শিবলী নোমান
যে কোন বিচারেই আমার হাতের লেখাকে সুন্দর বা পরিষ্কার বলা মুশকিল। এমন বহুবার হয়েছে, নিজের হাতে লেখা পুরনো খাতাপত্রের পাঠোদ্ধার করা আমার পক্ষে সম্ভব হয় নি। শোনা কথা এমন যে, পেনসিল ছেড়ে কলম ব্যবহার শুরু করার পর হাতের লেখা খুব বাজে হয়ে যায় আমার, সত্য-মিথ্যা জানা নেই।
তো এরূপ জঘন্য হাতের লেখা নিয়েই ছাত্রজীবন পার করে এসেছি। সেক্ষেত্রে বন্ধুমহলে প্রচলিত কথা ছিল এমন, যেহেতু আমার লেখা শিক্ষকরা পড়তে পারেন না, তাই বেশি বেশি নম্বর দিয়ে দেন। কিংবা কোন পরীক্ষায় আমার লেখা দেখতে চাওয়াটাও ছিল বন্ধুদের জন্য বিপত্তির। তা মূলত দুই কারণে, হাতের জঘন্য লেখা, আর সবাই যেভাবে লিখে তার চেয়ে আমার ব্যতিক্রমভাবে কলম ধরে লেখা।
তবে হাতের লেখা নিয়ে দারুণ একখান প্রশংসা করলেন আমার একজন শিক্ষক দিনকয়েক আগে। দেখা যায়, পরীক্ষার খাতার শুরুর তুলনায় শেষদিকে অধিকাংশ শিক্ষার্থীর হাতের লেখা বাজে হতে থাকে। সেক্ষেত্রে আমার লেখা সম্পর্কে সেই শিক্ষক বললেন, “ওর খাতার প্রথম পৃষ্ঠা আর শেষ পৃষ্ঠার হাতের লেখায় কোন পার্থক্য থাকতো না। পুরোটাই বাজে।”
তো, প্রথাগত ছাত্রজীবন শেষ হয়েছে বহু আগেই। আর প্রাযুক্তিক কারণে এখন হাতে লেখার পরিমাণও কমে গেছে বহুগুণ। তার উপর সমাজ বাস্তবতা মাথায় নিলে এটাও হয়তো বলা যায় যে, এখন আমার হাতের লেখা নিয়ে কথা বলার চেয়ে কষ্ট করে তা বুঝে নেয়ার দিকেই অধিকাংশের মনযোগ থাকে বেশি, বাধ্য হয়েই বটে!
তবুও নতুন করে নিজের বাজে হাতের লেখার কথা মাথায় আসে প্রায়ই। পেশাগত কারণে এখন একটা বড় সময় পার হয় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন করে। শিক্ষকতায় আসার প্রথম দিকে বিষয়টা উপভোগ করলেও খাতা মুল্যায়নের ক্লান্তিকর দিকের সাথে উপভোগের সম্পর্ক প্রতিনিয়ত ব্যস্তানুপাতিক হয়ে পড়ছে।
এই ক্লান্তিকর কাজের ক্ষেত্রে যে বিষয়টি নিয়মিত চোখে পড়ে তা হলো, হাতের লেখা ভালো এমন কোন উত্তরপত্র অপেক্ষাকৃত কম কষ্ট করে, স্বাভাবিক সময় খরচ করে দেখে ফেলা যায়। কিন্তু হাতের লেখা আমার মতো হলে তার পাঠোদ্ধার হয়ে পড়ে বেশ কষ্টসাধ্য, ফলে পুরো উত্তরপত্র পড়ে মূল্যায়ন করতে সময় লেগে যায় দুই থেকে তিনগুণ। মন, চোখ ও মস্তিষ্কের উপর যে চাপ পড়ে তা বলে বুঝানো আসলে সম্ভব না, অন্তত আমার পক্ষে।
নিজের হাতের লেখা বাজে বলে আমি আমার শিক্ষার্থীদের ‘বাজে’ হাতের লেখা নিয়ে কোন ধরণের মন্তব্য করা থেকে সচেতনভাবে বিরত থাকি। কিন্তু ইদানিং এমন হাতের লেখার খাতাগুলো মূল্যায়ন করতে গিয়ে আমার সকল শিক্ষকদের কাছে গিয়ে বলতে ইচ্ছে করে, “আমার বাজে হাতের লেখার জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী”।
সারাজীবনে প্রাইভেট টিউটরের সাহায্য নিয়েছি ২ বার। এরমধ্যে ১ টি ছিলো, ক্লাস টুতে ভয়াবহ হাতের লেখা ঠিক করতে, কড়া এক শিক্ষকের কাছে দীর্ঘ সময় ধরে টিউটোরিং।
শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত, আমার লেখা এখনো আগের মতোই ভয়াবহ আছে। এবং, খুব বিপদে না পড়লে আমি হাতে লিখতে যাওয়ার ভুল সাধারণত করি না।
হাতে লেখার প্রয়োজন কমে যাওয়ায় আমাদের বেশ উপকারই হয়েছে, এমনটা বলাই যাই মনে হয় তাহলে!