শিবলী নোমান
১৩ নভেম্বর, ২০১০, শনিবার
সকাল ১০টায় নিচে যাওয়ার কথা, যেখান থেকে আমাদেরকে চিবা চ্যাপ্টারে নিয়ে যাওয়া হবে। তাই আজও সকাল আটটায়ই উঠে গেলাম, কারণ লাগেজ গুছিয়ে ফেলতে হবে। ঘুম থেকে উঠে দেখি জালু ঘরে নেই, আর জালুর কোন জিনিসও নেই। বুঝতে পারলাম ওরা হিরোশিমার উদ্দেশ্যে চলে গিয়েছে।
আমি আগে জাফর ভাইয়ের রুমে গেলাম। দরজা খুললেন তিলক স্যার। বললাম জাফর ভাই আছে কি না, তিনি বললের জাফর ভাই নামাজ পড়ছেন। আমি তাকে বললাম নামাজ হলে যেন তাকে বলে শিবলী এসেছিল। সে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “শিবলী ফ্রম হয়্যার?” আমি অদ্ভুত মুখভঙ্গি করে বললাম, “ফ্রম বাংলাদেশ।” এ কথা বলার পর তিলক স্যার আর আমি দুই জনই হেসে দিলাম।
এরপর রুমে গিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। আমার আসলে জাফর ভাইয়ের সাথে নাস্তা করার ইচ্ছা ছিল। আগেরদিন একা একা নাস্তা করতে ভালো লাগে নি। একটু পর জাফর ভাইয়ের রুমে ফোন দিলাম। তিলক স্যারই ফোন ধরলেন আর জাফর ভাইকে দিলেন। জাফর ভাইকে বললাম নাস্তা করতে যাবে কি না। তিনি জানালেন নাস্তা করবেন না। আমি এরপর সূচনা আপুকে ফোন দিলাম। তাকে কোন প্রস্তাব না দিয়ে সরাসরি বললাম নিচে আসতে নাস্তা করতে। আমি চাচ্ছিলাম না সে মানা করার কোন সুযোগ পাক আর আমার আজও একাই খেতে হোক।
যাই হোক, আমরা একসাথে নাস্তা করলাম। আজও আগের দিনের মতো পাউরটি, ডিমের সেদ্ধ কুসুম খেলাম, সাথে কফি। কিন্তু আজকে পাউরুটিটা কিসমিস আর মোরব্বায় ভরা ছিল। খেলেই বমি আসছিলো। তাই বেশি করে ডিমের কুসুম খেয়ে নিলাম। কফি নিয়ে আসার সময় বুঝতে পারলাম সাধারণ পাউরুটির পাশেই মোরব্বা দেয়া রুটি রাখা হয়েছে। আমি পাউরুটি ভেবে ভুল করে সেই মোরব্বা দেয়া রুটি নিয়ে নিয়েছিলাম। আর সে কারণেই আমার এই বেহাল দশা!
