শিবলী নোমান

কাতালোনিয়ার স্বাধীনতা এবং সভ্যতার সংঘাতের পুনর্পাঠ

শিবলী নোমান

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি স্থানীয় ইস্যু হয়েও কাতালোনিয়ার স্বাধীনতা এখন একটি বহুল আলোচিত বিষয়। গত ১ অক্টোবর স্পেন থেকে কাতালোনিয়ার স্বাধীনতা ইস্যুতে বহুল আলোচিত কিন্তু সমভাবে বিতর্কিত গণভোট অনুষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে। গণভোটে কাতালান ভোটারদের মাত্র ৪৩ শতাংশের অংশগ্রহণ স্পেন সরকারকে গণভোট ও কাতালান স্বাধীনতার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার নতুন সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। অন্যদিকে গণভোটের ফলাফলে ৯০ শতাংশ ভোট কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার পক্ষে পড়ায় স্বাধীনতা ঘোষণাকে সময়ের ব্যাপার বলে আখ্যায়িত করেছেন কাতালান নেতা কার্লেস পুজদেমন।

যদিও কাতালান নেতা পুজদেমন আলোচনায় বসতে রাজি, তাই বলা যায় না আসলে কী হতে যাচ্ছে। এই ধাক্কায় স্পেনের ঐক্যবদ্ধ থাকার সম্ভাবনাকে তাই একেবারে ফেলে দেয়া যাচ্ছে না। তবে স্পেন থেকে কাতালোনিয়ার বিচ্ছিন্ন হওয়া বা না হওয়ার সম্ভাবনা বা সে বিষয়ক আলোচনার ডিসকোর্স থেকে দূরে থেকে একটি ভিন্ন কিন্তু সম্পূর্ণ তাত্ত্বিক বিষয়ে আলোকপাত করতে চাই।

কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার প্রশ্নে দীর্ঘদিন যাবত আলোচনা নতুন করে যে বিষয়টিকে সামনে নিয়ে এসেছে তা হলো স্যামুয়েল পি. হান্টিংটনের সভ্যতার সংঘাত শীর্ষক তত্ত্ব। ১৯৯৩ সালের থিসিস থেকে ১৯৯৬ সালে হান্টিংটন রচনা করেন তাঁর বহুল আলোচিত গ্রন্থ ‘দ্য ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশন অ্যান্ড দ্য রিমেকিং অব ওয়ার্ল্ড অর্ডার’। মূলত স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী নতুন বিশ্ব বাস্তবতার স্বরূপ কেমন হবে তার এক ধরণের রূপরেখা কল্পনা করেছিলেন হান্টিংটিন তাঁর এই গ্রন্থে। এই গ্রন্থের বিষয়বস্তু নিয়ে সমালোচনাও কম হয় নি।

ব্যক্তিগতভাবে হান্টিংটিনের তত্ত্বের পক্ষের লোক হওয়ায় বারংবার এই বিষয়ে লিখেছি, আলোচনা করেছি। ২০১৪ সালে যুক্তরাজ্য থেকে স্বাধীনতার প্রশ্নে স্কটল্যাণ্ডের গণভোট কিংবা ২০১৬ সালের ব্রেক্সিট নতুন করে আলোচনায় এনেছে হান্টিংটন আর তাঁর তত্ত্বকে। কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার প্রশ্নে আবারো সভ্যতার সংঘাত তত্ত্বের দিকে আলোকপাতের সুযোগ হয়েছে। তবে তার আগে হান্টিংটনের তত্ত্ব নিয়ে সাধারণ আলোচনা প্রয়োজন।

