শিবলী নোমান
একটি ভয়াবহ জঙ্গি হামলার শিকার হল বাংলাদেশ, প্রিয় মাতৃভূমি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে শহীদ হলেন দুইজন পুলিশ কর্মকর্তা, মারা গেলেন আমার দেশের নাগরিক। আর নিহত হওয়ার মাধ্যমে আমাদের লজ্জিত করে গেলেন কতিপয় বিদেশি নাগরিক। ইসলামিক স্টেট তথা আইএস বর্তমান বৈশ্বিক রাজনীতির একটি বড় কিংবা প্রধানতম আলোচ্য ইস্যু। বহুদিন ধরেই বাংলাদেশে আইএসের কার্যক্রম রয়েছে তা প্রতিষ্ঠিত করতে নানা ধরণের প্রচারণা চালানো হয়েছে। সর্বশেষ গুলশানে জঙ্গি হামলার ঘটনাতেও সাইট ইনটেলিজেনন্সের মাধ্যমে জানানো হল এই ঘটনার দায় স্বীকার করেছে আইএস।
এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার পিছনে কে বা কারা জড়িত তা নিয়ে আমি বিন্দুমাত্র আগ্রহী নই। দেশের মাটিতে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর একবারও দেখতে চাই না। তবে এটি বললেই সব শেষ হয়ে যায় না। গুলশানের ঘটনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত টেলিভিশনে দেখছিলাম, সাংবাদিকতা নিয়ে পড়ালেখা করায় কিভাবে পুরো ঘটনাটিকে কাভারেজ দেয়া হয় তার প্রতি আলাদা আগ্রহ ছিল। রাত সোয়া এগারোটা নাগাদ র্যাব মহাপরিচালক বেনজির আহমেদ সাংবাদিকদের অনুরোধ করলেন ঘটনাটির লাইভ কাভারেজ অর্থাৎ সরাসরি সম্প্রচার না করতে। সমসাময়িক সময়ে ফেইসবুকেও অনেকেই একই আহ্বান জানিয়েছিলেন।
বেনজির আহমেদের এই অনুরোধ কিংবা কতিপয় মানুষের আহ্বান নিয়ে আমি কথা বলতে চাই কারণ কেন সরাসরি সম্প্রচার করতে মানা করা হয়েছিলো তার কারণ আমরা সবাই বুঝতে পেরেছি কিনা তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকে। আপামর সাধারণ মানুষ এই আহবানের মর্মার্থ নাই বুঝতে পারেন, কিন্তু আমি যারপরনাই অবাক হই তখন যখন দেখি দেশের প্রথম সারির একটি জাতীয় দৈনিকের একজন সাব-এডিটর ফেইসবুকে প্রশ্ন করেন সরাসরি সম্প্রচার বন্ধ করা জরুরি কেন। আমি আরও বেশি হতাশ হই তখন যখন দেখি দেশের অন্যতম তথাকথিত জনপ্রিয় জাতীয় দৈনিকের বেশ উঁচুপদের একজন সরাসরি সম্প্রচার করতে মানা করার বিপক্ষে ঘটনা চলাকালীন সময়ে একের পর এক স্ট্যাটাস দিয়ে যান। এসব ঘটনার পর তাই আমাদের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকে ধন্যবাদ দিতেই হয় কারণ অধিকাংশ টেলিভিশন চ্যানেল বাস্তবিক অর্থেই সরাসরি সম্প্রচার বন্ধ করেছিলেন। আর যারা তা করেন নি কিংবা কৌশলের আশ্রয় নিয়ে সরাসরি সম্প্রচার চালিয়ে গিয়েছেন তাদের জন্যেই এই লেখা।