নাস্তা শেষে আমরা নিজেদের রুমে গেলাম, আর সূচনা আপুকে বলে দিলাম সাড়ে নয়টার ভেতর সবকিছু নিয়ে প্রস্তুত থাকতে, যেন আমরা সময়মতো বের হতে পারি। রুমে এসে আমি আমার লাগেজ গুছিয়ে তৈরি হয়ে নিলাম। সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট, কালো জুতা। সাথে কালো সোয়েটার, তার উপর জ্যাকেট, আর মাথায় একটা মাংকি ক্যাপ, ঠান্ডায় কান ঢাকার জন্য। জাপানে শীতকাল মাত্র শুরু হয়েছে, কিন্তু আমার জন্য এই শীতটাও খুব কম নয়।
সাড়ে নয়টার একটু আগে সূচনা আপু ফোন দিয়ে জানালেন তিনি প্রস্তুত আছেন, এখন কী করবেন। বললাম আমিও প্রস্তুত, কিন্তু নিচে নামার সময় হয়নি। তিনি বললেন তিনি সব নিয়ে আমার রুমে চলে আসবেন কিনা। আমি জানালাম তাতে কোন সমস্যা নেই। তিনি উপর থেকে সব নিয়ে আমার রুমে চলে আসলেন। কিছুক্ষণ কথা বলার পর তিনি আমার বেডে হেলান দিয়ে একটু বিশ্রাম নেয়ার ভঙ্গি করলেন। আমি তাকে আর বিরক্ত না করে একটা চেয়ারে বসে কিছুক্ষণ টিভি দেখলাম। ঠিক দশটার সময় আমরা নিচে নামলাম।
ততক্ষণে জাফর ভাইও সব নিয়ে নিচে নেমে গিয়েছেন। আমাদের জন্য বাইরে অপেক্ষা করছিল রিকা ও মিয়ো। আর চিবা চ্যাপ্টারের রেড ক্রস কর্মকর্তারাও চলে এসেছিলা আমদেরকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। টোকিওর ঠিক পাশের চ্যাপ্টার বলে আমরা গাড়িতে করেই চিবায় যাবো। চিবা রেড ক্রস থেকে আমাদের জন্য একটি মাইক্রোবাস পাঠানো হয়েছে। আমরা গাড়ির পেছনে আমাদের সব লাগেজ আর ব্যাগ রেখে দিলাম।
চিবা রেড ক্রসের মারিকো হিরাই, ফুমিকো ও তাকানো; তিনজন এসেছিল আমাদেরকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এর ভেতর তাকানো ছিল ল্যাঙ্গুয়েজ ভলান্টিয়ার। তার বয়র ৬৫ এর উপর হবে, খেয়াল করলাম তার হাত সবসময় কাঁপতে থাকে। অন্যদিকে ফুমিকো মাঝবয়সী মহিলা, সম্ভবত চিবা রেড ক্রসে চাকরি করে। আর মারিকো হিরাইকে দেখে বয়সে তরুণী মনে হলো, ছোট-খাটো শরীর, তার চেয়েও ছোট ছোট চোখ আর রেশমি কালো চুল, যদিও খুব লম্বা নয়।
আমরা আমাদের হোটেলের বাইরে সবাই মিলে কিছু ছবি তুলে রওনা হয়ে গেলাম। আমি টোকিও টাওয়ারের একটা ছবি তুললাম, যদিও রাতের টোকিও টাওয়ার আর দিনের টোকিও টাওয়ারের ভিতর তফাতটাও রাত-দিনের মতোই। রাতের টোকিও টাওয়ার অনেক সুন্দর, অনেক বেশি সুন্দর।
টোকিও টাওয়ারের উচ্চতা ৩৩২.৯০ মিটার। ১৯৫৮ সালে টেলিভিশন যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের চিন্তা থেকেই টোকিও শহরের মিনাটো জেলায় এই টাওয়ারের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। এই টাওয়ারটি দেখতে আইফেল টাওয়ারের মত। বিমান চলাচলের কথা বিবেচনা করে এই টাওয়ারের রঙ করা হয়েছে সাদা ও ইন্টারন্যাশনাল অরেঞ্জ রঙ দিয়ে। প্রতি পাঁচ বছর পর পর এই টাওয়ার নতুন করে রঙ করা হয়। যে পদ্ধতিতে টাওয়ারটি রঙ করা হয় তাতে সময় লাগে প্রায় এক বছর। টাওয়ারটি নির্মাণের পর থেকে সারা পৃথিবীর প্রায় পনেরো কোটি পর্যটক এই টাওয়ারের সৌন্দর্য অবলোকন করতে এখানে এসেছেন বলে ধারণা করা হয়।