হান্টিংটন মূলত বলতে চেয়েছেন, নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের যেসব সংঘাত আসন্ন তা মূলত রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের নয় বরং সভ্যতার বিপক্ষে সভ্যতার সংঘাত হিসেবে সামনে আসবে। এই তত্ত্ব ধরে তিনি বর্তমান বিশ্বে বিদ্যমান সাতটি সভ্যতা নিয়ে আলোচনা করেন। সভ্যতাগুলো হলো সিনিক, জাপানি, হিন্দু, ইসলামি, পাশ্চাত্য (ইউরোপ, উত্তর ও ল্যাটিন আমেরিকা), লাটিন আমেরিকা এবং আফ্রিকান (সম্ভাব্য) সভ্যতা। একই সাথে তিনি বিশ্বে বিদ্যমান রাষ্ট্রগুলোকে চার ভাগে ভাগ করেছেন। প্রথমত, কোর রাষ্ট্র, এরা কোন একটি সভ্যতাকে নেতৃত্ব দেয়। যেমন, সিনিক সভ্যতার কোর রাষ্ট্র হলো চায়না। দ্বিতীয়ত, ফাটলরেখার রাষ্ট্র, যে সব রাষ্ট্রে একাধিক সভ্যতার উপস্থিতি থাকায় রাষ্ট্রে ফাটল বা বিভাজনের সম্ভাবনা থাকে। ক্রিমিয়া ইস্যুতে ইউক্রেন এমনই এক রাষ্ট্রের উদাহরন। তৃতীয়ত, ছিন্ন রাষ্ট্র, এসব রাষ্ট্র এক সভ্যতার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে নতুন সভ্যতাকে গ্রহণ করে। হান্টিংটন এরূপ রাষ্ট্র হিসেবে অস্ট্রেলিয়া, তুরস্ক, রাশিয়া ও মেক্সিকোর কথা উল্লেখ করেছেন। চতুর্থত, একাকী রাষ্ট্র, এসব রাষ্ট্র একাই একটি সভ্যতা এবং এর অন্য কোন সদস্য রাষ্ট্র নেই। জাপানকে বলা হয়েছে একাকী রাষ্ট্রের উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

হান্টিংটন যেভাবে সভ্যতাগুলোকে ভাগ করেছেন তাতে এক সভ্যতা থেকে আরেক সভ্যতার মূল পার্থক্য ধরা হয়েছে সভ্যতাগুলোর ভাষা ও ধর্মকে। হান্টিংটন পরিসংখ্যানের মাধ্যমে দেখিয়েছেন কিভাবে সময়ের সাথে সাথে স্থানীয় ভাষা ও ধর্মের ব্যবহার বাড়ছে। একই সাথে তিনি ১৯৯৬ সালেই এই আশঙ্কা করেছিলেন যে, সভ্যতার সংঘাতের অংশ হিসেবে আগামী দিনে ক্রিমিয়া ইউক্রেন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রাশিয়ার সাথে একীভূত হতে পারে। ২০১৪ সালে আমরা এই ঘটনার সাক্ষী হয়েছি।

এছাড়া ২০১৪ সালের স্কটল্যাণ্ডের গণভোট যুক্তরাজ্যকে ফাটল রেখার রাষ্ট্র হিসেবে সামনে এনেছে, আবার ব্রেক্সিটের ঘটনার ফলে যুক্তরাজ্য সামনে এসেছে ছিন্ন রাষ্ট্র হিসেবে। তাহলে কাতালোনিয়ার স্বাধীনতা প্রশ্নেও কিন্তু স্পেনকে একটি ফাটলরেখার রাষ্ট্র বলাই যায়।

আর এক্ষেত্রে এসেই স্পেন ও কাতালোনিয়ার সম্পর্কের ইতিহাস কিছুটা জেনে নেয়া উচিত। ১১৫০ সালে আরাগনের রাণী পেট্রলিনিয়ার সাথে কাউন্ট অব বার্সেলোনা ৪র্থ র‍্যামন বেরেংগুয়ারের বিয়ের ফলে যে রাজবংশের সূচনা হয় তাতে আরাগোন ও কাতালোনিয়া একীভূত হয়। পরবর্তীতে ১৭১৪ সালে স্পেনের রাজা ৫ম ফিলিপ কাতালোনিয়া দখল করে তাকে স্পেন সাম্রাজ্যের অংশে পরিণত করেন। আধুনিক স্পেনের সৃষ্টির সময়েও কাতালোনিয়া স্পেনের অংশ হিসেবে থেকে যায়।

