে গণমাধ্যম অধ্যয়নে নরম্যাটিভ থিওরি বা মান-নির্ধারক তত্ত্ব বেশ আলোচ্য বিষয়। এ বিষয়ের শিক্ষার্থীদের সামনে বাংলাদেশের গণমাধ্যম কোন আদর্শ অনুসরণ করছে সেই প্রশ্নটি বিভিন্নভাবে ছুঁড়ে দেয়া হয়। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে এ নিয়ে যখন আলোচনা শুরু হয় তখন মূলত ‘র্যাডিকেল লিবার্টারিয়ানিজম’ ও ‘টেকনোক্রেটিক কন্ট্রোল’ নামক দু’টি পরস্পরবিরোধী দর্শন নিয়ে আলোচনা হয়। এর ফলে উদারবাদী গণমাধ্যম ও কর্তৃত্ববাদী গণমাধ্যমের উদ্ভব হয়। আসলে উদ্ভব নয় বরং দু’টি প্রকরণের সৃষ্টি হয়। কিন্তু উদারবাদী গণমাধ্যম, অর্থাৎ কোন ধরণের নিয়ন্ত্রণহীন স্বাধীন গণমাধ্যম কখনো কোথাও দেখা যায় না বিধায় উদারবাদী গণমাধ্যম ধারণাটিকে আমরা একপাশে সরিয়ে রাখতে পারি। অন্যদিকে বলশেভিক বিপ্লবের পর সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো কমিউনিস্টিক গণমাধ্যম তৈরি করে। আদতে কর্তৃত্ববাদী ও কমিউনিস্টিক গণমাধ্যম আমার কাছে একই মুদ্রার দুই পিঠ মনে হয় কারণ উভয় ব্যবস্থাতেই গণমাধ্যমকে স্বৈরশাসক অথবা ক্ষমতায় থাকা কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশ মেনে চলতে হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আলোচনা শুরু হয় সামাজিক-দায়িত্বশীল গণমাধ্যম নিয়ে। এতে গণমাধ্যমগুলোকে সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে বলা হয়। এই চার তত্ত্ব নিয়ে ফ্রেড এস সিবার্ট, থিয়োডর পিটারসন ও উইলবার শ্রাম লিখেছিলেন “ফোর থিওরিস অফ দ্য প্রেস”। আবার যোগাযোগ তাত্ত্বিক ড্যানিস ম্যাকুয়াইল উন্নয়নমূলক গণমাধ্যম তত্ত্ব ও গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ তত্ত্বের কথা বলেন। উন্নয়নমূলক গণমাধ্যম তত্ত্বে গণমাধ্যমকে সরকারের উন্নয়নের সহায়ক হিসেবে কাজ করতে দেখা যায় (ব্রাজিল, হন্ডুরাস)। আর গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ তত্ত্বে স্থানীয়ভাবে গণমাধ্যম তৈরি হতে দেখা যায় (স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশসমূহ)। অন্যদিকে তাত্ত্বিক উইলিয়াম হাসটেন কর্তৃত্ববাদী, সাম্যবাদী (কমিউনিস্টিক), উন্নয়ন ও বিপ্লবী গণমাধ্যমের পাশাপাশি পশ্চিমা গণমাধ্যমের কথা বলেন যেখানে উদারবাদী ও সামাজিক দায়িত্বশীল তত্ত্বের মিশ্রণের কথা বলা হয়।
এখন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল বাংলাদেশের গণমাধ্যম, কিংবা এই লেখার খাতিরে যদি শুধুমাত্র আমাদের টেলিভিশন চ্যানেলের কথা বলি তাহলে তারা আসলে কোন মান কিংবা চরিত্র অনুসরণ করছে? সিবার্টের চার তত্ত্বকে ধরে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজ করা যেতে পারে। সেখানে কমিউনিস্টিক প্রেসের ধারণা বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে আগেই বাদ হয়ে যাবে। উদারবাদী গণমাধ্যমের অস্তিত্ব নেই বলে মেনে নেয়া হয়েছে আগেই। অন্যদিকে সামাজিক দায়িত্বশীলতা তথা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি প্রভৃতি বিষয়ক অনুষ্ঠান আমাদের চ্যানেলগুলো করছে কি? অবশ্যই করছে। কিন্তু কখন করছে? খেয়াল করলে দেখবেন এসব অনুষ্ঠান প্রচারিত হচ্ছে অফ-পিক আওয়ারে। যদি বলি ফিলার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে তাহলেও খুব একটা ভুল বলা হবে না। পিক আওয়ার জুড়ে থাকছে শহুরে মানুষের জন্যে অনুষ্ঠান। আমাদের চ্যানেলে গ্রামীন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বার্থ বরাবরই উপেক্ষিত। অন্যদিকে সামাজিক দায়িত্বশীলতা পালনে বিটিভির মত ভূমিকা আর কোন চ্যানেল রাখতে পারে নি সেটিও মেনে নিতে হবে। কিন্তু বিটিভি আবার সরকারের দাস হিসেবে কাজ করছে। কর্তৃত্ববাদী তত্ত্বকে যদি স্বৈরশাসকের কর্তৃত্ববাদ থেকে বের করে এনে গণতান্ত্রিক সরকারের কর্তৃত্ববাদে স্থাপন করি তাহলে বিটিভির চরিত্র কর্তৃত্ববাদী বলতে সময় লাগবে না। তাহলে বেসরকারি চ্যানেলগুলোর অবস্থান কেমন? এই লেখার বিভিন্ন অংশে আমরা দেখেছি মালিক শ্রেণীর বিপক্ষে চ্যানেলগুলোর বলার ক্ষমতা নেই। মালিক স্বার্থ সমুন্নত রেখে মালিক কোম্পানির মুনাফা বৃদ্ধির হাতিয়ার আমাদের চ্যানেলগুলো। তাই সরকারি কর্তৃত্ববাদে না পড়লেও বেসরকারি চ্যানেল আটকে গিয়েছে মালিকের কর্তৃত্ববাদে। এর সাথে বিজ্ঞাপনদাতার মাত্রাতিরিক্ত চাপে সৃষ্টি হয়েছে বিজ্ঞাপনদাতাদের (প্রচ্ছন্ন) কর্তৃত্ববাদ যা আমিনা ইসলামের গবেষণা থেকে স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে।
এসব অবস্থা থেকে এটি স্পষ্ট যে আমাদের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো পুঁজি ও মুনাফার প্রশ্নে নানামুখী কর্তৃত্ববাদে আটকে গিয়েছে। মুখে যতই উদারতা আর জনগণের কথা বলা হোক না কেন, নিজ মালিক শ্রেণীর ব্যবসায়িক স্বার্থের ঊর্দ্ধে উঠে জনগণের কথা বলার ক্ষমতা আমাদের চ্যানেলগুলোর কোন কালে ছিল না আর এখনো নেই। সব তত্ত্বের বাইরে গিয়ে বাংলাদেশের চ্যানেলগুলোর মান নির্ধারণ করার জন্যে যদি চ্যানেলগুলোকে কর্তৃত্ববাদের স্থলে পুঁজিবান্ধব কিংবা মুনাফামুখী গণমাধ্যম হিসেবে আখ্যায়িত করি তাহলে কি ভুল বলা হবে?
