শিবলী নোমান

নয়া চ্যালেঞ্জ: অডিয়েন্সের আচরণ পরিবর্তন

শিবলী নোমান

ইতিহাস ঘাটালে দেখা যায় যে, ১৭৮০ সালে জেমস অগাস্টাস হিকির বেঙ্গল গেজেটের হাত ধরে এই উপমহাদেশে যাত্রা শুরু করেছিল কাগজের সংবাদপত্র। বৃটিশ শাসনামলে প্রণীত নানা কালাকানুন জারি করেও কোনভাবেই সংবাদপত্রের বিকাশ ও অগ্রগতি আটকে রাখা যায় নি। উনবিংশ শতকের শেষ দিকে বেতার বা রেডিও আবিষ্কারের ফলে, এবং বিংশ শতকের প্রথমদিকে সামরিক কর্মকান্ডে ব্যবহারের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের কাছে রেডিওর ব্যবহার জনপ্রিয় হলেও কাগজের সংবাদপত্রের আবেদন একটুও কমে যায় নি। বরং ১৯৪০ সালে পল এফ লেজার্সফেল্ড বলেছিলেন, রেডিওতে প্রচারিত সংবাদের সংক্ষিপ্ত আধেয়র কারণে কাগজের সংবাদপত্রের চাহিদা তথা সার্কুলেশন বৃদ্ধি পায়। উপমহাদেশে ১৯৫৯ সালে চলে আসে টেলিভিশিন, বাংলাদেশ নামে পরিচিত আজকের ভৌগলিক অঞ্চলে ১৯৬৪ সালে এর যাত্রা শুরু। ১৯৮০ সাল থেকে বাংলাদেশে শুরু হয় টেলিভিশনের রঙিন সম্প্রচার। এর মাঝেই ১৯৯০ এর দশকের প্রথম দিকে দেশে গণতন্ত্র ফিরে এলে সংবাদপত্রের এক ধরণের নতুন রূপে বিকাশ দেখা যায়। একবিংশ শতকের শূন্য দশকে বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের বিকাশ। কিন্তু তারপরও কমেনি কাগজের সংবাদপত্রের আবেদন।

আবার, বিশ্বব্যাপী সাধারণ মানুষকে তথ্যপ্রদানের উদ্দেশ্য নিয়েই গণমাধ্যম হিসেবে সংবাদমাধ্যমগুলোর যাত্রা শুরু হলেও সময়ের সাথে সাথে এর সাথে বিভিন্নভাবে ব্যবসায়িক দিক ও মুনাফামুখী চরিত্র যুক্ত হয়েছে। যে কোন গণমাধ্যমের জন্য বিজ্ঞাপন আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস বলে দর্শকের পাশাপাশি বিজ্ঞাপনদাতাদের নিয়ে গণমাধ্যমের দুইটি আলাদা বাজার তৈরি হতে দেখা যায়। বাংলাদেশের গণমাধ্যমও এর ব্যতিক্রম নয়। তাই সংবাদপত্রের আবেদন থাকা না থাকাই বড় কথা নয়, বরং এর সাথে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে পর্যাপ্ত বিজ্ঞাপন প্রাপ্তির বিষয়টি।

সাধারণভাবে বলা যেতে পারে যে, সংবাদপত্রের আবেদন না কমায় বিজ্ঞাপন কমারও কোন কারণ নেই। আর এক্ষেত্রেই আসলে নতুন করে চিন্তা করার বিষয়টি কাজ শুরু করে। বাংলাদেশে গত শতাব্দীর শেষ দশকে ইন্টারনেট ব্যবস্থা চালু হলেও কিংবা শূন্য দশকে এর ব্যবহার বৃদ্ধি এবং একই সাথে সামাজিক মাধ্যোমগুলোর উত্থান হলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এগুলোকে বিপ্লব বলা যাবে যাবে না। বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহার কিংবা সামাজিক মাধ্যমগুলো ব্যবহারের বিপ্লব এনেছে মূলত স্মার্ট ফোনের আগমন, সহজলভ্যতা ও ব্যাপক ব্যবহার নিশ্চিতের মাধ্যমে। এর সাথে প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে মোবাইল ডাটা প্ল্যানগুলো তথা মোবাইল অপারেটরের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার, দেশে যার ব্যবহারকারী সংখ্যা প্রায় সাড়ে ছয় কোটি।

