শিবলী নোমান
আমাদের যাদের যোগাযোগ ও গণমাধ্যম সংক্রান্ত তত্ত্বের ইতিহাস নিয়ে কম-বেশি কিছু পড়ালেখা আছে, তারা নিশ্চয়ই খেয়াল করেছি গণমাধ্যমের প্রভাব আসলে কেমন তা নিয়ে আলোচনা ঐসব তাত্ত্বিক আলোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। অর্থাৎ গণমাধ্যম তার পাঠক-শ্রোতা-দর্শক তথা অডিয়েন্সের উপর আসলে কোন প্রভাব ফেলতে পারে কিনা বা যদি পেরে থাকে তাহলে সেই প্রভাবের প্রকৃতি ও মাত্রা কেমন তাই হলো এই আলোচনার মূল বিষয়। গণমাধ্যম বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বগুলো থেকেই আসলে অডিয়েন্সের উপর গণমাধ্যমের প্রভাবের উপস্থিতি-অনুপস্থিতি বা মাত্রাটি নির্দিষ্ট করা হয়। গণমাধ্যমের প্রভাব সম্পর্কিত ধারণার বিবর্তনের ইতিহাসে দেখা যায় গণমাধ্যমকে প্রথমদিকে খুব শক্তিশালী ও সক্রিয় বিবেচনা করা হতো যার মাধ্যমে অডিয়েন্সকে খুব সহজে প্রভাবিত করা সম্ভব হতো। এই ধরনের তাত্ত্বিক অবস্থান কয়েক দশক চলার পর নতুন আসা কিছু গবেষণালব্ধ তত্ত্ব বলতে শুরু করলো যে গণমাধ্যমের প্রভাব আসলে সীমিত ও ধীরগতির, উল্টোদিকে অডিয়েন্স আসলে সক্রিয় ও সচেতনভাবে গণমাধ্যম থেকে বার্তা গ্রহণ করে। এই তাত্ত্বিক পরিসর পুনরায় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে কয়েক দশকের ভেতরই। এবার কোন নতুন চিন্তা? আসলে নতুন চিন্তা নয়, বরং বলা হচ্ছে ঐ যে প্রথম দিকের শক্তিশালী গণমাধ্যম, সেই ধারণাটিই আবার নতুন নতুন তত্ত্বের মাধ্যমে ফিরে আসলো। এখন প্রশ্ন হলো, গণমাধ্যম বা গণমাধ্যম সংক্রান্ত প্রযুক্তিতে আসলে এমন কী পরিবর্তন ঘটেছিল যে গত শতাব্দীর ষাটের দশকে আবারও শক্তিশালী গণমাধ্যম ধারণাটি ফিরে এসেছিল? গণমাধ্যম তাত্ত্বিকদের একটি অংশ মনে করেন যে টেলিভিশনের গণমাধ্যম হিসেবে ছড়িয়ে পড়ার ফলেই গণমাধ্যম পুনরায় শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করতে পেরেছিল আর অডিয়েন্সকে আবারও নিষ্ক্রিয় গ্রাহকে পরিণত করেছিল।
এই প্রারম্ভিক আলোচনার কারণ হলো গণমাধ্যম অধ্যয়নের ক্ষেত্রে টেলিভিশনের আলাদা একটি গুরুত্ব অনুধাবনের চেষ্টা করা। যদিও ইতোমধ্যেই বাংলাদেশসহ পৃথিবীত বিভিন্ন স্থানে টেলিচিশন আলাদা একটি জ্ঞানতাত্ত্বিক এলাকা হিসেবে গড়ে উঠেছে।
আমাদের শুরুর আলোচনা টেলিভিশনকে খুব সম্ভাবনাময় একটি গণমাধ্যম হিসেবে তুলে ধরলেও এই বিষয়ে ক্রিটিক্যাল তাত্ত্বিকদের মতামত বরাবরের মতোই অন্যরকম। ক্রিটিক্যাল তাত্ত্বিকদের মতে, প্রথমদিকে টেলিভিশনের ক্ষমতা ও প্রভাবের ফলে এর মাধ্যমে সমাজে যে ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসা সম্ভব মনে হয়েছিল, কিছুদিন পর থেকেই টেলিভিশন তার উল্টো পথে হেটেছে। দিনশেষে নিজের অসীম বিভব শক্তিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বা সেই ক্ষমতার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে টেলিভিশন খুব সাধারণ একটি বোকা বাক্সে পরিণত হয়েছে। তবে ক্রিটিক্যাল তাত্ত্বিকদের হিসেবে টেলিভিশনকে আসলে বোকা বাক্স বানিয়ে রাখা হয়েছে, এমনটা বলাই বাঞ্ছনীয়।