টোকিও টাওয়ার নির্মাণের সময় পরিকল্পনা করা হয়েছিল এমন একটি টাওয়ার নির্মাণ করা হবে, যেটির উচ্চতা হবে নিউ ইয়র্কের এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিঙের চেয়ে বেশি। কিন্তু সেরকম একটি টাওয়ার নির্মাণের জন্যে প্রয়োজনীয় খরচ ও যন্ত্রপাতির অভাব দেখা দেয়ায় সেই লক্ষ পূরণ হয় নি।
এই টাওয়ারের ঠিক নিচেই রয়েছে ‘ফুট-টাউন’ নামে চার তলা একটি দালান, যেখানে রয়েছে জাদুঘর, রেস্তোরাঁ ও দোকান। ১৫০ মিটার উচ্চতায় রয়েছে দ্বিতল পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র আর ২৪৯.৬০ মিটার উচ্চতায় রয়েছে আরো একটি বিশেষ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র। নির্মাণের পর থেকে এটিই জাপানের সবচেয়ে উঁচু টাওয়ার। কিন্তু আমরা যে সময় জাপানে এসেছি তখন টোকিওতেই ৬৩৪ মিটার উচ্চতার আরেকটি টাওয়ার নির্মাণের কাজ চলছে। এই টাওয়ারের নাম ‘স্কাই-ট্রি’। টোকিও টাওয়ার দিয়ে টেলিস্ট্রিয়াল পদ্ধতিতে সম্প্রচারে সমস্যা হওয়াতেই এই নতুন টাওয়ার নির্মাণ করা হচ্ছে। নতুন টাওয়ারটিকে স্থানীয়রা ‘টিভি টাওয়ার’-ও বলে থাকে।
যাই হোক, আমরা চিবার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। চিবা প্রিফ্যাকচারাল চ্যাপ্টার টোকিওর ঠিক পাশেই। এটি জাপানের কেনতো রিজিয়ন ও গ্রেটার টোকিও এলাকায় পড়েছে। ৬২ লাখ মানুষের জনসংখ্যা নিয়ে জনসংখ্যার দিক থেকে এটি জাপানের ৬ষ্ঠ বৃহৎ প্রিফ্যাকচার, আর ৫,১৫৬ বর্গ কিলোমিটার নিয়ে আয়তনের দিক থেকে ২৭তম। চিবা জেলা বা প্রিফ্যাকচার ঢাকার তুলনায় প্রায় ১৭ গুণ বড়, কিন্তু তার জনসংখ্যা ঢাকার থেকে কম। মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে চিবা শহরটি আধুনিক হয়ে উঠেছে। এছাড়া বেশ কয়েকবার ভূমিকম্পে বিপর্যস্তও হয়েছে এই চিবা। জাপানের নারিতা বিমানবন্দর চিবাতেই অবস্থিত।
জাপানে মোট ৪৭টি প্রিফ্যাকচার রয়েছে। প্রিফ্যাকচার শব্দটি এসেছে পর্তুগিজ শব্দ ‘প্রিফেইচুরা’ থেকে, যার অর্থ প্রদেশ বা মিউনিসিপ্যালিটি। তবে আমাদের দেশের হিসাবে আমরা প্রিফ্যাকচারগুলোকে মূলত বিভাগ বলতে পারি কারণ প্রতিটি প্রিফ্যাকচার আবার শহর বা সিটি এবং জেলা বা ডিস্ট্রিক্টে বিভক্ত; জেলাগুলো আবার টাউন ও গ্রামে বিভক্ত। ৪৭টি প্রিফ্যাকচারের ভেতর ৪৩টি সাধারণ প্রিফ্যাকচার রয়েছে, জাপানি ভাষায় এদের বলা হয় ‘কেন্’। ওসাকা ও কিয়োটো হলো দুইটি আরবান প্রিফ্যাকচার যাকে বলা হয় ‘ফু’, হোক্কাইডো হলো একটি সার্কিট প্রিফ্যাকচার যা জাপানিদের কাছে ‘দো’ নামে পরিচিত এবং টোকিও হলো একমাত্র মেট্রোপলিটন প্রিফ্যাকচার যাকে বলা হয় ‘তো’।