দীর্ঘদিন ধরে স্পেনের সাথে থাকলেও স্পেনের সাথে কাতালোনিয়ার মূল পার্থক্য থেকে যায় ভাষায়। আরেকবার স্মরণ করা ভালো যে, হান্টিংটন সভ্যতার সংঘাতের কারণ হিসেবে কিন্তু ভাষা আর ধর্মের পার্থক্যের কথাই বলেছিলেন। স্পেন ও কাতালোনিয়া উভয় এলাকার সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম ক্যাথলিক খ্রিস্টান হলেও ভাষা এক নয়। কাতালোনিয়ার রাজধানী বার্সেলোনার মানুষ স্প্যানিশ ভাষায় কথা বললেও বার্সেলোনার বাইরে কাতালোনিয়ার সবাই মূলত কাতালান ভাষায় কথা বলে। কাতালোনিয়ার মানুষ স্প্যানিশ ভাষা বুঝতে পারে কারণ কাতালান ভাষার সাথে স্প্যানিশ ভাষার মিল রয়েছে। কিন্তু কেউ তাদের সাথে স্প্যানিশ ভাষায় কথা বললেও তারা সাড়া দেয় কাতালান ভাষায়। আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ যে, স্প্যানিশ বা পর্তুগিজ ভাষার চেয়ে কাতালান ভাষার সাথে ফ্রেঞ্চ বা ইতালীয় ভাষার মিল বেশি। অন্যদিকে কাতালোনিয়ার ৯৫ শতাংশ মানুষ এই ভাষা ব্যবহার করে বা এই ভাষা তাদের কাছে বোধগম্য। এটি কাতালোনিয়ার প্রাথমিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃত।

ভাষা প্রশ্ন ছাড়াও আরেকটি বিষয় হলো, স্পেনের অন্যান্য এলাকার চেয়ে কাতালোনিয়া বেশ কিছু ক্ষেত্রে বেশ ভালো অবস্থানে আছে। প্রথমত, কাতালোনিয়ার বার্ষিক রপ্তানির পরিমাণ ৬৫.১ বিলিয়ন ইউরো, যা স্পেনের অন্য যে কোন এলাকার তুলনায় দ্বিগুন। দ্বিতীয়ত, জুন’১৭ পর্যন্ত কাতালোনিয়ার বেকারত্বের হার ১৩.২ শতাংশ, যেখানে স্পেনের সার্বিক বেকারত্বের হার ১৭.২ শতাংশ। তৃতীয়ত, কাতালোনিয়ার জনসংখ্যা ৭.৫ মিলিয়ন যা সমগ্র স্পেনের ১৬.১ শতাংশ। একই সাথে স্পেনের শিল্পক্ষেত্রের সিংহভাগ এই কাতালোনিয়ায় অবস্থিত।

ভাষা প্রশ্ন ছাড়াও যেসব কারণকে আমরা কাতালোনিয়ার সাথে স্পেনের পার্থক্যের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি তার কোনটিই কিন্তু কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার প্রশ্নে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে না বা যৌক্তিক থাকে না, যদি না কাতালোনিয়া আর স্পেনের ভাষা আলাদা না হয়। যদি কাতালোনিয়ার মানুষেরও একমাত্র মুখের ভাষা বা অন্তত প্রাথমিক ভাষা স্প্যানিশ হতো তাহলে কিন্তু বেকারত্ব বা জনসংখ্যা বা রপ্তানির পরিসংখ্যান শুধু কাতালোনিয়া নয় বরং স্পেনের হিসেবে চিহ্নিত হতো। মূলত ভাষাগত পার্থক্যের কারণেই এসব পার্থক্য অনেক বেশি আঞ্চলিক পার্থক্য হিসেবে সামনে চলে আসছে। একই সাথে সামনে এসেছে স্পেন থেকে কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার আলোচনাও।

তাই স্পেন থেকে কাতালোনিয়া স্বাধীন হবে কি হবে না, হলেও তা কোন পদ্ধতিতে, সেগুলো ছাড়াও আরেকটি তাত্ত্বিক আলোচনার বিষয় হলো, এর ফলে স্পেনও কি একটি ফাটল রেখার রাষ্ট্র হিসেবে সামনে চলে আসে কি না তাহলে ল্যাটিন আমেরিকা সভ্যতার কোর রাষ্ট্র হিসেবে স্পেনের যে সম্ভাবনার কথা হান্টিংটন বলেছিলেন, তা কি একটি প্যারাডক্সে পরিণত হবে!

 

সম্পর্কিত লেখা ব্রেক্সিটের রাজনৈতিক বার্তা

 

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।