শিবলী নোমান

কলম্বো, ক্রাইস্টচার্চ, গুলশান: ধর্মযুদ্ধের নয়া ডিসকোর্স?

শিবলী নোমান

খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাসমতে যিশু খ্রিস্টের পুনরুজ্জীবন লাভের পবিত্র দিন ইস্টার সানডেতে আমরা প্রত্যক্ষ করলাম নিকট সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বড় পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। কলম্বোসহ শ্রীলঙ্কার তিনটি শহরের তিনটি চার্চ ও তিনটি হোটেলসহ বিভিন্ন স্থানে সর্বমোট আটটি বিস্ফোরণে কেঁপে উঠেছে পুরো শ্রীলঙ্কা। তামিল টাইগার কিংবা ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণের মৃত্যুর পর সম্ভবত এই প্রথমবার এভাবে বিশ্ব গণমাধ্যমের সংবাদ শিরোনামে উঠে আসলো শ্রীলঙ্কা। আমাদের সামাজিক মাধ্যমের নীল দেয়ালে আমরা প্রত্যক্ষ করলাম ভক্তের রক্তে রঞ্জিত যিশুমূর্তিকে। এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী অন্তত ২৯০ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে এসব বিস্ফোরণে। আর স্বাভাবিকভাবেই চার্চে হামলা হওয়ায় নিহতদের অধিকাংশই খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী, যারা তাদের ধর্মীয় উৎসবের দিনে হাজির হয়েছিলেন যিশুর সান্নিধ্য লাভের আকাঙ্খায়।

শ্রীলঙ্কায় এই সিরিজ বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় এখন পর্যন্ত কেউ দায় স্বীকার করে নি। তাই এক বাক্যে বা এক কথায় এ বিষয়ে কোন সিদ্ধান্তে আসা সমীচীন হবে না। কিন্তু এই হামলার পর থেকে একটি কথা মানুষের মুখে না হলেও মনের গভীর কোন কোণে চেতনে বা অবচেতনে কিংবা অচেতনেই হয়ত উঁকি দিয়েছে যে, শ্রীলঙ্কায় খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের লক্ষ্য করে এই আঘাত কি গত মাসে নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয় মসজিদে ঢুকে মুসলিম হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ? নাকি অন্য কিছু? এই প্রতিশোধজনিত ডিসকোর্স থেকেই মস্তিষ্কে উসকে দেয় ক্রাইস্টচার্চের ঘটনার স্মৃতি। ক্রাইস্টচার্চের হত্যাকাণ্ডে হামলাকারীর ব্যবহৃত অস্ত্রগুলো ছিল প্রতিশোধপরায়ণ ও হিংসাত্মক লেখায় পরিপূর্ণ। সেসব লেখার একটিতে উল্লেখ করা ছিল এই হত্যাকাণ্ডটি ঘটানো হচ্ছে এবা আকারলুন্ড নামের একজনের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রতিশোধ হিসেবে। মূলত ২০১৭ সালের এপ্রিলে সুইডেনের স্টকহোমে উজবেকিস্তানের এক নাগরিক লড়ি চাপা দিয়ে মেরে ফেলেছিলেন পাঁচজনকে। তাদেরই একজন এই এবা আকারলুন্ড, যিনি ছিলেন ১১ বছর বয়সী একজন শ্রবণপ্রতিবন্ধী। অর্থাৎ, এটি অন্তত নিশ্চিত যে ক্রাইস্টচার্চের হামলাটিও ছিল প্রতিশোধপরায়ণতা থেকে উদ্ভূত।

কলম্বো, ক্রাইস্টচার্চকে খুবে বেশি দূরে মনে হলে আসুন না ঘরের ভেতরের কথা বলি। ২০১৬ সালে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে তৈরি হওয়া হোস্টেজ সিচুয়েশনের ঘটনা আমাদের ভুলে যাওয়ার কথা নয়। সেখানেও কিন্তু হামলা ও হত্যাকাণ্ডের মূল টার্গেট বা নিশানা ছিল বেকারিতে থাকা অমুসলিমরা, যেহেতু হামলাকারীরা ছিলেন ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী উগ্র ধ্যান-ধারণা ও মানসিকতাসম্পন্ন। আর হামলাকারীরা বলেছিল তাদের আক্রমণ ও নিশানা শুধুমাত্র ক্রুসেডারদের প্রতি।

তাহলে ধর্মের নামে, ধর্ম রক্ষার নামে দেশে দেশে নানা সময়ে যেসব সংগঠন তৈরি হয়েছে তাদের সবার কিংবা এখন পর্যন্ত এই লেখায় উল্লেখ করা ঘটনাগুলোতে জড়িতদের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল ভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসীদের উপর প্রতিশোধ নেয়া। তাহলে কি আমরা ধর্মযুদ্ধ বা ক্রুসেডের দিনগুলোতে ফিরে যাচ্ছি? কেমন হতে যাচ্ছে একবিংশ শতাব্দীর এই ক্রুসেড?