১৮৬০ এর দশকে জাপানে মেইজি সরকার গঠিত হলে ১৮৭১ সাল থেকে প্রিফ্যাকচার পদ্ধতিতে জাপানকে বর্তমানের ন্যায় ৪৭টি প্রিফ্যাকচারে ভাগ করা হয়। এর আগে জাপানকে ভাগ করা হত প্রাদেশিকভাবে। তখন জাপানে ৬৮টি প্রদেশে ৩০৪টি প্রিফ্যাকচার ছিল। বর্তমানে প্রচলিত প্রিফ্যাকচার পদ্ধতিতে একটি প্রিফ্যাকচারে প্রধান নির্বাহী হিসেবে থাকেন একজন গভর্নর, যিনি প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হন। জাপানের প্রিফ্যাকচারগুলো কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে কাজ করে, কারণ জাপান একটি ইউনিটারি পদ্ধতির রাষ্ট্র, তবে পুলিশ ব্যবস্থাপনা ও শিক্ষার মতো বিষয়গুলোতে প্রিফ্যাকচারের উপর কেন্দ্রীয় সরকার হস্তক্ষেপ করে না।
যাই হোক, গাড়িতে বসে আমরা টোকিও শহরটা দেখছিলাম। কখনো উঁচু উঁচু সব দালান, কখনোবা নদীর উপর সেতু। অবাক হয়ে দেখলাম দুই পাশে কেমন জানি বেড়ার মতো দিয়ে সেতুগুলোকে বড় বড় নৌকার মতো বানানো হয়েছে, রাস্তাকে আগলে রাখার মতো। এটার কারণ কী বুঝলাম না। কাউকে জিজ্ঞেসও করলাম না, যদিও তা করা উচিত ছিল।
হঠাৎ মারিকো পেছনে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, “এনি পুরোবলেমো?” আমি বললাম, “নো, এভরথিং ইজ ওকে।” ও একটা সুন্দর হাসি দিলো। আর জাফর ভাই বললেন, “নো পুরোবলেমো।” দেড় ঘণ্টার মতো গাড়ি চালানোর পর মারিকো আমাদেরকে ওর ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে জানালো আমাদের পরিকল্পনায় একটু পরিবর্তন আছে। রাস্তায় যেহেতু দেরি হচ্ছে তাই আমাদের ব্রিফিং প্রোগ্রামটা ও গাড়িতেই সেরে নিলো। এরপর বললো আমরা আগে কোথাও নেমে দুপুরের খাবার খেয়ে নিবো। তারপর আজকে যা যা করার, একে একে করা যাবে।
মারিকোর কথা অনুযায়ী আমরা একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকলাম। আমাদেরকে জিজ্ঞেস করা হলো আমরা কী খাবো। জাফর ভাই বললেন তিনি ভাত খাবেন। অর্থাৎ জাপানের সেই বিখ্যাত আঠা আঠা ভাত। আমিও বললাম আমিও খাবো ভাত, আর সাথে চিকেন কারি। সূচনা আপুও তাই। আর মারিকোরা ন্যুডলস জাতীয় কিছু একটা খেলো। খেয়ে বের হয়ে আমরা পাশের একটা মার্কেটে গেলাম। ঘুরে দেখা ছাড়া আমাদের অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিল না। মার্কেটে ঢুকে বুঝলাম এটা ইলেকট্রনিক জিনিসের মার্কেট। ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন, টিভিতে পুরো মার্কেট সয়লাব। আর আসলে এটা কোন মার্কেট নয়, বরং একটা মাত্র বিশাল আয়তনের দোকান। আমরা সেখানে কিছু ছবি তুলে আবারও রওনা হলাম।
এরপর আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হলো নারিতা রেড ক্রস হাসপাতালে। বাংলাদেশের ঢাকা ও চট্টগ্রামে রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতাল আছে। ঢাকার হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল হলো রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতাল। তেমনি নারিতা রেড ক্রস হাসপাতালে আমাদেরকে নিয়ে আসা হলো হাসপাতালটি দেখানোর জন্যে। এই হাসপাতাল আর আমাদের দেশের হাসপাতালে কোন মিল খুঁজে পেলাম না। আমাদের দেশের হাসপাতালে সারাদিন হৈ-হল্লা লেগে থাকে, কেউ না কেউ সব সময় হাসপাতালে আসে যায়। কিন্তু নারিতার এই হাসপাতালটি অদ্ভুত রকম শুনশান।
