শিবলী নোমান

মহান স্বৈরশাসকের শেষ অভিভাষণ

চার্লি চ্যাপলিন

ভাষান্তর: শিবলী নোমান

(১৯৪০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত দ্য গ্রেট ডিক্টেটর ছিল চার্লি চ্যাপলিনের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র। এই চলচ্চিত্রে চ্যাপলিন দুইটি চরিত্রে (টোমাইনিয়ার স্বৈরশাসক হাইনেকেল ও একজন ইহুদি নাপিত) অভিনয় করেন। বিশ্বব্যাপী ফ্যাসিবাদের উত্থানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে চ্যাপলিন নির্মিত এই চলচ্চিত্রটির শেষ অংশে হাইনেকেলের স্থলে সেই ইহুদি নাপিত আরেকটি দেশ দখলে প্রস্তুত সৈনিকদের সামনে এক বক্তৃতা প্রদান করেন। এই ভাষণটি বিশ্বব্যাপী নন্দিত ও নিন্দিত হয়, তবে সেই ভাষণের মূলকথা আজও প্রাসঙ্গিক। চলচ্চিত্রে বক্তৃতার অংশটি ও বক্তৃতার ইংরেজি ট্রান্সক্রিপ্ট পাওয়া যাবে এখানে।)

দুঃখিত, কিন্তু আমি একজন মহাক্ষমতাধর সম্রাট হতে চাই না। সম্রাট হওয়া আমার কাজ নয়। আমি কাউকে শাসন করতে বা কাউকে জয় করে নিতে চাই না। বরং, সম্ভব হলে আমি সবাইকে সাহায্য করতে চাই; সে ইহুদি, অইহুদি, কৃষ্ণাঙ্গ বা শ্বেতাঙ্গ যাই হোক না কেন। আমরা সবাই একে অপরকে সাহায্য করতে চাই, (কারণ) এটিই মানুষের চরিত্র। আমরা একে অপরের দুর্দশাকে পুঁজি করে বাঁচতে চাই না, বরং আমরা চাই একে অপরের সুখী সত্ত্বাকে পুঁজি করে বেঁচে থাকতে। আমরা পারস্পরিক ঘৃণা ও অশ্রদ্ধার পরিবেশ চাই না। এই পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষের স্থান রয়েছে। আর একটি উত্তম বিশ্ব মানেই হলো সমৃদ্ধশালী বিশ্ব, যা সবাইকে তাদের প্রয়োজনীয়তা মাফিক সরবরাহ করতে পারবে। জীবনের গতিপথ হতে পারে মুক্ত ও সুন্দর, কিন্তু আমরা সেই পথটি হারিয়ে ফেলেছি।

প্রচন্ড লোভ মানুষের অন্তরাত্মাকে বিষাক্ত করে তুলেছে, যার ফলে পৃথিবীব্যাপী হিংসা ও বিভেদের দেয়াল তৈরি হয়েছে, আর মানুষ প্রতিনিয়ত এগিয়ে গিয়েছে দুর্দশা ও রক্তপাতের দিকে। আমরা জীবনকে গতিময় করে তুলেছি, কিন্তু নিজেদের ভেতর নিজেদের (অগ্রযাত্রাকে) থামিয়ে দিয়েছি। যেসব অত্যাধুনিক যন্ত্রকৌশল আমাদের প্রাচুর্যের যোগান দিচ্ছে, সেসব যন্ত্রকৌশলই আমাদেরকে অভাবে পতিত করছে। আমাদের জ্ঞান আমাদেরকে ঘৃণাপূর্ণ মানুষে পরিণত করছে। আমাদের চতুরতা পরিণত হয়েছে কঠোর ও নির্দয় এক বিষয়ে। আমরা অত্যাধিক পরিমাণে ভাবি, কিন্তু অনুভব করি খুব কম। যন্ত্রকৌশলের চেয়ে মানবিকতাই আমাদের বেশি প্রয়োজন। চতুরতার চেয়ে আমাদের আরো বেশি প্রয়োজন উদারতা ও নম্রতা। এসব গুনাবলি ব্যতীত আমাদের জীবন হয়ে পড়বে সহিংস, আর হবে পরাজিত।

উড়োজাহাজ ও বেতার আমাদেরকে একে অপরের কাছে নিয়ে এসেছে। এসব উদ্ভাবনের প্রকৃতিই এমন যা আমাদের সকলের ঐক্যের জন্য উচ্চকিত কণ্ঠে মানুষের সদগুণাবলিকে আহ্বান জানায়, সুউচ্চ স্বরে আহ্বান জানায় সর্বজনীন ভ্রাতৃত্বকে। এমনকি এই মুহূর্তে আমার কণ্ঠও পৌঁছে যাচ্ছে বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ হতাশ নারী-পুরুষ-শিশুর কাছে, যারা এমন এক ব্যবস্থার শিকার যা নির্দোষ মানুষকে অত্যাচার ও বন্দি করতে শেখায়।