এই যে টেলিভিশনের বোকা বাক্সে পরিণত হওয়া, এটি মূলত হয়েছে টেলিভিশনগুলোর ব্যানালিটি টিভিতে পরিণত হওয়ার মাধ্যমে। ইংরেজি banal শব্দের অর্থ মামুলি। অর্থাৎ তাত্ত্বিকরা বলতে চাচ্ছেন টিভিগুলো আসলে খুব মামুলি বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আরেকটু জটিল করে বলতে গেলে বলতে হয়, ব্যানালিটি টিভি হলো সেইসব টেলিভিশন যেখানে বেশিরভাগ আনস্ক্রিপটেড কিন্তু ফর্মুলা অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। বদ্রিলারের মতো তাত্ত্বিকরা বলছেন এসব অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আসলে যোগাযোগ বা communication নয়, বরং করা হয় non-communication। এক্ষেত্রে স্মরণযোগ্য যে আধুনিক কালে গণমাধ্যমে যা দেখানো হয় সেগুলোকে বদ্রিলার অন্যত্র non-event বলেছেন, আর ড্যানিয়েল বুস্তিন একে বলেছিলেন pseudo event। এছাড়া ব্যানালিটি টিভির মূল দুইটি বৈশিষ্ট্যের একটি হলো, এটি অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে অডিয়েন্সকে অত্যাধিক উত্তেজিত করে তোলে। অপর বৈশিষ্ট্যিটি হলো, এসব টিভি তার আধেয়র মাধ্যমে অডিয়েন্সের ভেতর প্রতিরোধ তৈরি না করে অডিয়েন্সকে খুব সরলভাবে তার আধেয়র সাথে যুক্ত করে। অন্য কথায় এসব টিভির আধেয় তার অডিয়েন্সকে কোন ভাবনার খোড়াক দেয় না, দেয় না কোন অন্তর্দৃষ্টি। পশ্চিমা গণমাধ্যমে তিন ধরনের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে টেলিভিশনগুলো ব্যানালিটি টিভিতে পরিণত হয়েছিল বলে মনে করেন তাত্ত্বিকরা। এগুলো হলো, Chat shows, Reality TV ও Lifestyle TV।
এখন যদি আমরা বাংলাদেশের কথা বিবেচনা করি তাহলে সবার আগে এটি বলে নেয়া ভালো যে আমাদের দেশীয় টিভি চ্যানেলগুলোর কোন অনন্য চর্চা নেই যেটিকে নিজেদের দ্বারা উদ্ভাবিত বলা যায়। কোন না কোনভাবে আমাদের চর্চাগুলোর উৎস অন্যান্য দেশের, বিশেষত পশ্চিমা গণমাধ্যম। তার উপর আমাদের দেশে যেসব মিশ্র চ্যানেল রয়েছে, অর্থাৎ যেসব চ্যানেলে সংবাদ ও বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়, সেসব চ্যানেলের বিনোদন অনুষ্ঠানগুলোর আদৌ উল্লেখযোগ্য দর্শক শ্রেণি তৈরি হয়েছে কিনা তা নিয়ে আলাদা বিতর্ক হতে পারে। দিনশেষে আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় আমাদের টিভি চ্যানেলগুলোর অডিয়েন্সের মূল আগ্রহের জায়গা সংবাদ তথা তথ্যভিত্তিক অনুষ্ঠানগুলো। তাই এই লেখাটি বিশেষভাবে দেশের সংবাদভিত্তিক চ্যানেল ও অন্যান্য চ্যানেলের সংবাদ বিভাগের জন্যে বিশেষভাবে প্রযোজ্য।
ব্যানালিটি টিভির আলোচনায় ফিরে আসলে দেখা যাবে, আমাদের দেশের রিয়েলিটি টিভি খুব ভালোভাবে গড়ে উঠে নি। রিয়েলিটি টিভির পেছনে মূলত যে তিন ধরনের অনুষ্ঠান রয়েছে, আমাদের সামাজিক বাস্তবতায় তার ভেতর শুধুমাত্র popular entertainment ভিত্তিক অনুষ্ঠানগুলো দিয়েই কিছু রিয়েলিটি শো তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া শহুরে নারীদের জন্যে কিছু আধেয় কোন কোন চ্যানেলে দেখা যায়, তবে এসব অনুষ্ঠানের আধেয়তে গ্রামীণ নারী কিংবা তথাকথিত আধুনিক নারীদের বাইরে অন্যদের স্থান করে নেয়া কষ্টসাধ্য। খুবই অল্পসংখ্যক চ্যানেলে বিলাসী পণ্যকে কেন্দ্র করে লাইফস্টাইল শো চোখে পড়ে। কিন্তু বাস্তব কারণেই এর খুব বড় দর্শক শ্রেণি থাকার কথা না।