আমাদেরকে পুরো হাসপাতালটি দেখানো হলো। দেখানো হল হাসপাতালের নিজস্ব হেলিকপ্টার ও হেলিপ্যাড। অবশেষে একটা লম্বা করিডোরের এক প্রান্তে আমরা একজন রোগীকে নিয়ে কিছুটা ছোটাছুটি দেখলাম। কিন্তু সেখানে রোগীর কোন আত্মীয়কে দেখতে পেলাম না। আমাদেরকে হাসপাতালের ছাদের নিয়ে যাওয়া হলো। ছাদ দেখে তো আমার মাথা খারাপ! হঠাৎ করে কাউকে এখানে নিয়ে এসে চোখ খুলে দিলে কেউ বলতে পারবে না যে সে একটা দালানের ছাদে আছে। পুরো ছাদে বাগান করা হয়েছে, আর বসার জন্য বেঞ্চ পাতা হয়েছে। সেখানে হাসপাতালে আগতরা বসে আছে আর উপভোগ করছে হাজার হাজার ফুলের কৃত্রিমভাবে তৈরি করা এই সৌন্দর্য।
আমরা এখানে কিছু ছবি তুলে হাসপাতালের নিচে আসলাম। আমাদের চারপাশে হাসপাতাল আর রেড ক্রসের কর্মকর্তারা থাকায় আমাদেরকে ভিআইপি মনে হচ্ছিলো। হঠাৎ করে একজন লোক আমাদের ভেতর ঢুকে পড়ে সরাসরি বাংলায় জিজ্ঞেস করলেন আমরা বাংলাদেশি কিনা। আমরা জানালাম আমরা বাংলাদেশি। তিনি বললেন আমাদেরকে দেখে তার মনে হয়েছে আমরা তাকে সাহায্য করতে পারবো। আমরা তার কাছে কী হয়েছে জানতে চাইলাম।
তিনি জানালেন তিনি একটি কানেকটিং ফ্লাইট ধরার জন্য নারিতা এয়ারপোর্টে ছিলেন। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় তাকে এখানে ভর্তি করা হয়। এখন তিনি সুস্থ, কিন্তু হাসপাতালের কেউ ইংরেজি না বোঝার কারণে কাউকে তিনি বোঝাতে পারছেন না যে তিনি হাসপাতাল থেকে রিলিজ নিয়ে বিমানবন্দরে যেতে চান। তিনি আমাদের কাছে এ ব্যাপারে সহায়তা চাইলেন।
আমরা হাসপাতালের কর্মকর্তা ও মারিকোকে বিষয়টি বুঝিয়ে বললাম। ওদের তখন একটু হতাশ দেখালো। কিছুটা দায়সারাভাবেই ওরা জানাও যে বিষয়টা নিয়ে ওরা এখনই কাজ করবে। ওদের এমন আচরণে আমি জাপানিদের চরিত্রের একটি দিক বুঝতে পারলাম। ওরা ওদের উপর দেয়া দায়িত্ব পালনে সব করতে পারে, কিন্তু যেটা তার দায়িত্ব না, সেই কাজ ওরা করতে চায় না। নেহায়েত আমরা ওদের চ্যাপ্টারের অতিথি বলে হয়তো আমাদের কথায় ওরা তেমন কিছু করতে রাজি হয়েছে।
আমি জানি না শেষ পর্যন্ত সেই লোকটিকে আমরা আসলেই কোন সাহায্য করতে পেরেছিলাম কিনা। তার নামও আমাদের জানা হয় নি, কিন্তু এটি সত্যি যে আমরা যতটুকু পারতাম, তার সবটা দিয়ে চেষ্টা করেছিলাম।
এরপর আমরা আবার একটু হাসপাতালটা ঘুরে দেখলাম। জাফর ভাই ডিজিটাল মেশিনে ব্লাড প্রেশার মাপলেন। আমিও মাপতে চাই কিনা জিজ্ঞেস করলে আমি জানালাম যে আমি সুস্থ আছি, আমার দরকার নেই। হাসপাতাল থেকে আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হলো পাশের নার্সিং স্কুলে। জাফর ভাই জানালেন এই নার্সিং স্কুলের একজন নার্স একবার বাংলাদেশে গিয়েছিলেন। তাই মারিকোরা সেই নার্সকে খুঁজতে শুরু করে দিলো।
