শিবলী নোমান
ফ্রয়েডীয় মনোঃসমীক্ষণ তত্ত্ব চিকিৎসাবিজ্ঞান এমনকি সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আলোচ্য বিষয় হলেও কতটা গ্রহণযোগ্য হিসেবে পরিগণিত হয় তা নিয়ে আলোচনা কিংবা বিতর্কের বিস্তর সুযোগ রয়েছে। সিগমুন্ড ফ্রয়েড নিজের লেখাতেই একদা বলেছিলেন যে, মানুষের যে কোন মনস্তাত্ত্বিক জটিলতাকে ফ্রয়েডীয় মনোঃসমীক্ষণ শেষ পর্যন্ত যৌনতার সাথে সম্পর্কিত করে বলে অনেকেই মনোঃসমীক্ষণের এই ক্ষেত্রটিকে স্বীকার করতে চান না কিংবা এ সম্পর্কে অস্বস্তি প্রকাশ করেন। তবে এটি মেনে নিতেই হবে যে বহুল বিতর্কিত হয়েও এই ফ্রয়েডীয় মনোঃসমীক্ষণ এখনো একাডেমিক ও নন-একাডেমিক পরিসরে অন্যতম এক আলোচিত ডিসকোর্স। তবে যারা আসলেই এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় অস্বস্তিতে থাকেন তাদের জন্য বলছি, আজকের মূল আলোচনা ফ্রয়েডীয় মনোঃসমীক্ষণ নয়। যেটুকু জেনে রাখা আজকে আমাদের প্রয়োজন তা হলো, সিগমুন্ড ফ্রয়েড বলেছিলেন, মানুষ হিসেবে আমরা আমাদের জীবদ্দশায় যেসব কাজ, অঙ্গভঙ্গি কিংবা মুখভঙ্গি করি, তার অধিকাংশই আমরা সচেতন কিংবা অবচেতন মনে করি না; বরং করি অচেতনভাবে। এই বিষয়টি বলেই আজকের ফ্রয়েড পাঠের সমাপ্তি, তবে বিষয়টি মনে রাখতে হবে এই লেখা শেষ করার স্বার্থেই।
আজকের এই লেখার মূল বিষয় মূলত প্রযুক্তি ও প্রাযুক্তিক উৎকর্ষ। ১৯৯২ সালে মার্কিন গণমাধ্যম তাত্ত্বিক নিল পোস্টম্যান লিখেছিলেন ‘টেকনোপলি: দ্য সারেন্ডার অব কালচার টু টেকনোলজি’ শীর্ষক একটি বই। এই বইতে পোস্টম্যান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পৃথিবীর প্রথম ‘টেকনোপলি’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন। টেকনোপলি কী বুঝতে হলে এই সম্পর্কিত আরো দু’টি বিষয় জেনে নেয়া জরুরি। মূলত পোস্টম্যান একটি সমাজের মানুষের উপর প্রযুক্তির প্রভাব কেমন অর্থাৎ ওই সমাজে প্রযুক্তি মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে নাকি মানুষ প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে তা দেখতে চেয়েছিলেন। আর এই দেখার বা পর্যবেক্ষণের ফলাফল হিসেবে তিনি তিনটি বিষয়ের উল্লেখ করেন। প্রথমত, ‘টুল-ইউজিং কালচার’, যে সমাজে মানুষ শুধুমাত্র তাদের প্রয়োজনের সময় বা প্রয়োজন হলেই প্রযুক্তি ব্যবহার করে, অন্য সময় নয়। দ্বিতীয়ত, ‘টেকনোক্রেসি’, এক্ষেত্রে প্রযুক্তি মানুষের জীবনের একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গে পরিণত হয়। তবে এসব উন্নত প্রযুক্তিতে মানুষ একেবারে মোহগ্রস্ত হয়ে যায় না, সমাজে কিছুটা হলেও মানবিকতা, সামাজিক ক্রমনবিন্যাস জারি থাকে। তৃতীয়ত, ‘টেকনোপলি’, এই ধরনের সমাজে মুলত প্রযুক্তিই হয়ে ওঠে মানুষের নিয়ন্ত্রক। মানুষ অচেতনভাবেই নিজেকে প্রযুক্তির হাতে তুলে দেয়। চিন্তায় স্থান পায় না মানবিকতা বা সামাজিক প্রথার বিষয়গুলো, মানুষ অনেকটাই যান্ত্রিক হয়ে ওঠে ও কাল্পনিক বাস্তবতা বা ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে বসবাস শুরু করে।
