শিবলী নোমান
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের উত্তরপত্র মূল্যায়ন প্রসঙ্গে কখনো কখনো বিতর্ক তৈরি হতে দেখা যায়। এসব বিতর্কের পেছনের যুক্তিগুলো কখনো কখনো যেমন সবল হয়, তেমনি দুর্বল যুক্তিকে ভিত্তি করেও বিতর্ক এগিয়ে যায়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে আমি যে বিভাগে শিক্ষকতা করছি, সেই সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগের একটি আবর্তনের শিক্ষার্থীদের স্নাতকোত্তর শ্রেণির চূড়ান্ত ফল প্রকাশের পর এই বিষয়টি আরো একবার সামনে চলে এসেছে।
এক্ষেত্রে প্রকাশিত ফলাফল নিয়ে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে উত্থাপিত আপত্তি-অভিযোগ-অনাস্থা সম্পর্কে নিজের মত প্রকাশ করা সঙ্গত কারণেই এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। বরং আমাদের দেশে বিদ্যমান পরীক্ষা ও মূল্যায়ন পদ্ধতিটিই যেখানে নানাভাবে প্রশ্ন তোলার সুযোগ করে দেয়, সেখানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্তরপত্র মূল্যায়ন পদ্ধতির ক্ষেত্রে কতিপয় বিধি পরীক্ষার ফলাফল সংক্রান্ত কারণে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পারস্পরিক আস্থার সম্পর্কের নিম্নমুখীনতাকে কীভাবে আরো বেশি সঙ্কটে ফেলে দেয়, সেসব দুঃখজনক বিধি-ধারা-উপধারা সম্পর্কে নিজের আপত্তির কথা ছোট করে বলে রাখাই এই লেখার উদ্দেশ্য।
আলোচনা এগিয়ে নেয়ার সুবিধার্থে প্রথমেই বলে নেয়া ভালো যে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পাঠদান ও পরীক্ষা পরিচালনা করা হয় তিনটি ভিন্ন অধ্যাদেশ অনুসরণ করে। এই অধ্যাদেশগুলো হলো Four-Year Bachelor (Honours) Degree Ordinance 2003, Master’s Degree Ordinance 2005 এবং Ordinance Pertaining to Rules for Conducting Examinations and Examination Offences and Discipline 2003। আলোচনার সুবিধার্থে এরপর থেকে এই অধ্যাদেশগুলোকে যথাক্রমে স্নাতক অধ্যাদেশ, স্নাতকোত্তর অধ্যাদেশ ও পরীক্ষা অধ্যাদেশ হিসেবে উল্লেখ করা হবে।
আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে খুব সাধারণ একটি প্রবণতা হলো এমন দাবি তোলা যে, কোন একজন বা একদল শিক্ষক পরিকল্পনা করে কতিপয় শিক্ষার্থীর ফলাফল ভালো বা খারাপ করিয়ে দেন। অন্যদিকে সামাজিক বিজ্ঞান ও কলা অনুষদের অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলোতে প্রশ্নসমূহের একক ও নির্দিষ্ট উত্তর না থাকায়, এবং শিক্ষকদের চিন্তাগত পার্থক্যের কারণে উত্তরপত্র মূল্যায়নে বৈচিত্র্যতাও বেশি দেখা যায়। ফলে যৌক্তিক ও অযৌক্তিকভাবে বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থীদের ফলাফল ভালো বা খারাপ করিয়ে দেয়ার নিয়মিত অভিযোগ-অনুযোগ শিক্ষকদের বয়ে বেড়াতে হয়।
এক্ষেত্রে একটি বিষয় হলো, অপ্রাপ্তি ও ঈর্ষাজনিত কারণে কোন বিষয়ে অভিযোগ তোলা মানুষের সহজাত চরিত্র ও মনস্তত্ত্বের অংশ। কিন্তু পরীক্ষার ফলাফলের মতো বিষয়গুলোকে চাইলেই আরো বেশি স্বচ্ছ করে তোলা যেতে পারে, সেটি হলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়ের অবস্থানই শক্তিশালী হবে বলে মনে হয়।
এক্ষেত্রে প্রথমেই বলতে হয়, এক বা একাধিক কোর্সে প্রাপ্ত গ্রেড বা ফলাফল নিয়ে কোন শিক্ষার্থীর আপত্তি থাকতেই পারে। শিক্ষকের ইচ্ছাকৃত না হলেও পরীক্ষা গ্রহণের পর থেকে ফল প্রকাশ পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে হিউম্যান এররের অংশ হিসেবে কোন ভুল থেকে যেতেই পারে। ফলে একজন শিক্ষার্থী তার উত্তরপত্র মূল্যায়নের দাবি জানাতেই পারেন, কোন কোন ক্ষেত্রে একে তার অধিকার বলা হলে খুব একটা ভুল বলা হবে না। এক্ষেত্রে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা অধ্যাদেশের ২৯ ধারায় বলা হচ্ছে,
The answer scripts of the candidates at the university examinations will not be re-examined.