একজন নার্স হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে আসলেন। এসে জাফর ভাইকে দেখে খুব কৃতজ্ঞ ভঙ্গিতে হ্যান্ডশেক করলেন। তিনি ইংরেজি জানেন না, কিন্তু আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন তিনি অনেক খুশি হয়েছেন এবং বাংলাদেশিদের প্রতি তিনি কৃতজ্ঞ। আমরা বেশি সময় সেখানে থাকলাম না। বের হয়ে জাফর ভাই আমাকে একটা কথাই বললেন, “সবই ঠিক আছে, কিন্তু এই নার্স তো সে না যাকে আমি খুঁজছিলাম।” আমি আর কিছু বললাম না। মনে হয় এই নার্সও কখনো বাংলাদেশে গিয়েছেন, কিন্তু জাফর ভাইয়ের খেয়াল নেই, অথবা অন্য কারো সাথে তার দেখা হয়েছিল।
নার্সিং স্কুল থেকে বের হয়ে আমরা আবার গাড়িতে উঠলাম। গাড়িতে মারিকো আমাদের জানালো এখন আমাদেরকে একটি মন্দির দেখাতে নিয়ে যাবে। আমরা জানতে চাইলাম বৌদ্ধ মন্দির কিনা। তখন তাকানো আমাদেরকে বললেন জাপানের অনেকেই বৌদ্ধ কিন্তু তাদের নিজস্ব একটি ধর্মও আছে, শিনসৌজি ধর্ম। আমাদেরকে নারিতা শিনসৌজি মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
শিনসৌজি ধর্ম জাপানের একটি স্থানীয় ধর্ম, যা অনেকটা লোকায়ত ধর্মের মতো। জাপানের অনেকেই বৌদ্ধ ধর্মের সাথে এই ধর্মকেও অনুসরণ করে। ৮ম শতাব্দীতে এই ধর্মের উদ্ভব হয় এবং মনে করা হয় এই ধর্মের মাধ্যমে জাপানের মানুষরা বর্তমানের সাথে তাদের অতীতের সংযোগ ঘটান। শিনসৌজি শব্দের ‘শিন’ অংশটি এসেছে ‘শিন্ডো’ শব্দ থেকে, যার অর্থ স্পিরিট বা আত্মা। এটি কোন আনুষ্ঠানিক ধর্ম নয়, বরং অনেক বেশি বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাই এর কোন নির্ধারিত নিয়ম-কানুনও নেই। জাপানের শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ কোন না কোনভবে এই ধর্মের সাথে নিজেদের যুক্ত রাখেন।
দেখতে দেখতে আমরা মন্দিরে পৌঁছে গেলাম। মন্দিরটা রাস্তা থেকে বেশ উপরে। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়। সিঁড়ির শেষে মন্দিরের শুরুতে বড় বড় হাড়ির মতো কী জানি ঝুলছে। এগুলো ঘণ্টা হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। আমরা মন্দিরের আশেপাশে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। বড় বড় অনেকগুলো মন্দির এখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কয়েকটি লেক আছে, লেকে মাছ আছে আর লেকের উল্টো পাশে পাথরে খোদাই করে জাপানি ভাষায় বিভিন্ন ধর্মীয় বিষয় লেখা আছে।
মন্দিরের ভেতরে ঢোকার সময় মানুষ ধোঁয়া দিয়ে নিজেদের শরীর পবিত্র করে নেয়। অনেকটা মুসলমানদের ওযূ করার মতো। মারিকো জানতে চাইলো আমরা ধোঁয়া দিয়ে পবিত্র হয়ে ঢুকতে চাই কিনা। আমি মানা করলেও জাফর ভাই ও সূচনা আপু সেটা করতে চাইলেন এবং মারিকো তাদেরকে দেখিয়ে দিল কীভাবে কী করতে হবে। সূচনা আপু সবকিছু চুপচাপ করলেও জাফর ভাই একেকবার ধোঁয়া নেন আর মুখে বলেন, “আল্লাহ, তুমি মাফ কইরা দিয়ো; আল্লাহ, তুমি মাফ কইরা দিয়ো!”