১৯৯২ সালেই নিল পোস্টম্যান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে টেকনোপলি হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন। আমার হিসেবে তখন বাংলাদেশ ছিল টুল-ইউজিং কালচারের একটি দেশ। স্মরণ করে দেখতে পারেন সেই সময়টিকে, আমাদের কাছে সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তি ছিল সম্ভবত ফ্যাক্স মেশিন, যা ঘরে ঘরে থাকার যন্ত্রে কখনোই পরিণত হয় নি। বরং প্রয়োজন পড়লে ছুটে যেতে হতো ফোন-ফ্যাক্সের দোকানে। অথবা এই তালিকায় আসতে পারে সে সময় দেশে নতুন আসা মোবাইল ফোনের নাম, যা তখনো হাতে হাতে পৌঁছে যায়নি, বরং ছিল বিলাস দ্রব্যের মতোই। আর বর্তমানে বাংলাদেশ টেকনোক্রেসি হিসেবে অবস্থান করছে বলে আমি মনে করি। আমাদের ভেতর থেকে মানবিকতাবোধ এখনো উঠে না গেলেও তার বেশির ভাগ প্রকাশ আমরা ঐ প্রযুক্তি ব্যবহার করেই করছি। শোক প্রকাশ থেকে শুরু করে আমাদের প্রতিবাদ, বিপ্লব, আন্দোলন আজ অনেকটাই প্রযুক্তিনির্ভর প্লাটফর্মে শুরু হয়ে সেখানেই শেষ হয়। আর যেগুলো ভার্চুয়াল জগত পেড়িয়ে বাস্তব জগতে চলেও আসে, সেসব ক্ষেত্রেও একটি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন ফ্রন্ট হিসেবে খোলাই থাকে প্রযুক্তিনির্ভর এইসব প্লাটফর্ম। এই যে আমাদের প্রযুক্তিনির্ভরতার দিকে একমুখী যাত্রা, তার শেষ গন্তব্য কি শুধুই টেকনোপলি কিনা আমার জানা নেই। তবে এই যে আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেকনোপলিতে পরিণত হওয়ার ২৭ বছর পরও সে পর্যন্ত যেতে পারিনি, যেতে না পারাটাই আসলে ভালো এবং সর্বাপেক্ষা ভালো, তার কারণ সম্ভবত বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে আমাদের অবস্থান কিংবা গ্লোবাল সাউথে আমাদের অবস্থান। যেহেতু সাধারণত প্রাযুক্তিক উদ্ভাবন ও তার বিচ্ছুরণ তথা ছড়িয়ে পড়া শুরু হয় গ্লোবাল নর্থ থেকে, তাই এসব ক্ষেত্রে সর্বদাই আমরা, অর্থাৎ তথাকথিত গ্লোবাল সাউথের মানুষেরা লেইট মেজোরিটি বা ল্যাগার্ডস হিসেবে থাকি এভারেট রজার্সের ডিফিউশন অব ইনোভেশন তত্ত্বের আলোকে। প্রযুক্তির এই একচ্ছত্র আধিপত্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার এই ক্ষেত্রে ল্যাগার্ডস হতে আমি কোন আপত্তি বা সংকোচ দেখি না। এছাড়া আমাদের সমাজের সামষ্টিক যে বৈশিষ্ট্য সেটিও প্রাযুক্তিক এই নিয়ন্ত্রণ আরোপকে কিছুটা হলেও ধীর করে দেয় বলে মনে করি।
কিন্তু মানুষের উপর প্রযুক্তির এই অবশ্যম্ভাবী ও অপ্রতিরোধ্য নিয়ন্ত্রণের শেষ ফলাফল কী? আর মানুষের দ্বারা সৃষ্ট এইসব প্রযুক্তি মানুষকেই নিয়ন্ত্রণ করে কি ফ্রাঙ্কেনস্টাইনে পরিণত হচ্ছে? মানুষ তার জীবনকে আরামদায়ক ও সহজ করর জন্য যে প্রাযুক্তিক উৎকর্ষ সাধন করেছে ও করছে তার ফলাফল কি মানুষ সহ্য করতে পারবে? নাকি ইয়ুভাল নোয়াহ হারারির সাথে সুর মিলিয়ে বলতে হবে, আমরা বা স্যাপিয়েন্স হলো সেই মহা ক্ষমতাধর প্রজাতি, যাদের হাতে আছে ভয়াবহ ক্ষমতা আর তারা এই ক্ষমতা দিয়ে কী করতে চায় তা তারা জানি না, এর চেয়ে ভয়াবহ আর কিছু হতে পারে না।
তাই ঋত্মিক ঘটকের কথাই আজ মনে পড়ে যায়, “ভাবো, ভাবো, ভাবা প্র্যাকটিস করো।”