অর্থাৎ এক বা একাধিক কোর্সে প্রাপ্ত ফলাফল নিয়ে এক বা একাধিক শিক্ষার্থীর আপত্তি থাকলে সেই কোর্সের উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়নের কোন সুযোগ শিক্ষার্থীদের জন্য রাখা হয় নি। এক্ষেত্রে একটি যুক্তি হতে পারে, শিক্ষার্থীদের উত্তরপত্রটি দুইজন পরীক্ষক মূল্যায়ন করছেন, দুই পরীক্ষকের প্রদত্ত নম্বরের ভেতর ২০ শতাংশের বেশি পার্থক্য হলে তা আরো একজন পরীক্ষককে দিয়ে মূল্যায়ন করানো হচ্ছে। এরূপ চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স থাকার পর আর পুনর্মূল্যায়নের সুযোগের প্রয়োজন নেই।
এই যুক্তি মেনে নিলে, শিক্ষার্থী যেহেতু তার উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়নের সুযোগ পাচ্ছেন না, তাহলে নিশ্চয়ই তার জন্য কোন বিকল্প পথ খোলা রাখা হয়েছে। এক্ষেত্রে সর্বজনগ্রাহ্য একটি বিকল্প হতে পারে পরবর্তী সময়ে মানোন্নয়ন বা ইমপ্রুভমেন্ট পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ পাওয়া। এর ফলে শুধুমাত্র প্রাপ্ত ফলাফল নিয়ে আপত্তি থাকা শিক্ষার্থীরাই নয়, বরং কোন কারণে খারাপ ফল করে ফেলা শিক্ষার্থীরাও পুনরায় পরীক্ষা দিয়ে নিজেদের ফলাফল উন্নয়নের সুযোগ পেতে পারেন। এক্ষেত্রে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক অধ্যাদেশের ১০ ধারায় বলা হচ্ছে,
(i) If a student obtains a grade between D and A in one or more courses in a particular Part, but obtains more than 2.25 GPA in that Part, the student will not be allowed to repeat any course for the purpose of grade improvement.
(ii) Students securing only F grades are eligible for improvement examination subject to the condition that if a student obtains a ‘F’ grade in maximum two courses in any Part. Other than Part IV examination, and also obtains at least a GPA of 2.00 in the relevant Part, the student will be allowed to appear for improvement examination for the maximum of two courses of that Part along with the examinations of the next academic session. The transcript will have no reference regarding the improvement.
এবং স্নাতকোত্তর অধ্যাদেশের ৭.১ ধারায় বলা হচ্ছে (এই লেখার ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় উপধারাগুলো উল্লেখ করা হয় নি),
A candidate who has passed the Master’s Degree examination in the 3rd class or D grade (2.00) in GPA system may be permitted to re-appear as irregular candidate at the same examination in order to improve his/her qualifications without further attending classes, under the following conditions:
a) Not more than one chance shall be given to such a candidate.
b) There shall be a time limit of two years for reappearing at the examination…
d) A candidate willing to re-appear at the Master’s degree examination for improvement shall appear in all the courses and the viva-voce. The course-end examinations will be conducted normally according to the Syllabus in force in the session in which the candidate appears at the improvement examination. If, however, there are major changes in the syllabus of the course or courses the relevant Examination Committee may arrange for holding the examination according to the old syllabus…
g) The certificate to be awarded to such candidates shall be in the usual form, without any reference to previous results. No word ‘Improvement’ will not be mentioned in the official certificates.
