শিবলী নোমান
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যখনই কোন নতুন আবর্তন বা ব্যাচের শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে তখনই আলোচনায় উঠে আসে র্যাগিং বিষয়ক কথাবার্তা। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরুর আগে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্য কিংবা নতুন শিক্ষায়তনে যাওয়ার চিন্তার চেয়ে র্যাগিং নিয়েই বেশি চিন্তিত থেকেছি এটি স্বীকার না করে উপায় নেই। তবে ক্যাম্পাসের বাইরে দেশজুড়ে যে ধরণের কথাবার্তা শুনে ক্যাম্পাসে গিয়েছি কিংবা ক্যাম্পাসে পড়া অবস্থায় ভার্চুয়াল জগতে যেসব আলোচনা দেখেছি তার অনেক কিছুই দেখি নি কিংবা নিছক গুজব হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।
না, র্যাগিং-এর পক্ষে বলছি না। ক্যাম্পাসে ক্লাস শুরুর আগে ও পরে শুনেছি একসময় শীতের রাতে পুকুরে নামিয়ে দেয়া কিংবা ম্যাচের কাঠি দিয়ে রুমের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ মাপানো ছিল বহুল প্রচলিত র্যাগিং প্রক্রিয়া। এও শুনেছি এই প্রক্রিয়ায় সিনিয়র-জুনিয়রদের ভিতর বোঝাপোড়া ও সম্পর্কের উন্নতি হয়। আমি যখন ক্যাম্পাসে গিয়েছি তখন র্যাগিং প্রথার বিরুদ্ধে প্রশাসন বেশ সোচ্চার হতে শুরু করায় র্যাগিং-এর ফলে আসলেই সম্পর্কোন্নয়ন হয় কিনা তা সঠিকভাবে বলতে পারব না। যে কোন বিষয়েরই ভালো-খারাপ থাকে, র্যাগিং-এরও হয়ত কিছু ভালো দিক থেকে থাকবে তবে আপাত দৃষ্টিতে সেটি দেখা যাচ্ছে না বা দেখার পরিস্থিতি নেই। কারন র্যাগিং-এর নামে যেভাবে নবীন শিক্ষার্থীদের ঘন্টার পর ঘন্টা নাজেহাল করা হয় তা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
এবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন র্যাগিং-এর বিরুদ্ধে একপ্রকার যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। শুনেছি নবীন শিক্ষার্থীদের র্যাগিং থেকে নিরাপদ রাখতে ২৪ ঘন্টা দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া হয়েছে বিভাগীয় শিক্ষক, প্রক্টরিয়াল বডি ও হলগুলোর আবাসিক শিক্ষকদের। মজার বিষয় হল, আমার যে শিক্ষক এই তিন ভাগেই রয়েছেন তিনি কিভাবে দিনের পর দিন ২৪ ঘন্টা এই নিরাপত্তা বিধান করবেন আমি ভেবে পাই না। কিংবা আরো গুরুতর প্রশ্ন হল আমাদের ক্যাম্পাসগুলোতে যে শক্তি কাঠামো বা ‘পাওয়ার স্ট্রাকচার’ গড়ে উঠেছে তার অবসান না ঘটিয়ে কি র্যাগিং-এর অবসান আসলেই ঘটানো সম্ভব?
এখানে শুধুমাত্র আমার ক্যাম্পাসের কথা না বলে ক্যাম্পাসগুলোর কথা বললাম কারণ শক্তি কাঠামোর শক্তি চর্চা যে প্রতিটি ক্যাম্পাসেই হচ্ছে এবং নিয়মিতভাবে প্রশাসনের চোখের সামনেই হচ্ছে তা স্পষ্ট। কিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন। হলের আবাসন সমস্যার সাথে সাথে রাতের পর রাত হলের গেস্টরুমে রাজনৈতিক সংগঠনের বড় ভাইদের সাথে সময় কাটানোর বাধ্যবাধকতাও এক্ষেত্রে তার মৃত্যুকে তরান্বিত করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্টরুমে কিভাবে বড় ভাইদের সাথে সময় কাটানো হয় জানি না তাই এ বিষয়ে কিছু বলাও ঠিক হবে না। কিন্তু যে ক্যাম্পাসই হোক, একজন নবীন শিক্ষার্থী কেন রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে বড় ভাইদের নির্দেশ মেনে গেস্টরুম কিংবা গণরুমে দাঁড়িয়ে থাকবেন এবং প্রশাসন এ বিষয়ে নির্বিকার থাকবে আর মুখে র্যাগিং-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধের কথা বলবে তাও বোধগম্য নয়?
দেশের দূর-দূড়ান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন বলে হয়ত বাধ্য হয়ে বছর খানেক এই দুর্বিষহ জীবন কাটান মাটি কামড়ে পড়ে থেকে। কিন্তু সেদিন নিজেই দেখলাম ক্লাস শুরুর দ্বিতীয় দিনেই একজন প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী তার সনদপত্র তুলে ফিরে যেতে চাইছেন। শুধু প্রশাসন কিংবা চলমান শক্তি কাঠামোই নয় বরং সাধারন শিক্ষার্থীদের মনস্তত্ত্বের বিকৃতিও চোখে পড়ে ভালো করেই। তা নাহলে গত বছরই যে শিক্ষার্থী এ ধরণের আচরণের শিকার হয়েছেন সেই শিক্ষার্থীই এ বছর সিনিয়র হয়ে নবীন শিক্ষার্থীদের র্যাগ দেয়ার তালিকায় প্রথমে থাকতে পারেন না!
আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী দেখেই আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা কিছু ঘটনা ও উপলব্ধি সম্পর্কে বললাম। কিন্তু দেশের কতগুলো বিশ্ববিদ্যালয় আসলেই র্যাগমুক্ত তা নিয়ে আলোচনা হওয়া জরুরি। র্যাগিং কিংবা শক্তি কাঠামোর কারণে উচ্চশিক্ষার সর্বশেষ স্তরে যেভাবে অবক্ষয়ের বাস্তবতা তৈরি হয়েছে তার বিরুদ্ধে প্রশাসনের প্রকৃত কঠোর অবস্থানের পাশাপাশি সাধারন শিক্ষার্থীদের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন জরুরি।