মন্দিরের ভেতরে তেমন কোন বড় মূর্তি ছিল না, যেমনটা আশা করেছিলাম। ছোট একটি জায়গায় ফুল দিয়ে সাজানো বেশ ছোট আকারের একটি লম্বা মূর্তি ছিল, সেটি কোন মানুষের মূর্তি নয়। কিন্তু সেটি আসলে কিসের মূর্তি আমি বুঝতে পারি নি, তবে তুলনা করতে হলে হিন্দুদের শিবলিঙ্গের সাথে এর কিছুটা মিল রয়েছে, যদিও এর রঙ ততটা কালো নয়।
মন্দিরটিতে অনেক গাছ ছিল। তাকানো আমাকে একটি গাছ দেখিয়ে বললেন ঐ জাতের একটি গাছের নিচেই নাকি গৌতম বুদ্ধ সাধনা করতেন। আমি গাছটা দেখলাম, গাছের পাতাগুলো কমলা রঙের, খুব বড় গাছ নয়, তবে দেখতে খুবই সুন্দর।
মন্দির থেকে বের হয়ে বাইরে কিছুক্ষণ বসে থাকলাম। তখন সন্ধ্যা হয়ে আসছিল। আমরা আবার রওনা হলাম। আমাদেরকে চিবা শহরের একটা রক্তদান কেন্দ্র দেখানো হলো। সেই রক্তদান কেন্দ্র আর আমাদের দেশের রক্তদান কেন্দ্র যেমন পুরো আলাদা, তেমনি সেখান রক্ত নেয়ার পদ্ধতিও আলাদা। পুরোপুরি অটোমেটেড পদ্ধতিতে সেখানে রক্ত নেয়া হয়। মারিকো জানতে চাইলো আমরা কেউ রক্ত দিতে চাই কিনা। কথাটি বলেই হেসে দিয়ে বললো, “জাস্ট কিডিং!”
রক্তদান কেন্দ্র থেকে বের হয়ে মারিকো আমাদেরকে নিয়ে গেলো একটি ফাস্টফুডের দোকানে। আমাদের কাছে জানতে চাইলো আমরা রাতের খাবারের জন্য কী খেতে চাই। আমি আমার জন্যে চিকেন আর বার্গার নিলাম, সাথে ড্রিংকস। মারিকো আমাকে জিজ্ঞেস করল আমি চিকেন আর কোকাকোলা পছন্দ করি কিনা। আমি বললাম, “আই লাভ দোজ!” মারিকো আবারও তার সবগুলো দাঁত বের করে হেসে দিলো।
আমাদেরকে খাবার কিনে দিয়ে মারিকো আমাদেরকে আমাদের হোটেলে নিয়ে আসলো। এই হোটেলের নাম বার্ডি হোটেল। হোটেলের নবম তলায় পাশাপাশি রুমে ছিলাম আমি আর সূচনা আপু, আর জাফর ভাইয়ের রুম ছিল পাঁচ তলায়, কারণ তার রুমটি ছিল স্মোকিং রুম। আমরা মারিকোকে বিদায় দিয়ে আমাদের রুমে এসে দেখি রুমের আকার খুবই ছোট। রুমটা আমরা ঢোকার সাথে সাথেই শেষ হয়ে যায়।
যাই হোক, ফ্রেশ হয়ে গোসল করে বের হয়ে সূচনা আপুকে ফোন দিয়ে বললাম আমার রুমে তার বানানো কার্ড নিয়ে আসতে। আসলে পরদিন থেকে আমরা বিভিন্ন চিবার বিদ্যালয়য় আর বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবো, সেখানকার শিক্ষার্থীদের সাথে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের অংশ হিসেবে আমরা বিভিন্ন কার্ড বানিয়ে এনেছিলাম। ভাবলাম সেই কার্ডগুলো এখন ভাগ করে ফেলবো। কারণ আগামীকাল থেকেই সেগুলো প্রয়োজন হবে। চট্টগ্রাম থেকে তৈরি করে আনা কার্ড নিয়ে সূচনা আপু আমার রুমে চলে আসলো। আমি আমাদের বানানো কার্ডগুলো বের করলাম। এরপর যতগুলো জায়গায় দিতে হবে, সেভাবে ভাগ করে নিলাম।
