শিবলী নোমান
পশ্চিমা দেশগুলোর নির্বাচনী সংস্কৃতির যে দিকগুলোর প্রতি আমাদের আগ্রহ জন্মায় বা যেসব সংস্কৃতি আমরা আমাদের দেশেও দেখতে চাই তার তালিকা করা হলে নির্বাচনের প্রার্থীদের মুখোমুখি বিতর্ক আয়োজন করার বিষয়টি হয়ত বেশ উপরের দিকে থাকবে। যদিও আমাদের দেশে যে ধরণের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিদ্যমান, সেখানে এ ধরণের বিতর্কের আয়োজন করলে তার সমাপ্তি কোথায় এবং কিভাবে হবে আর সমাপ্তি হলে তা আদৌ শান্তিপূর্ণ হবে কিনা তা নিয়ে হাস্যরস কিংবা দুশ্চিন্তার অবকাশ থেকে যায়। সবচেয়ে বড় কথা হল, আমাদের দেশে এই ধরণের সংস্কৃতি গড়ে তোলার কোন প্রয়াস বা সেই প্রয়াসের কোন আভাস আমাদের সামনে নেই। তাই চলুন আরেকবার মিডিয়ার ‘এজেন্ডা সেটিং’-এর বলি হয়ে আমরাও হিলারি-ট্রাম্প নির্বাচনী বিতর্ক নিয়ে কথা বলি।
গত মঙ্গলবার ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনের প্রধান দুই প্রার্থীর ভিতর প্রথম বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। ধারণা করা হচ্ছে প্রায় ১০কোটি মার্কিন নাগরিক এই বিতর্ক উপভোগ করেছেন। দেশটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলেই হয়ত দেশ, কাল বা জতিসত্ত্বার সীমানা বিলীন করে আর সব দেশের মত আমাদের দেশেও বিতর্কের দিন এবং তার পরের দিন গণমাধ্যমগুলোর কনটেন্টের বড় স্থান জুড়ে ছিল এই বিতর্ক। বিতর্ক চলাকালীন চালানো জরিপ কিংবা বিতর্ক পরবর্তী জরিপ যাই বলি না কেন সকল জরিপেই এই বিতর্কে জয়ী হিসেবে ডেমোক্রেটিক দলের প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের নাম দেখা গিয়েছে। একই সাথে বিতর্কে খেই হারিয়ে ফেলা থেকে শুরু করে বক্তিগত আক্রমণ ও মেজাজ হারানোয় হয়ত এখন হতাশায় ভুগছেন ট্রাম্পের সমর্থকগণ। নির্বাচনের আগে আরো দুই দফা বিতর্ক এখনো বাকি। তারপরও প্রথম বিতর্কের ফলাফলের ভিত্তিতে যেই প্রশ্নটি উঠে আসছে বারংবার তা হল, ট্রাম্প কি হেরে গেলেন? নাকি হেরে যাচ্ছেন?
বছর দুয়েক আগেও ডোনাল্ড ট্রাম্পের রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়াকে অনেকে অসম্ভব ভেবেছেন। মার্কিনীরাই এটি ভেবেছেন। তারা ট্রাম্পকে নিয়ে হাসি-তামাশা করেছেন। কিন্তু ট্রাম্প এখন এমন এক বাস্তবতা নিয়ে হাজির হয়েছেন যেখানে তাকে নিয়ে হাসি-তামাশার অবসান না হলেও তাকে অস্বীকার করার আর কোন উপায় তিনি বাকি রাখেন নি। যুদ্ধের পক্ষে নিজের অবস্থান, নারীদের প্রতি কটুক্তি, অভিবাসন ও অন্যধর্মের প্রতি বিরোধী মনোভাবের কারণে নিন্দিত হয়েছেন বলেই কি আমরা সুদূর বাংলাদেশে বসেও ডোনাল্ড ট্রাম্প নামক এই স্বর্ণকেশীকে অপছন্দ করি? উত্তরটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয়ত ‘হ্যা’ হবে। কিন্তু তারপরও কথা থেকে যায়। ট্রাম্পের এসব নীতির বিপক্ষে সমালোচনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই তো কম হয় নি। তারপরও ট্রাম্প অন্যান্য মনোনয়ন প্রত্যাশীদের পিছনে ফেলে রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হয়ে গিয়েছেন। তবে এর ভিতর অনেকে ষড়যন্ত্র তত্ত্বও হয়ত খুঁজে পান। যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী একজন বাংলাদেশী আমাকে বলেছিলেন ট্রাম্পের সাথে হিলারির সুসম্পর্ক বেশ পুরনো এবং ট্রাম্প হিলারিকে প্রেসিডেন্ট করার জন্যেই রিপাবলিকান মনোনয়ন প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন। এর প্রমাণ হিসেবে তিনি বলেছিলেন যে, মনোনয়ন নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পর ট্রাম্পকে আর আগের মত আক্রমণাত্মক হতে দেখা যায় নি খুব বেশি। এটি নিছক কল্পনাপ্রসূতও হতে পারে। কিন্তু অকাট্য