শিবলী নোমান
সব ঠিক থাকলে দীর্ঘ আট বছর পর আগামী ২৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ সমাবর্তন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষালাভ করা অধিকাংশ শিক্ষার্থীর জন্য এই দিনটি নিঃসন্দেহে বহুল আকাঙ্ক্ষিত ও তাৎপর্যবহ। সেক্ষেত্রে এই লেখার শুরুতেই সমাবর্তন গ্রহণেচ্ছু শিক্ষার্থীদের অভিনন্দন ও শুভকামনা জানানো যেতেই পারে।
তবে বরাবর যা হয়ে থাকে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন্ন সমাবর্তন নিয়েও তার বাইরে কিছু হওয়ার কারণ নেই, আর হচ্ছেও তাই। অর্থাৎ সমাবর্তন ঘিরে নানা তর্ক-বিতর্ক ছড়িয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে অনলান-অফলাইন উভয় মাধ্যমে। এসব তর্ক-বিতর্কের ভেতর আলাদাভাবে চোখে পড়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাপ্তাহিক নামক বিভিন্ন ‘বাণিজ্যিক’ কোর্স সম্পন্ন করা শিক্ষার্থীদের ‘নিয়মিত’ শিক্ষার্থীদের সাথে সমাবর্তন গ্রহণের সুযোগ করে দেয়ার প্রসঙ্গটি। এই উদ্যোগের প্রতিবাদও এসেছে কোন কোন ‘প্রগতিশীল’ ছাত্রসংগঠনের পক্ষ থেকে।
এক্ষেত্রে প্রগতিশীল শব্দটিকে উদ্ধৃতি চিহ্নের ভেতর রাখতেই হচ্ছে, কারণ প্রগতিশীল শিক্ষার্থীদের থেকে এমন দাবি বা প্রতিবাদ আসলে আসা উচিত কিনা, তা নিয়ে আমার ভেতর প্রশ্ন আছে। আশা করি আমি আমার প্রশ্ন ও চিন্তাগুলো প্রকাশ করতে পারবো এবং তার বিপক্ষে মতামত এলেও তা সঠিক পদ্ধতিতেই আসবে।
প্রথমত, এটি কোনভাবেই ধরে নেয়া ঠিক হবে না যে, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধুমাত্র স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে সপ্তাহের কর্মদিবসগুলোতে এবং দিনের বেলা পড়ালেখা হবে। বরং যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের শিক্ষার্জনের জন্য উন্মুক্ত থাকার কথা, তাই সাপ্তাহিক বা সান্ধ্যকালীন বিভিন্ন কোর্সে পাঠদান চালু রাখাই বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃত ধারণার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সেটি কীভাবে ও কী রূপে হবে, তা নিয়ে আলোচনা হতেই পারে।
দ্বিতীয়ত, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সাপ্তাহিক’ কোর্স হিসেবে চলমান অধিকাংশ বা প্রায় সকল কোর্সই চরিত্রগতভাবে বাণিজ্যিক, এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। সে হিসেবে এসব কোর্সের বিরুদ্ধে আন্দোলন, প্রতিবাদ হতেই পারে। কিন্তু বিভিন্ন উদ্দেশ্য সামনে রেখে মোটা অঙ্কের অর্থ খরচ করে, পরিপূর্ণ প্রক্রিয়া মেনে যেসব শিক্ষার্থী এসব বাণিজ্যিক কোর্স সম্পন্ন করে সফলভাবে ডিগ্রি অর্জন করেছেন, তাদের কোন্ পাপের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় তাদেরকে সমাবর্তনে ব্রাত্য করে রাখবে? সেটি হলে তা কি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঙ্ক্ষিত অন্তর্ভুক্তিমূলক চরিত্রকেও আরো দুর্বল করে দেয় না? তাছাড়া সমাবর্তনে অংশ নিতে না পারলেই কোর্সগুলোকে ‘অবৈধ’ হিসেবে প্রমাণ করার পথ খোলা থেকে যাবে, এমন ধারণাকে কিছুটা হলেও দুর্বলই মনে হচ্ছে।
এই দাবি কি আসলে বাণিজ্যিক কোর্সসমূহ থেকে ডিগ্রি লাভ করা শিক্ষার্থীদের জিম্মি করা নয়? নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ঠিক যেমনটা প্রায়শই শিক্ষকরা করে থাকেন ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ করে দিয়ে?
এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশীজনদের তরফ থেকে যে প্রশ্ন বা দাবিগুলো বরং উঠতে পারে, তা হলো,
- সমাবর্তনের মতো বড় একটি আয়োজনে কীভাবে নিয়মিত শিক্ষার্থী ও বাণিজ্যিক কোর্সসমূহের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণকে নির্বিঘ্ন ও সুচারুরূপে সমন্বয় ও সম্পন্ন করা যায়, সেদিকে মনোনিবেশ করা।
- ‘সাপ্তাহিক’ বা ‘সান্ধ্যকালীন’ কোর্সগুলোর ফি নিয়মিত স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কোর্সের স্তরে নামিয়ে এনে এসব কোর্সের ‘বাণিজ্যিক’ চরিত্রের পরিবর্তন ও উচ্চশিক্ষার দ্বার সবার জন্য উন্মুক্তকরণ।
- একই কারণে আসন্ন সমাবর্তনেও ‘বাণিজ্যিক’ কোর্সসমূহে ডিগ্রিধারীদের নিবন্ধন ফি নিয়মিত স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা শিক্ষার্থীদের সমান করা।
- অ্যাকাডেমিক বিষয়ে শিক্ষকদের দিক থেকে নিয়মিত শিক্ষার্থী ও বাণিজ্যিক কোর্সের শিক্ষার্থীদের প্রতি অভিন্ন মনোভাব নিশ্চিতকরণ।
- বাণিজ্যিক কোর্সসমূহের কারণে নিয়মিত স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের কার্যক্রমে কোনরূপ ব্যাঘাত ঘটলে দ্রুত সাড়াপ্রদান ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন।
- নিয়মিত শিক্ষার্থী ও বাণিজ্যিক কোর্সের শিক্ষার্থীদের ভেতর যোগাযোগ বৃদ্ধি ও মতবিনিময়ের পরিবেশ তৈরি।
- বাণিজ্যিক কোর্সসমূহ থেকে প্রাপ্ত অর্থের সুষ্ঠু সমন্বয় ও স্বচ্ছ ব্যবহার।
- সর্বোপরি, বাণিজ্যিক কোর্সসমূহের দিকে শিক্ষকদের ঝুঁকে পড়ার মূল কারণ অর্থনৈতিক হলে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা পুনর্বিবেচনার পদক্ষেপ গ্রহণ।
তবে একটি কথা এখানে বলে নেয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, ব্যক্তিগতভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে যে কোন ধরণের বাণিজ্যিক কোর্সের বিপক্ষেই আমার অবস্থান। কিন্তু তাই বলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিমধ্যে বিভিন্ন বাণিজ্যিক কোর্সসমূহের ডিগ্রি অর্জনকারীদের সমাবর্তনে অংশগ্রহণের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার পক্ষেও আমি নই।
তার চেয়ে বরং আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়ে উঠুক সকল দিক থেকে বৈষম্যহীন ও বৈষম্যবিরোধী। প্রকৃত অর্থেই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠুক বিশ্বজনীন।
দুই এবং তিন নম্বর পয়েন্টের সাথে বিনা বাক্যে একমত৷ তবে সাপ্তাহিক কোর্সগুলোতে নিয়মিত স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের মত ফি হইলে শিক্ষকগণ ক্লাস নিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন কিনা সেটা একটা বড় চিন্তার বিষয়!
সে কারণেই সর্বশেষ পয়েন্টটি রাখা হয়েছে।
তাও যদি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন, কী করার!