উল্লিখিত ধারাগুলোর অর্থ এই দাঁড়ায় যে, স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে একজন শিক্ষার্থী কোন কোর্সে ৪০ শতাংশ নম্বর পেলে তার আর মানোন্নয়ন পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ থাকবে না। এর আরেক মানে হলো, পাশ করলেই মানোন্নয়ন পরীক্ষা দেয়ার দরজা বন্ধ। স্নাতকোত্তর শ্রেণির ক্ষেত্রেও ব্যবস্থাটি প্রায় এক, একজন শিক্ষার্থী স্নাতকোতর শ্রেণিতে জিপিএ ২.০০ (৪.০০ স্কেলে) পেলে মানোন্নয়ন পরীক্ষা দিতে পারবে, যদিও সেক্ষেত্রে আবারও সকল কোর্সের পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে। কিন্তু জিপিএ ২.০০ এর বেশি হলে মানোন্নয়ন পরীক্ষার কোন সুযোগ নেই।
অর্থাৎ, একদিকে শিক্ষার্থীরা উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়নের সুযোগ পাচ্ছেন না, অন্যদিকে সাধারণ অবস্থায় মানোন্নয়ন পরীক্ষা দিয়ে ফলাফলের উন্নয়ন করার পথটিও তাদের জন্য প্রায় সম্পূর্ণ বন্ধ, যদি না তারা ৪০ শতাংশের নিচে নম্বর পান বা চূড়ান্ত পরীক্ষার খাতা কেটে বেরিয়ে আসেন।
অপ্রাপ্তি ও ঈর্ষাজনিত মানবিক চারিত্রিক আচরণ ও বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থার অপ্রিয় দুর্বল দিকগুলোর সাথে শিক্ষার্থীরা যখন উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়ন ও মানোন্নয়ন পরীক্ষা দেয়ার পথটিও বন্ধ দেখতে পান, তখন আগুনে ঘি ঢালার মতো উত্তরপত্র মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্নও বেড়ে যায়, একই সাথে বেড়ে যায় একে-ওকে ভালো বা খারাপ করিয়ে দেয়া হয়েছে, এমন আলাপ-আলোচনা। আর এই অপবাদ আজীবন বয়ে বেড়াতে হয় কোন কোন শিক্ষককে।
এছাড়াও, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্তরপত্র মূল্যায়ন সংক্রান্ত আরেকটি বিধি নিয়ে আবারও ভেবে দেখা জরুরি বলে মনে হয়। স্নাতক অধ্যাদেশের ৪.৪(২) ধারায় বলা হচ্ছে,
Marks of tutorial examination should be submitted without rounding up fractions. No fractions will be rounded up to whole numbers for the entire course. The total marks obtained in individual course with fraction (if any) will be converted into grade without any rounding up.
অর্থাৎ একজন শিক্ষার্থী যদি পরবর্তী গ্রেড থেকে ০.০২ নম্বরও পিছিয়ে থাকেন, তবুও তাকে ঐ ০.০২ নম্বর গ্রেস দেয়া যাবে না; কিংবা তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরবর্তী পূর্ণসংখ্যায় পরিণত হবে না।
প্রাপ্ত নম্বরকে প্রকৃত ভগ্নাংশে হিসাব করার বিধিটিকে অত্যন্ত ন্যায়নিষ্ঠ হিসেবে সাধুবাদ জানানো যেত, যদি শিক্ষার্থীরা উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়নের সুযোগ না পেলেও অন্তত একটি ন্যূনতম ফল পর্যন্ত মানোন্নয়ন পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ পেতেন, ধরুন ৬০ বা ৬৫ শতাংশের নিচে নম্বর পেলে মানোন্নয়ন পরীক্ষা দেয়া যাবে। কিন্তু যখন তাদের জন্য উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়ন ও মানোন্নয়ন পরীক্ষার সুযোগ থাকে না, একই সাথে কোন কোন ক্ষেত্রে অতি সামান্য ভগ্নাংশের জন্য একটি গ্রেড পিছিয়েও যেতে হয়, তখন পুরো ব্যবস্থাটি শিক্ষার্থীদের জন্য হতাশাজনক হয়ে যায়।
এক্ষেত্রে বিষয়টি মোটেও এমন নয় যে, এই তিনটি বিধি সংশোধন করলেই উত্তরপত্র মূল্যায়ন নিয়ে আর কোন প্রশ্ন উঠবে না। কিন্তু এগুলো নিয়ে ভাবা হলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ভেতর আস্থার সঙ্কট তৈরি ও সময়ের সাথে সাথে তা বৃদ্ধির মাত্রাও কি কমবে না কিছুটা হলেও?
আমরা কেন ভুলে যাই যে, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কটি হওয়ার কথা ছিল সর্বাপেক্ষা অধিক আস্থা, বিশ্বাস ও ভালোবাসার।
খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণ। আশা করি, অনেকেই উপকৃত হবেন এই লেখা পড়লে।
আপনাকে ধন্যবাদ। আশা করছি এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা আরো বৃদ্ধি পাবে।