শিবলী নোমান
যে হাতিটির নাম দেয়া হয়েছিল ‘বঙ্গবাহাদুর’, সেই হাতিটি শেষ পর্যন্ত মারা গেছে। যে কোন মৃত্যুই দুঃখজনক। সেটি মানুষ হোক কিংবা যে কোন প্রাণী। তাই হাতিটিকে নিরাপদে কোন অভয়াশ্রমে নিয়ে যাওয়ার এত চেষ্টার পরও যখন শুনলাম সে মারা গিয়েছে তখন খারাপ লেগেছে। এই খারাপ লাগাটা মানবিক সহজাত প্রবৃত্তি থেকে লেগেছে। কিন্তু কিছু জটিল চিন্তার খোড়াক দিয়ে গেল হাতিটি। হাতিটির বাংলাদেশে চলে আসা থেকে শুরু করে মারা যাওয়া পর্যন্ত সময়ে এই বিষয়ে খুব বেশি সংবাদ আমি বিস্তারিত পড়ি নি। মূলত শিরোনাম দেখে দেখে আর কদাচিৎ কিছু বিস্তারিত সংবাদ পড়ে এই ইস্যুটির সাথে যুক্ত ছিলাম। কিন্তু হাতিটির মারা যাওয়ার সংবাদ শুনে খারাপ লাগার অনুভূতিটা কমে যাওয়ার পরই যে চিন্তা মাথায় আসলো তা হল, এখন আমাদের গণমাধ্যমের কী হবে? বঙ্গবাহাদুর নামক হাতিটি বেঁচে থাকলে নিশ্চিতভাবেই আরো অন্তত সপ্তাহখানেক একটি নিশ্চিত সংবাদ আমাদের গণমাধ্যমের হাতে থাকতো।
গণমাধ্যম অধ্যয়নের শিক্ষার্থী হওয়ায় তাত্ত্বিকভাবে আমাদের বারংবার শিখিয়ে দেয়া হয় যে গণমাধ্যম হল গণমানুষের মাধ্যম। গণমাধ্যমে থাকবে গণমানুষের সংবাদ, থাকবে গণমানুষের জীবন বাস্তবতার প্রতিফলন। তাত্ত্বিক আলোচনার সাথে ব্যবহারিক চর্চার পার্থক্যের বিষয়েও আমাদেরকে এই তাত্ত্বিক পড়ালেখাতেই জানিয়ে দেয়া হয়। যার ফলে গণমাধ্যম যে গণমানুষের হতে চাইলেও নানা কারণে শেষ পর্যন্ত পারে পুরোপুরি তা পারে না তা কিছুটা হলেও বুঝতে পারি। কিন্তু খারাপ লাগে এটা দেখেই যে, আমার দেশের গণমাধ্যম আমার দেশের মানুষের হতে না পারলেও বঙ্গবাহাদুর নামের হাতিটির ঠিকই হতে পেরেছে। আমি খুব সচেতনভাবে কিছুটা হতাশা আর অনেকখানি ক্ষোভ নিয়ে কথাগুলো বলছি। হাতিটি মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমি প্রতিদিন এই সংক্রান্ত সংবাদ হতে দেখেছি। গত ২৯ জুন থেকে হাতিটি মারা যাওয়া পর্যন্ত আমাদের প্রথম সারির একটি অনলাইন গণমাধ্যম এই বিষয়ে ৩১টি সংবাদ করেছে। স্মরণকালে গুলশান হামলা ব্যতীত আর কোন ইস্যুতে সর্বশেষ এত সংবাদ হয়েছে বলতে পারেন?
গত ২৬ জুন বানের পানির তোড়ে আসাম থেকে বাংলাদেশের কুড়িগ্রামে ভেসে আসে এই হাতি। এরপর থেকে হাতিটি হয়ে গেলো আমাদের গণমাধ্যমের নিয়মিত আধেয়। কিন্তু আমরা ভুলে গেলাম বানের পানির কথা। চক্ষুলজ্জার কারণে বন্যা পরিস্থিতিতে আমরা সংবাদ করেছি ঠিকই। কিন্তু বানের পানিতে ভেসে আসা হাতিটিকে ভুলে না গেলেও আমরা ভুলে গিয়েছি বানের পানির রাজনীতির কথা। ভারত থেকে বানের পানি কেন এভাবে বাংলাদেশে চলে আসলো তা নিয়ে আমরা কুতটুকু আলোচনা করেছি? কতটুকু আলোচনা করেছে আমাদের গণমাধ্যম? আন্তর্জাতিক নদীগুলোতে অমানবিকভাবে একের পর এক বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের পানির অধিকার কেড়ে নেয়ায় আমাদের বিস্তীর্ণ এলাকা যখন মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে এবং হচ্ছে, সেই ঘটনারই মুদ্রার অপর পিঠ হিসেবে বর্ষা মৌসুমে ভারতের বাঁধ খুলে দেয়ায় আমার দেশের মানুষের যে দুর্ভোগ তা নিয়ে আমরা কতটা নিয়মিত আলোচনা করি? আমরা বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করি নিয়মিত ঘটনা হিসেবে, কিন্তু বন্যার পিছনের কারণ কিংবা এ থেকে উত্তরণে জনমত গঠণে আমাদের গণমাধ্যম কোন কাজ করছে কী? তিস্তা নদীর পানিবন্টন চুক্তির সর্বশেষ অবস্থা কী? এ বিষয়ে আমাদের গণমাধ্যমে কোন আলোচনাই নেই। এগুলো খুব বড় কিংবা নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের বিষয় হিসেবে আলোচনা ঝুঁকিপূর্ণ হলে আসুন ছোট বিষয় নিয়ে কথা বলি। হাতিটি কুড়িগ্রাম দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিলো, হাতিটি মিডিয়া কাভারেজও পেয়ে গিয়েছে। কিন্তু কুড়িগ্রামের বন্যাদুর্গত মানুষগুলোর কী খবর? বানের পানিতে ভেসে আসে নি বলেই কি বন্যাদুর্গত হয়েও তারা গণমাধ্যমে জায়গা পেল না?
ভারতীয় হাতিটির উদ্ধার তৎপরতা নিয়ে আমার একদমই দ্বিমত নেই। যদিও হাতিটিকে নিরাপদে বাঁচিয়ে তুলতে পারলে আগামীকাল কিংবা আজ থেকে দশ বছর পর ভারত তার মালিকানা দাবি করলে আমি অবাক হতাম না। কিন্তু আমি শুধু একটি কথাই বলতে চাই, এই হাতি আর তার উদ্ধার অভিযানের প্রতি এতটা মিডিয়া কাভারেজ না দিয়ে যদি উত্তরাঞ্চলের বন্যাকবলিত মানুষগুলোর উপর মানবিকতার কারণে হলেও একটু বেশি নজর দিতাম তাহলে হয়ত মানুষগুলো একটু ভালো অবস্থায় থাকতো। কিংবা হয়ত এতে তাদের অবস্থার কোন উন্নতিই হতো না, কিন্তু আমরা বলতে পারতাম আমাদের গণমাধ্যম মানুষের জন্যে তাদের কাজটুকু করেছে। কিন্তু আমরা দেখলাম আমাদের গণমাধ্যম আমার দেশের মানুষের হওয়ার আগে বঙ্গবাহাদুরের হয়ে গেলো। এই দুঃখ আমরা কোথায় রাখবো?
আমাদের গণমাধ্যম আর সবকিছুর সাথে আমাদের কথাও বলবে, সেই অপেক্ষায় থাকলাম।