যারা আমাকে শুনতে পাচ্ছেন, তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, হতাশ হবেন না। আমাদের উপর এখন যে দুর্দশা চেপে বসেছে, তা মানুষের লোলুপতার ক্ষণস্থায়ীত্বেরই লক্ষণ। এই লোলুপতা হলো মানুষের ভেতর থাকা এক ধরণের তিক্ততা, যা মানুষের প্রগতির পথকে ভয় পায়। মানুষের ভেতর থাকা ঘৃণা অতিক্রান্ত হবে, আর স্বৈরশাসকদের অবসান ঘটবে। আর সাধারণ মানুষের কাছ থেকে তারা যে ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিল, তা ফিরে যাবে সাধারণ মানুষেরই কাছে। এবং যতদিন পর্যন্ত মানুষ বেঁচে থাকবে, ততদিন পর্যন্ত তাদের স্বাধীনতা বিনষ্ট হবে না।

উপস্থিত সৈনিকগণ! নিজেদেরকে নরপশুদের হাতে সমর্পিত করবেন না। নিজেদেরকে তাদের হাতে সমর্পিত করবেন না যারা আপনাদেরকে অবজ্ঞা করে, দাসে পরিণত করে, আপনাদের জীবনকে শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে। তাদের হাতে নিজেদের জীবনকে সমর্পণ করবেন না যারা আপনাদেরকে বলে দেয় কী করতে হবে, কী ভাবতে হবে, আর কেমন অনুভব করতে হবে। তাদের কাছে নিজেদের সমর্পণ করবেন না যারা প্রশিক্ষণ দিয়ে ও মাপমতো খাইয়ে আপনাদের সাথে গবাদি পশুর মতো আচরণ করে, আর যুদ্ধের সময় আপনাদেরকে ব্যবহার করে নিছক জড়বস্তুর মতো। এমন কৃত্রিম মানুষদের হাতে নিজেদের সমর্পণ করবেন না। ওরা হলো যান্ত্রিক মস্তিষ্ক ও যান্ত্রিক হৃদয়সমেত একেকটি যান্ত্রিক মানুষ। কিন্তু আপনারা যন্ত্র নন। আপনারা গবাদি পশু নন। আপনারা মানুষ। নিজেদের হৃদয়ে আপনারা ধারণ করেন মানবিকতার প্রতি ভালোবাসা। আপনারা ঘৃণা করেন না। যারা ভালোবাসা পায় নি আর যারা অকৃত্রিম নয়, শুধুমাত্র তারাই ঘৃণা করতে পারে। সৈনিকগণ! দাসত্বের জন্য নয়, লড়াই করুন মুক্তির জন্য।

সন্তু লুকের সপ্তদশ অধ্যায়ে লেখা আছে, “মানুষের ভেতরই প্রভুর রাজত্ব অবস্থিত”। একজন মানুষ বা কোন বিশেষ মানবগোষ্ঠী নয়, বরং সকল মানুষের ভেতর। আপনার ভেতর। আপনাদের হাতেই আছে ক্ষমতা, যে ক্ষমতা তৈরি করতে পারে নানা ধরণের যন্ত্রকৌশল। আরো আছে সুখ সৃষ্টির ক্ষমতা। আপনাদের কাছেই আছে সেই ক্ষমতা, যার দ্বারা এই জীবনকে মুক্ত ও সুন্দর করা সম্ভব, যার ফলে এই জীবনকে পরিণত করা যায় এক দারুণ অভিযানে।

আর তাই চলুন গণতন্ত্রের নামে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমরা সেই ক্ষমতা ব্যবহার করি। চলুন সংগ্রাম করি এক নতুন পৃথিবীর জন্য যা সকল মানুষকে কাজের সুযোগ দিবে, আর তরুণ ও বৃদ্ধদের নিশ্চয়তা দিবে ভবিষ্যতের ও নিরাপত্তার। এসব দেয়ার প্রতিজ্ঞা করেই নরপশুগুলো ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু তারা মিথ্যা বলেছিল। তারা সেসব প্রতিজ্ঞা পূরণ করে নি। কখনো করবেও না।

স্বৈরশাসকরা নিজেদের মুক্ত করে, কিন্তু দাসত্বের শৃঙ্খলে বেঁধে ফেলে সাধারণ মানুষদের। তাই চলুন এখন ঐসব প্রতিজ্ঞা পূরণে কাজ করি। চলুন পৃথিবীকে মুক্ত করার জন্য সংগ্রাম করি। চলুন সংগ্রাম করি জাতীয় প্রতিবন্ধকতাসমূহ অপসারণে; চলুন সংগ্রাম করি লোভ, ঘৃণা ও অসহিষ্ণুতার অবসান ঘটাতে। চলুন সংগ্রাম করি একটি যৌক্তিক পৃথিবীর জন্য; এমন এক পৃথিবীর জন্য যেখানে বিজ্ঞান ও প্রগতি আমাদেরকে সকল মানুষের সুখের দিকে ধাবিত করবে। সৈনিকগণ, চলুন গণতন্ত্রের নামে আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হই!

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।