অর্থাৎ ব্যানালিটি টিভির তিনটি উপাদানের ভেতর দুইটি খুব ভালোভাবে আমাদের চ্যানেলগুলোতে দেখা যায় না। তবে অপর উপাদান অর্থাৎ Chat shows দেখা যায় বহুল প্রচারিত টক-শো আকারে। তবে যেই আঙ্গিকে ব্যানালিটি টিভির জন্যে চ্যাট শো নিয়ে আলোচনা করা হয় সেই ধরনের টক-শো আসলে আমাদের দেশে দেখা যায় না। আমাদের দেশের টক-শোগুলোতে মূলত রাজনৈতিক ও সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়ে থাকে। বিপরীতে যেসব চ্যাট শোর কথা ব্যানালিটি টিভির ক্ষেত্রে আলোচিত হয়, সেগুলোতে আলোচকদের ব্যক্তিগত জীবনের বিষয়াদি নিয়ে সেনসেশনাল আলোচনা থাকে। এর ফলে কোন কোন তাত্ত্বিক এসব চ্যাট শোকে Social Pornography-ও বলেছেন যেখানে পর্নোগ্রাফির মতোই মানুষের জীবনের খুব ব্যক্তিগত বিষয়কে সবার সামনে প্রকাশ করে দেয়া হয়।
এতদূর আলোচনা থেকে এটুকু মোটামুটি স্পষ্ট যে, আমাদের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর পশ্চিমা ধাঁচ অনুসরণের ইচ্ছা থাকলেও পশ্চিমা চ্যানেলগুলোর মতো এগুলো এখনো ব্যানালিটি টিভি বা বাংলায় বললে মামুলি টেলিভিশনে পরিণত হতে পারে নি। একদিক দিয়ে এ তো খুশির কথা! যেহেতু দেশীয় চ্যানেলগুলো এখনো পশ্চিমা চ্যানেলগুলোকে তাত্ত্বিকদের বলা মামুলি বৈশিষ্ট্য অর্জন করে উঠে নি। কিন্তু ভয়ের কথা হলো, সংবাদভিত্তিক চ্যানেলে আমরা যে ধরনের চর্চাগুলো প্রতিনিয়ত দেখি, সেগুলো ব্যানালিটি টিভির মামুলিত্বের চেয়েও মামুলি ও অপেশাদার। সেই অর্থে এই চ্যানেলগুলোর চর্চাকে ব্যনাল না বলে কোন উপায় থাকে না। আমি এই লেখায় এমন তিনটি উদাহরণ দিতে চাই।
ওরা ব্রেকিং দিচ্ছে!: এই ওরাটা কারা? এই লাইনটি পড়ে এটিই প্রথম প্রশ্ন যা মাথায় আসে। এই যে “ওরা ব্রেকিং দিচ্ছে”, এইখানে ওরা অর্থাৎ ব্যক্তির পরিবর্তন প্রতিনিয়ত ঘটলেও মূল বার্তার কোন পরিবর্তন দেখা যায় না। আমাদের সংবাদ চ্যানেলগুলোর বার্তাকক্ষে ২০-২৫ বা তার চেয়ে বেশি সংখ্যক টিভি সেটে দেশের অন্যান্য ও কতিপয় বিদেশি চ্যানেল ২৪ ঘণ্টা চালু থাকে। কোন চলচ্চিত্রে টেলিভিশন চ্যানেলের বার্তাকক্ষের এমন দৃশ্য দেখলে রোমাঞ্চ অনুভূত হতেই পারে। কিন্তু আমাদের দেশের চ্যানেলগুলোর বার্তাকক্ষে এভাবে অন্যান্য চ্যানেল ছেড়ে রাখার অন্য একটি উদ্দেশ্যও আছে। আমি একটি টেলিভিশন হাউজে এও দেখেছি কিছুক্ষণ পরপর বার্তা সম্পাদক অন্য সংবাদকর্মীদের মনে করিয়ে দিচ্ছেন অন্য চ্যানেলগুলোর দিকে খেয়াল রাখতে। কেন? কারণ অন্য কোন চ্যানেলে কোন সদ্যপ্রাপ্ত সংবাদ বা ব্রেকিং নিউজ প্রচারিত হলে যেন উক্ত হাউজও তা জানতে পারে এবং খোঁজ নিয়ে নিজেও সেই সংবাদ প্রচার করতে পারে। আপাত দৃষ্টিতে বিষয়টি খুব জটিল কিছু মনে না হলেও আমি এমন পরিস্থিতিও দেখেছি যেখানে আমি যেই হাউজে ছিলাম তারা একটি তথ্য পেয়েও নিশ্চিত ছিল না তার সত্যতা বিষয়ে, তাই তারা