শিবলী নোমান
গত ২০ জানুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প শপথ গ্রহণ করলেন। তাঁর শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়েই হয়ত অনেকের এই বিশ্বাসের অবসান হলো যে শেষ পর্যন্ত যেভাবেই হোক ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না। আজ থেকে আড়াই মাস আগেও বিভিন্ন জরিপ ও মিডিয়ার প্রচারণার কারণে এটি বিশ্বাস করা কঠিন ছিল যে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনে জিততে পারেন। জয়ের জন্যে প্রয়োজনীয় ২৭০টি ইলেক্টোরাল কলেজ অর্জনের পরও বিভিন্নভাবে পরিসংখ্যানের মাধ্যমে বারবার দেখানো হয়েছে কিভাবে ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হওয়া আটকে দেয়া যায়। সেসব পরিসংখ্যানকে নিছক ‘কাগুজে’ পরিণত করে এই মূহুর্তে ডোনাল্ড ট্রাম্প পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর সাদা বাড়িতে অবস্থান করছেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্প বা নির্বাচনে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীদের ভিতর কে বেশি ভালো প্রার্থী ছিলেন তা নিয়ে আলোচনার অবকাশ আছে কিনা তার চেয়ে তা নিয়ে আলোচনা প্রয়োজন কিনা সেটি নিয়েই আলোচনা হতে পারে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট যেই হোক, আমি বিশ্বাস করি না যে যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রধান দলের কারোরই তাদের পররাষ্ট্রনীতি পরিবর্তনের কোন আগ্রহ রয়েছে। তাদের সকল প্রকাশ্য বিরোধ আমরা যুক্তরাষ্ট্রের আভ্যন্তরীন ইস্যুগুলো নিয়ে দেখেছি। এর ফলশ্রুতিতেই মার্কিন বিচার ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য খাত বা ওবামা কেয়ার নিয়ে বিতর্কের ফুলঝুঁড়ি ছুটিয়েছিলেন দুই প্রার্থী। কিন্তু ডেমোক্র্যাটদের হার বা রিপাবলিকানদের বিজয়ের ফলেই যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ ও আগ্রাসন বন্ধ হয়ে যাবে তা কল্পনা করা হাস্যকর। আফগানিস্তান ও ইরাক থেকে মার্কিন সৈন্য ফিরিয়ে আনার ইশতেহার দিয়ে হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করা বারাক ওবামার দীর্ঘ আট বছরের শাসনে তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতি পূরণে শতভাগ সফল হতে পারেন নি, কিংবা কখনো হতে চান নি। আর সে জন্যেই ইরাক থেকে সৈন্য ফিরিয়ে আনা হলেও নতুন আতঙ্ক আইএস-এর জুজুর ভয়ে সেখানে কোন না কোনভাবে মার্কিন সেনা উপস্থিতি থেকে গিয়েছে।
তাই আসুন মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি কিংবা জটিল কোন বিষয়ে না ভেবে সহজ চিন্তা করি। ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনী প্রচারণার সময় একের পর এক অভিবাসন, হিস্পানিক, মুসলিম বিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন। এসব বক্তব্যের কারণে তিনি ব্যাপক সমালোচিত হয়েছেন। বাংলাদেশের মানুষের কাছে মোটামুটি ‘খলনায়ক’-এ পরিণত হয়েছেন। কিন্তু তিনিই মার্কিন নির্বচনে জয়ী হয়েছেন। তিনি কম ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট হয়েছেন সে বিষয়ে আলোচনা আপাতত থাকুক কারণ, ট্রাম্পই এক্ষেত্রে একমাত্র উদাহরন নন এবং যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন ব্যবস্থায় এটি হওয়ার সম্ভাবনা সকল নির্বাচনেই থাকে। যেহেতু ট্রাম্প নির্বাচিত হয়েছেন তাই এটি স্পষ্ট যে, যেসব বক্তব্য দিয়ে তিনি ব্যাপক সমালোচিত হয়েছেন, সেসব বক্তব্য তিনি মার্কিন নাগরিকদের ‘পালস’ বুঝেই দিয়েছেন। কোন রাখঢাক না রেখে ট্রাম্প সেই কথাগুলোই বলেছেন যা মার্কিন নাগরিকরা শুনতে চেয়েছে।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণের পর দেয়া প্রথম ভাষণে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের চাকরির বাজারে যুক্ত্ররাষ্ট্রের নাগরিকদের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার অঙ্গীকার করেছেন। সারা পৃথিবীর মানুষ জীবন পরিবর্তন করতে স্বপ্নের দেশ হিসেবে পরিচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রম বাজার সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। কম বেতনে কাজ করতে রাজি হওয়ায় মার্কিনীদের চেয়ে অভিবাসীদের কাজ দেয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। মার্কিন নাগরিকরা এই অবস্থার উত্তরণ চেয়েছে। তারা তাদের দেশে তাদের চাকরি ফিরে পেতে চেয়েছে। ট্রাম্প ঠিক সেই অঙ্গীকারটিই করেছেন।
ট্রাম্প আরো বলেছেন ইসলামি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার কথা। এটিও জনগনের ‘পালস’ বুঝে বলা হয়েছে। ডেমোক্র্যাটরা মুসলিম ভোট ব্যাংক বাঁচাতে মুসলিম বিদ্বেষী মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকলেও ট্রাম্প তা করেন নি। মূলত ৯/১১-এর পর যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বব্যাপী মুসলমান ও ইসলাম ধর্মের যে উপস্থাপন হয়েছে তার সঠিক ব্যবহার করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ৯/১১ পরবর্তী ঘটনাগুলোর বিভিন্ন ব্যাখ্যার অন্যতম হলো, সব ঘটনাই মার্কিনীদের দীর্ঘ পূর্বপরিকল্পনার পর বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এসব তত্ত্ব ও ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নিয়ে বিতর্ক চলতেই থাকবে। কিন্তু এসব ঘটনার ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক পরিবার বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের স্বজনদের হারিয়েছে। বারংবার প্রচারণার ফলে তাদের বিদ্বেষটা কিন্তু কোন না কোনভাবে মুসলমান ও ইসলাম ধর্মের উপরই বর্তিয়েছে। তাই ডোনাল্ড ট্রাম্প এক্ষেত্রেও সঠিকভাবে জনগনকে প্রভাবিত করেছেন।
ট্রাম্প তাঁর প্রথম ভাষণে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন সব দেশের সবার আগে তাঁর নিজের স্বার্থ নিয়ে ভাবা উচিত। এখন পর্যন্ত ট্রাম্প তাঁর সকল বক্তব্যেই সবার আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ নিয়ে আলোচনা করেছেন। একই সাথে সকল খাতে পরিবর্তনের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আবারো মহান রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম ভাষণের পর তাই এক ধরণের ভবিষ্যদ্বাণী করা যেতে পারে। যদি ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বৈধ মার্কিন নাগরিকদের তাদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে পারেন তাহলে অন্তত আগামী বার বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিশ্চিতভাবেই ক্ষমতায় থাকবে রিপাবলিকানরা। কিন্তু যদি ট্রাম্পের এসব অঙ্গীকার অন্তঃসারশূণ্য হিসেবে প্রতীয়মান হয় তাহলে পরের নির্বাচন থেকে ষোল বছরের জন্যে ডেমোক্র্যাটদের হাতে ক্ষমতা চলে যাওয়ার সম্ভাবনা ফেলে দেয়া যায় না।