তবু কথা থেকে যায়
গণমাধ্যম ব্যবস্থার এই মুনাফামুখী চরিত্র শুধু বাংলাদেশের নয় বরং পুরো বিশ্বেই দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশে শুধু গণমাধ্যমের কাঙ্খিত মানোন্নয়ন হয় নি বলা যায়। হয়ত হয়ে যাবে সামনের দিনগুলোতে। কিন্তু নব্য-উদারনৈতিক বিশ্ব বাস্তবতায় গণমাধ্যমের জনমুখী হওয়ার আশা করা আসলেই অলীক কল্পনা। গণমাধ্যম অনেক আগে থেকেই বৈশ্বিক ব্যবসার ক্ষেত্র। ১৯৮২ থেকে ১৯৯৩ এর মধ্যেই বেন বাগডিকিয়ান দেখেছেন বৈশ্বিক মিডিয়া ব্যবসা ৫০ থেকে ২০টি করপোরেশনের হাতে চলে এসেছে। ২০১১ তে এটি পরিণত হয়েছে ছয়টি করপোরেশনের ক্ষুদ্র এলাকায়। এমন বৈশ্বিক বাস্তবতায় বাংলাদেশে গড়ে ওঠা পুঁজিবাদী মালিকানার গণমাধ্যমের জনগণের কথা বলার কোন কারণ নেই। এর চেয়ে পঞ্চম স্তম্ভ হিসেবে জেগে ওঠা সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে সত্য প্রকাশ ও জনমত তৈরি এখন বেশি জরুরি। বেন বাগডিকিয়ানই বলেছিলেন গণমাধ্যম এখন বাস্তবতার প্রতিফলন নয় বরং বাস্তবতার উৎস। আমাদের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো তাদের মত বাস্তবতা তৈরি করছে আমাদের মস্তিষ্কে। এখন আমরা আমাদের মস্তিষ্ক অলস রেখে গণমাধ্যমের দেয়া স্টিমুলি গ্রহণ করেই বসে থাকবো নাকি নিজেরাই নিজেদের স্নায়ুকোষগুলোকে একটু উত্তপ্ত করে গণমাধ্যমের চরিত্র উন্মোচন করবো তা ঠিক করতে হবে আমাদেরই।
তথ্যসূত্র:
রহমান, মোঃ গোলাম (১৯৯৬)। স্বাধীনতার ২৫ বছর: বাংলাদেশ টেলিভিশন, নিরীক্ষা।
চমস্কি, নোম ও হারম্যান, এডওয়ার্ড এস (১৯৭৮)। প্রচারণা মডেল (আ-আল মামুন অনূদিত), সম্মতি উৎপাদন। ঢাকা: সংহতি প্রকাশন।
নিউটন, সেলিম রেজা (২০০৩)। বাজারের যুগে সাহিত্য ও সাংবাদিকতার আম্মু-আব্বু-সমাচার অথবা বাংলাদেশে বিদ্যোমান মহাজনী মুদ্রণের পলিটিকাল ইকোনমি, যোগাযোগ। সংখ্যা ৫।
হক, ফাহমিদুল (২০১১)। বাজারমুখী বাংলাদেশের সাংবাদিকতা, একটি রাজনৈতিক অর্থনীতিমূলক পাঠ, অসম্মতি উৎপাদন। ঢাকা: সংহতি প্রকাশন।
ইসলাম, আমিনা (২০১৫)। Advertising, Editorial Policy and Hidden Pressures: An Analysis on Bangladesh Media perspectives, (অপ্রকাশিত)।
হায়দার, শাওন্তী ও সামিন, সাইফুল (২০১৪)। গণমাধ্যমের মান নির্ধারক (নরম্যাটিভ) তত্ত্ব, গণযোগাযোগ তত্ত্ব ও প্রয়োগ। ঢাকা: বাংলাদেশ প্রেস ইন্সটিটিউট।
আশরাফ, নাজমুল (২০১২)। গণমাধ্যমের দলীয়করণ। ঢাকা: শ্রাবণ প্রকাশনী।
Pingback: দেশীয় টিভি চ্যানেলের কোয়াসি-ক্রিটিক্যাল তত্ত্ব