অপেক্ষা করে অন্য চ্যানেলে সেই জাস্ট ইন বা ব্রেকিং নিউজটি প্রচারের। তাদের হিসেবে মানসম্মত বা নির্ভরশীল কোন চ্যানেলে ঐ তথ্যটি প্রচারের পরই তারা তা প্রচার করে। আবার এমনও হয়েছে দুই বা তিনটি চ্যানেলে কোন তথ্য প্রচারের পর ঐসব চ্যানেল তা প্রচার করছে এজন্যেই তথ্যটিকে সঠিক ধরে নিয়ে কোন ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়া তথ্যটি প্রচার করা হয়েছে। তাই আমাদের বার্তাকক্ষগুলোতে আপনি দিনের বেশ কয়েকবার কাউকে হাক দিতে শুনবেন, “ওরা ব্রেকিং দিচ্ছে”, এই ওরা যেই হোক, তা খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।
২৪ ঘণ্টা লাইভ: বছর তিনেক আগে আমাদের দেশে সম্প্রচারে আসা নতুন একটি সংবাদভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেলের সংলাপ ছিল ‘দেশের প্রথম ২৪ ঘণ্টার লাইভ টেলিভিশন’ বা এই ঘরানার কিছু একটা। তো ২৪ ঘণ্টার লাইভ টেলিভিশিন ব্যাপারটা বুঝতে কিছু সময় লেগেছিল। আমি জানি না সেই চ্যানেলটি এখনও তাদের সেই ২৪ ঘণ্টা লাইভ করার অবস্থানে আছে কিনা। তবে আমাদের চ্যানেলগুলো এখন লাইভ নেশায় মত্ত। কোন ব্যক্তির বিবৃতি বা সংবাদ সম্মেলন সরাসরি সম্প্রচার করা উচিত কি উচিত না তা না ভেবেই অপরাপর চ্যানেলগুলো লাইভ করছে আর তাই প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার ভয়ে সবাই সারাদিন যাই ঘটুক তার সরাসরি সম্প্রচার চালিয়ে যায়। তবে এসব লাইভ কিন্তু দেশিয় ঘটনার। দেশের বাইরে যত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাই ঘটুক না কেন, নিজের প্রতিনিধি দিয়ে লাইভ করার বা অন্তত নিজের প্রতিনিধির রিপোর্ট করার ক্ষেত্রে আমরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চুপ! তখন রয়টার্স আর এপিই আমাদের ভরসা! ফুটেজ কেটে ডেস্কের কর্মী একটা উভ করে দিলেই ঘটনা শেষ! নিউজ তো করলাম! অথচ আমাদের চ্যানেলগুলোতে রিপোর্টাররা স্বচ্ছন্দ্যে রিপোর্ট করতে পারেন বলে মনে হয় না। আমাদের চিন্তা থাকে নিউজ হোল পূরণের। কত মিনিট খালি আছে, সেটুক দৈর্ঘ্যের প্যাকেজ বানানোর হুকুম জারি হয়। বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যমে আমরা যখন দারুণ দারুণ অনুসন্ধানী প্যাকেজ দেখতে পাচ্ছি, দেখতে পাচ্ছি প্যাকেজ নিউজের ধরণ বদলে যাচ্ছে, তখন দেশে আমরা বিতর্ক করি একটা প্যাকেজ নিউজ সর্বোচ্চ কতক্ষণের হতে পারে। এর চেয়ে বেশি লজ্জা বিদ্যায়তনে অন্য কোন আলোচনায় আছে? স্টোরি যতক্ষণ দাবি করে ততক্ষণ একটি প্যাকেজ নিউজ চলতে বাধা কি বিদ্যায়তনিক তত্ত্বে, না আমাদের চিন্তার আড়ষ্টতায়?
আমি কিন্তু কোনভাবেই ২৪ ঘণ্টা সরাসরি সম্প্রচারের বিরোধিতা করছি না। ভালো কনটেন্ট বা আধেয় থাকলে ২৪ ঘণ্টা অবশ্যই সরাসরি সম্প্রচারে থাকা সম্ভব। বাইরের অনেক চ্যানেল তা করছে। কিন্তু বাইরের সেসব চ্যানেলের অর্থনৈতিক অবস্থা ও লক্ষ্যের সাথে আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ও চূড়ান্ত লক্ষ্য মিলে কি? এখন আমরা সারাদিন যেসব লাইভ সম্প্রচার করি তার বেশিরভাগই কি আমাদের কনটেন্টহীনতা লুকানোর জন্যে নয়?