এমন সময় রুমের ফোন বেজে উঠলো। ফোন ধরে ওপাশে জাফর ভাইয়ের গলা শুনতে পেলাম, আমাকে তার রুমে যেতে বললেন। সূচনা আপুকে আমার রুমে রেখেই আমি তার রুমে গেলাম। তিনি বললেন তার লিফটে উঠতে ভয় লাগে, লিফট আটকে যাবে এই ভয় পান, আমি কীভাবে এত তাড়াতাড়ি লিফটে করে চলে আসি। আমি শুধু হাসলাম। তিনি বললেন এই হোটেলে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে, কারণ এখানে রুম অনেক ছোট। নামায পড়ার জায়গারও অভাব, তিনি আমাকে বললেন একটু জেনে দিতে যে পশ্চিম দিকটা কোনদিকে।
আমি নিচে রিসেপশনে গিয়ে জানতে চাইলাম। রিসেপশনের লোকেরা আমাকে একটি ম্যাপে উত্তর দিক দেখিয়ে বলে দিল কোনদিকে পশ্চিম হবে। আমি আবারও জাফর ভাইয়ের রুমে গিয়ে তাকে দেখিয়ে দিলাম পশ্চিম দিক। তখন জাফর ভাই আমার হাতে দুইটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বললেন এগুলো নাকি মারিকো দিয়ে গেছে, কারণ সে মনে করেছে আমরা রাতের জন্য যে পরিমাণ খাবার নিয়েছি তাতে আমাদের হবে না। ও আবার এসে নিজে থেকেই কিছু চকোলেট আর বিস্কিট দিয়ে গেছে। আমি পাকেট দুইটা নিয়ে একটা সূচনা আপুকে দিয়ে দিলাম, সূচনা আপু তার রুমে চলে গেলো।
মারিকোর দেয়া প্যাকেটের উপর লেখা ছিল, “ফ্রম মারিকো।” ভেতরে কিছু চকোলেট আর অনেকগুলো বিস্কিট।
রাতের খাবার খাওয়ার সময় আবার ফোন বেজে উঠলো, এবার দেশ থেকে আম্মুর গলা শুনতে পেলাম। আমরা যে হোটেলেই থাকি, জাফর ভাই ঢাকায় তার বাসায় সেই হোটেলগুলোর নাম্বার দিয়ে, দেন আর সেখান থেকে আমার বাসায় এই নাম্বারগুলো পাচার হয়ে যায়। তাই আমি যেখানেই থাকি না কেন বাসা থেকে ফোন আসেই। কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রেখে দিলাম। এরপর ঘুমের জন্য তৈরি হলাম। কাল সকাল থেকেই আবার বিভিন্ন জায়গায় যেতে হবে।
স্যার,
আপনার লেখা খুব চমৎকার এবং ইন্টারেস্টিং। পাঠককে খুব সহজেই আপনার লেখায় আটকে ফেলতে পারেন। জাপানে ভ্রমণের উপর একটা ভ্রমণকাহিনিমূলক বই প্রকাশ করে ফেলেন। 🥰
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
আসলে আমার এই ভ্রমণ নিয়ে একটা বই ২০১৬ সালে প্রকাশ হয়েছিল। ওয়েবসাইটে নতুন করে আবার প্রকাশ করছি।
ভালো থাকবেন।
Pingback: টোকিও টাওয়ার থেকে (কিস্তি ০২)