এসব প্রশ্নের উত্তর হয়ত পাওয়া যাবে আসল ক্রুসেডের ইতিহাসে, তা চলুন না বর্তমান থেকে ফিরে যাই ক্রুসেডের সেই টালমাটাল সময়টাতে। ইসলাম ধর্মের অন্যতম খলিফা হযরত উমর (রা) এর শাসনামলে জেরুজালেম মুসলিম শাসনের অধীনে আসে। এটি সেই শহর যাকে নিয়ে তিনটি আব্রাহামিক ধর্মের টানাপোড়েন। এই শহর ইহুদিদের কাছে পবিত্র কারণ এখানেই কিং সলোমন স্থাপন করেছিলেম ইহুদিদের প্রথম মন্দির। খ্রিস্টানদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই শহরে যিশু তাঁর ধর্ম প্রচার করতেন, অংশ নিতেন আলোচনায়। আর মুসলমানদের প্রথম কেবলা বায়তুল মোকাদ্দাস অবস্থিত এই শহরেই, তাছাড়া ইসলাম ধর্মমতে এই জেরুজালেম থেকেই মি’রাজের রাতে ঊর্ধ্বাকাশে গমন করেছিলেন মহানবী হযরত মুহম্মদ (স)। তাই এই তিন ধর্মের মানুষই সবসময় চেয়েছে জেরুজালেমের অধিকার থাকুক শুধুমাত্র তাদের নিজেদের হাতে। আর এই জেরুজালেম পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন দেখিয়েই ১০৯৫ সালে পোপ দ্বিতীয় আরবান ক্রুসেডের ডাক দিয়েছিলেন। ক্রুসেডের প্রতি পোপের এই আহ্বানের পেছনের উদ্দেশ্য শুধুই ধর্মীয় নাকি পোপের কোন রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ ছিল তা নিয়ে একটি প্রচলিত ডিসকোর্স রয়েছে, যা এই লেখার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তবে মূল কথা হলো, ক্রুসেডের ডাক দিলেও এই যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষমতা পোপের ছিল না, তাই তিনি বিভিন্ন খ্রিস্টান অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতর রাজা, সামন্তপ্রভু, ডিউক তথা নেতাদের উদ্বুদ্ধ করেছিলেন ক্রুসেডে অংশ নেয়ার জন্য। অন্যদিকে ক্রুসেডের ইতিহাস থেকে দেখা যায় যে, জেরুজালেমের অধিকার ফিরে পাওয়া মুখে মুখে মূল উদ্দেশ্য হলেও ক্রুসেডে অংশ নেয়া বিভিন্ন অঞ্চলের শাসক, রাজা ও ডিউকদের আকাঙ্ক্ষা ছিল নতুন নতুন ভূমির উপর কর্তৃত্ব আরোপ করা। এ কারণেই ক্রুসেডের একদম প্রথমদিকে জেরুজালেম মুসলিমদের হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার পরও ক্রুসেড থেমে যায় নি। আবার ১১৮৭ সালে জেরুজালেম পুনরায় মুসলিমদের অধিকারে আসার পরও যেসব ক্রুসেড হয়েছে সেখানে জেরুজালেম নয় বরং অন্যান্য ভূখন্ডের দিকেই ক্রুসেডারদের নজর ছিল বেশি। ফলে ক্রুসেড যে আসলে ধর্ম বা ধর্ম রক্ষার জন্য যুদ্ধ, প্রচলিত এই ডিসকোর্সের প্রতি আমার দ্বিমত আছে। ক্রুসেড কোন ধর্মযুদ্ধ ছিল না, বরং ক্রুসেডের নামে যা হয়েছে তার লক্ষ্য ছিল পশ্চিমা সামন্তবাদের সম্প্রসারণ।

অর্থাৎ আমরা যেভাবে বা যতভাবেই বলতে চাই না কেন যে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্ম বা ধর্ম রক্ষার নামে দেশে দেশে বিশেষ করে অতি সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনালয়ে হামলা ও হত্যাকাণ্ডের যে চল শুরু হয়েছে তা ধর্মযুদ্ধ বা ক্রুসেডের নয়া রূপ, এই বক্তব্য প্রমাণ করা কঠিন, অনেক ক্ষেত্রে অবাস্তবও। আমাদেরকে সবার আগে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা ধর্মযুদ্ধ চাই কিনা। পৃথিবীতে এমন কোন ধর্ম নেই যা মানব কল্যাণের কথা বলে না বা বলে নি। তাহলে সেই একই ধর্মের নামে মানুষ হত্যা কখনো গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বৌদ্ধ ধর্মমতে, আমাদের যাবতীয় দুঃখের কারণ হলো সত্যের প্রতি আমাদের অজ্ঞানতা, আর এই অজ্ঞানতা দূর করার মাধ্যমেই প্রকৃত মুক্তি সম্ভব। বর্তমান সময়ে আমাদের সবচেয়ে বড় অজ্ঞতা এই যে, আমরা ভেবেই নিচ্ছি আমার ধর্ম রক্ষা করার দায়িত্ব আমার, আর এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমরা লিপ্ত হচ্ছি অন্য ধর্মের মানুষ হত্যায়। আমাদের অজ্ঞানতা এই যে, যে সৃষ্টিকর্তা এই বিশাল বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করতে পারেন, তাঁকে বা তাঁর ধর্ম রক্ষার জন্য তিনি মানুষের উপর নির্ভর করেন না বা তার প্রয়োজনীয়তা নেই, এই সহজ বিষয়টি আমরা বুঝতে চাচ্ছি না। তাই সবশেষে বলা যেতে পারে কাহলিল জিবরানের বলা কথাটি, “তোমার দৈনন্দিন জীবন তোমার উপাসনালয় এবং তোমার ধর্ম।”

পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের ভেতর মানুষ জাগ্রত হোক।

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।