উপস্থাপক প্রধান টক-শো: আমার ধারণা আমাদের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর টক-শোর জনপ্রিয়তা ও টক-শো কেন্দ্রিকতা দুইটিই কমেছে, তার পেছনে কারণ যাই থাক না কেন। কিন্তু কম-বেশি আমাদের সবগুলো সংবাদ চ্যানেলেরই নিদেন পক্ষে একটি প্রাইম-টাইম টক-শো আছে। আর এসব টক-শোর ক্ষেত্রে উপস্থাপক যতটা জাদরেল হতে পারেন, জনপ্রিয়তা সম্ভবত ততটাই বেশি। কিন্তু এই পদ্ধতিতে আলোচনা অনুষ্ঠান চালানোটাই কিন্তু এই ক্ষেত্রের অন্যতম তাত্ত্বিক সমালোচনা। বিশ্বব্যাপী টেলিভিশনের আলোচনা অনুষ্ঠানগুলোতে হাউজ বা উপস্থাপকের পলিসি অনুযায়ী কথা না বললে কাউকে কথা বলার জন্যে ডাকাই হয় না। এ কারণেই নোম চমস্কির মতো ব্যক্তিদের কিন্তু আমরা টেলিভিশনের পর্দায় খুব একটা পাই না। কারণ তাদের দিয়ে যা খুশি বলিয়ে নেয়া যায় না। আবার তাদের উপর উপস্থাপকের ওস্তাদি করাও ততটা সোজা নয়। আমি জানি এই প্রসঙ্গে অনেক বেশি ভিন্ন বক্তব্য আসতে পারে। আমি এও জানি আমাদের দেশে আলোচনায় উপস্থাপকদের ঐ ধরনের অনুপ্রবেশ না থাকলে মূল আলোচনা অনেক দূরে সরে যাওয়ার চর্চা রয়েছে। কিন্তু একটি ভুল বিষয় দিয়ে আরেকটি ভুল চর্চাকে বৈধ ভাবার উপায়টা খুব সুবিধার না। তাছাড়া প্রায়ই দেখা যায় কোন কোন টক-শোর উপস্থাপক একটি নির্দিষ্ট এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্যে কাজ করছেন, আর তা চোখে পড়ে খুব নগ্নভাবে।
এই উদাহরণগুলোর মাধ্যমে আমি আসলে বলতে চাচ্ছি, পশ্চিমা আদলে ব্যানালিটি টিভি না হয়েও কতিপয় চর্চার কারণে আমাদের সংবাদ চ্যানেলগুলো তাদের চর্চায় ব্যানাল হয়ে যাচ্ছে, বা অনেকটা হয়ে গিয়েছে। এসবের পেছনে টিআরপি ধরে রাখার বাস্তবতা রয়েছে বলা হলে তা খুব একটা ধোপে টিকবে না কারণ আমাদের দেশে কার্যত কোন টিআরপি ব্যবস্থা নেই আর যা আছে তার গ্রহণযোগ্যোতা পাওয়ারও কোন কারণ নেই। বরঞ্চ এই টিআরপি ব্যবস্থা না থাকার বিষয়টিকে সংবাদকর্মীরা কাজে লাগাতে পারেন বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষণে। যার ভেতর দিয়ে ভালো ভালো কনটেন্ট বের হয়ে আসতে পারে। আর আপনি ভালো কনটেন্টের নিশ্চয়তা দিলে অডিয়েন্সই আপনাকে খুঁজে বের করবে তা তো খুবই পুরাতন কাসুন্দি।
সহায়ক গ্রন্থ ও তথ্যসূত্র:
চমস্কি, নোম ও ভিচেক, আন্দ্রে। (২০১৯)। পশ্চিমা সন্ত্রাসবাদ প্রসঙ্গে: হিরোশিমা থেকে ড্রোনযুদ্ধ। চৈতন্য।
Taylor, P. A. & Harris, J. L. (2008). Banality tv: The democratization od celebrity. In Critical theory of mass media: Then and now, pp. 155-176. Open University Press.
Hill, A. (2005). Reality tv: Audience and popular factual television. Routledge.
Laughey, D. (2007). Postmodernity and information society. In Key themes in media theory, pp. 147-168. Open University Press.
Wasko, J. & Meehan, E. R. (2020). A companion to television (2nd ed.). Wiley Blackwell.
McQuail, D. (2010). McQuail’s mass communication theory (6th ed.). Sage.