সত্য হল, ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন নাগরিকদের ‘পালস’ বুঝে তার মতামত প্রচার করেছেন। সম্প্রতি যুক্তরষ্ট্রের যে বাস্তবতা তাতে দেখা যায় যে, যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসিত নাগরিকদের সংখ্যা আর অল্প সময়ের ভিতর যারা প্রকৃতপক্ষেই মার্কিন নাগরিক তাদের চেয়ে বেড়ে যাবে। ফলে নিজেদের দেশে মার্কিন নাগরিকরাই হয়ে যাবেন এক ধরণের সংখ্যালঘু গোষ্ঠী। এসবের সাথে সাথে নিয়ত বর্ধমান অভিবাসীদের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক সেবার মানও আগের মত থাকছে না যা স্পষ্টভাবেই মার্কিন নাগরিকদের চোখে পড়ছে। অভিবাসন বিরোধীতার হুজুগ তুলে যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে বেরিয়া আসা (ব্রেক্সিট) ডোনাল্ড ট্রাম্পের পালেই হাওয়া দিয়েছে বলে তখনই মনে হয়েছিল।
আমি মূলত বলতে চাচ্ছি যে, চিলকট কমিশন যতই বলুক ইরাক যুদ্ধ ছিল অপ্রয়োজনীয় কিংবা যুদ্ধটি ছিল যুদ্ধাপরাধ, মার্কিন নাগরিকদের ইরাক নিয়ে চিন্তার আগে নিজেদের মৌলিক বিষয়াদি নিয়ে চিন্তাই বেশি। এটি শুধু মার্কিন নাগরিক নয় বরং সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। সেক্ষেত্রে অভিবাসন বিরোধী মনোভাব এবং চলমান বাস্তবতায় অন্য ধর্ম, মূলত ইসলাম বিদ্বেষ প্রকাশ করে ট্রাম্প নিজেকে অনেক মার্কিনীর কাছে নিয়ে গিয়েছেন তা স্বীকার করতেই হবে।
অন্যদিকে ট্রাম্প বা হিলারি কারো বিজয়েই আমি খুশি বা অসন্তুষ্ট হবো না ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ পর্যন্ত আমি জানতে পারবো না যে কে প্রেসিডেন্ট হলে সিরিয়ায় আর ওমরান দাকনিশকে রক্তাক্ত দেখতে হবে না, কে প্রেসিডেন্ট হলে মৃত পড়ে না থেকে নিজের দেশের সমুদ্র সৈকতে খেলতে দেখা যাবে আয়লান কুর্দিকে, কে প্রেসিডেন্ট হলে নিজের স্বার্থে হাজার হাজার সাধারণ মানুষের জীবন শেষ করে দেয়া হবে না। ডেমোক্রেট পার্টীর প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন সময়েই এসব ঘটনা ঘটেছে তাই হিলারি আসলে এর পরিবর্তনের তেমন কোন সুযোগ বা আভাস এখনো দেখা যায় নি। আর ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্য শুনে এসব আশা করাই অপরাধ বলে মনে হতে পারে। বিশ্বশান্তির জন্যে যে ধরণের মানবিকতা বোধসম্পন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রয়োজন সে ধরণের প্রার্থী এই নির্বাচনে আদৌ আছেন কিনা তা নিয়েই আলাদা বিতর্ক চলতে পারে।
ট্রাম্পের প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। আমার মনে হয় না প্রথম বিতর্কে হেরে গিয়েছেন বা পিঁছিয়ে পড়েছেন বলে ট্রাম্পের বিজয়ের সম্ভাবনা কমে গিয়েছে। ২০০৮ ও ২০১২ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচন নিয়ে অত্যন্ত সফল ভবিষ্যদ্বাণী করা মার্কিন প্রতিষ্ঠান ‘ফাইভ থার্টি এইট’ এ বছর হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এটি ঠিক যে ব্যাপক সংখ্যক মার্কিন নাগরিক ট্রাম্পের উপর বিরক্ত। তিনি নির্বাচিত হলে সেটিও হয়ত আশ্চর্য কিছু হবে অনেকের কাছে। কিন্তু আশ্চর্য বিষয়ের ভিতরই তো আমরা প্রতিনিয়ত ঘুরপাক খাচ্ছি। মার্কিন নির্বাচন পদ্ধতিতে ছোট ছোট অঙ্গরাজ্যগুলোর ফলাফল বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নিরপেক্ষ ভোটারদের সমর্থন। নিরপেক্ষ ভোটারদের মতামতও যদি অভিবাসন বিরোধী কিংবা ইসলাম বিদ্বেষী হয়ে থাকে, তাহলে ট্রাম্পের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। তাই এখনই বলতে রাজি নই যে ট্রাম্প হেরে গিয়েছেন। বরং হোয়াইট হাউজে এই স্বর্ণকেশীকে চার বছরের জন্যে প্রবেশ করতে দেখলেও খুব বেশি অবাক হওয়ার কিছু নেই।