স্মার্ট ফোনের মাধ্যমে এই বিপ্লবটি হওয়ায় বাংলাদেশের গণমাধ্যমের শ্রোতা-পাঠক-দর্শক, গণমাধ্যম অধ্যয়নের ভাষায় অডিয়েন্সের চরিত্রে এক ধরনের পরিবর্তন এসেছে। টেলিভিশনের ক্ষেত্রে অডিয়েন্স এখন আর বিজ্ঞাপনের ভিড়ে হারিয়ে যেতে রাজি নয়, বরং তারা টেলিভিশনের আধেয় ইন্টারনেট ব্যবহার করে ইউটিউব বা ভিডিও শেয়ারিং সাইটগুলো থেকে দেখে নিচ্ছে। একই সাথে এসব ব্যবহার করে নিজেও হয়ে যাচ্ছে কনটেন্ট ক্রিয়েটর বা নির্মাতা। এর ফলে বিনোদনের চাহিদা মেটার পাশাপাশি সংবাদ, তথ্য ও আয় করা যাচ্ছে একই সাথে।

বিভিন্ন গণমাধ্যমের উত্থানেও যখন অন্তত এই উপমহাদেশে সংবাদপত্রের আবেদন বা চাহিদা কোনরূপ হুমকির মুখে পড়ে নি, স্মার্ট ফোনের মাধ্যমে আসা বিপ্লব তথা অডিয়েন্সের আচরণ পরিবর্তনের ফলে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে সংবাদপত্রগুলো এক ধরনের ধাক্কা খেয়েছে বলা যায়। ধাক্কা না খেলেও তাদের কর্মপদ্ধতিতে এক ধরনের পরিবর্তন আনতে হয়েছে। স্মার্ট ফোন ব্যবহারের মাধ্যমে ইন্টারনেট সহজলভ্য হয়ে যাওয়ায় এবং অনলাইন গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমের বিকাশের ফলে এখন আর আজকের সংবাদ জানার জন্য অডিয়েন্স আগামীকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে রাজি নয়। অডিয়েন্স তথ্য চায় এখনই, এই মুহূর্তে। আর অডিয়েন্সই যেহেতু গণমাধ্যম বা গণমাধ্যম ব্যবসা টিকিয়ে রাখার মূল হাতিয়ার, আর যেহেতু অডিয়েন্স থাকলে বিজ্ঞাপন থাকবে নাহলে নয়, তাই প্রচলিত সংবাদপত্রগুলোর নিয়মিত কার্যক্রমের পাশাপাশি শুরু করতে হয়েছে অনলাইন কার্যক্রম। যেখানে অডিয়েন্সের চাহিদা মেটানোর জন্য তথ্য বা সংবাদ পাওয়া মাত্রই প্রকাশ করা হচ্ছে।

বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে একথা অতিশয়োক্তি মনে হতে পারে যে, কাগজের সংবাদপত্রের ভবিষ্যত হুমকির মুখে। কিন্তু বৈশ্বিক পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে যে, ২০১০ সাল থেকে এশিয়া ব্যতীত বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে কাগজের সংবাদপত্রের সার্কুলেশন কমতে শুরু করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে বন্ধ হয়ে গিয়েছে অনেক সংবাদপত্র। অনেকে চলে এসেছে শুধুমাত্র অনলাইন মাধ্যমে। আর বিজ্ঞাপন খুব দ্রুতবেগে সরে যাচ্ছে অনলাইন মাধ্যমে।

তাই এখন থেকেই তৈরি হতে হবে। দিন শেষে অডিয়েন্সই গণমাধ্যমকে টিকিয়ে রাখবে। অডিয়েন্স যদি কোনো গণমাধ্যম ব্যবহার করে, তাহলে সেই মাধ্যমেই কাজ করতে হবে, কারণ বিজ্ঞাপনদাতারা সেদিকেই সরে যাবে। আমাদের দেশে অডিয়েন্স এক ধরনের ‘প্যারাডাইম শিফট’-এর মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এর শেষ কোথায় হবে তা বলা যাচ্ছে না প্রাযুক্তিক অগ্রগতির অনিশ্চয়তার কারণে। তবে, কাগজের সংবাদপত্রগুলোকে আগামীতে টিকে থাকতে হলে তাদের আরো বেশি কাজ করতে হবে অনলাইনে, তা বলাই বাহুল্য। অডিয়েন্সের আচরণ পরিবর্তনের এই গতিধারার চ্যালেঞ্জকে যারা সবচেয়ে বেশি সমন্বয় এবং সে অনুযায়ী নিজেকে পরিবর্তিত করতে পারবে, দিন শেষে হয়তো তারাই টিকে থাকবে অডিয়েন্সের মাঝে।

 

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।