২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় সংঘটিত বিডিআর বিদ্রোহের সংবাদ প্রচারের ধরণকে বাংলাদেশের ইলেকট্রনিক তথা টেলিভিশন সাংবাদিকতার অন্যতম কালো দিন হিসেবে ধরা হয়। কারণ সেদিন পিলখানার ভিতর কী হয়েছে না জেনেই আমাদের সাংবাদিকগণ বিদ্রোহী জওয়ানদের পক্ষে যেভাবে সরাসরি সংবাদ প্রচার করেছিলেন তার ফলে দেশের অন্যান্য বিডিআর দপ্তরগুলোতেও অসন্তোষ দেখা দেয় এবং অনেক জায়গায় বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। বিডিআর বিদ্রোহের এই ঘটনাটিকে গুলশানের ঘটনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ মনে নাও হতে পারে। তাহলে বলতে পারি ২০০৮ সালের ২৬ থেকে২৯ নভেম্বর ভারতের মুম্বাইতে ঘটা সন্ত্রাসী হামলার কথা। এই হামলার ঘটনা নিয়ে পরবর্তীতে নির্মিত ডকুমেন্টরিতে দেখা যায় যে, হোটেল তাজ প্যালেসে থাকা জঙ্গিদের সাথে পাকিস্তানে থাকা তাদের নেতার নিয়মিত কথা হচ্ছিলো এবং নেতা জঙ্গিদের বলে দিচ্ছিলেন কোথায় কী হচ্ছে এবং কী করতে হবে। জঙ্গিদের এই কথোপকথনের যে অংশ উদ্ধার করা হয় তা থেকে জানতে পারা যায় যে জঙ্গিদের নেতা টেলিভিশনে ঘটনার কাভারেজ দেখে কর্মপন্থা ঠিক করে জানিয়ে দিচ্ছিলেন। (তথ্যসূত্র ১ দ্রষ্টব্য)
তবে লাইভ কাভারেজের কারণে সৃষ্ট জটিলতার ইতিহাস কিন্তু আরো আগে থেকে শুরু। ১৯৭২ সালের মিউনিখ অলিম্পিক চলাকালীন অলিম্পিক ভিলেজে থাকা ইসরায়েলি খেলোয়াড়দের উপর হামলা করে ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের সদস্যরা। তারা অস্ত্রের মুখে ইসরায়েলিদের অলিম্পিক ভিলেজেই জিম্মি করে। ইসরায়েলি খেলোয়াড়দের মুক্ত করার জন্যে জার্মান পুলিশের প্রাথমিক সকল চেষ্টা ভেস্তে যায়। পরে আবিষ্কৃত হয় যে তাদের সকল কার্যক্রম টেলিভিশন চ্যানেলে সরাসরি সম্প্রচারিত হচ্ছিলো এবং জিম্মিকারীরা তা দেখেই সবকিছু আগে থেকে জেনে যাচ্ছিলো। পরবর্তীতে এই ঘটনার সমাপ্তি ঘটে ইসরায়েলের ছয়জন কোচ, পাঁচজন অ্যাথলেট, পাঁচজন জিম্মিকারী এবং একজন পুলিশ কর্মকর্তার মৃত্যুর মাধ্যমে। (তথ্যসূত্র ২ দ্রষ্টব্য)
এই উদাহরনগুলো মনে করিয়ে দেয়ার প্রধান কারণ হল যারা সরাসরি সম্প্রচার বন্ধের বিরোধিতা করছিলেন তাদের এটি বুঝানো যে এটি করাই যুক্তিসঙ্গত ছিল। পাশাপাশি আমাদের গণমাধ্যমের প্রতি হতাশার জায়গাও তৈরি হয় কারণ আমাদের সামনে এত পুরনো এবং এতগুলো উদাহরন থাকার পরও আমাদের কোন গণমাধ্যম নিজে থেকে সরাসরি সম্প্রচার বন্ধ করতে আগ্রহী হয় নি। সরাসরি সম্প্রচার বন্ধের জন্যে অপেক্ষা করতে হয়েছে বেনজীর আহমেদের অনুরোধ কিংবা আহ্বান পর্যন্ত।
আমাদের বুঝতে হবে আমরা ভয়াবহ একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। তাই সবাইকে হতে হবে অনেক বেশি দায়িত্বশীল, কারণ পাড়ি দিতে হবে বহুদূর বন্ধুর পথ, অবশ্যই একসাথে।
তথ্যসূত্রঃ