শিবলী নোমান

এন্ড অব সায়েন্স ফিকশন?

শিবলী নোমান

যখন ছোট ছিলাম, তখন আর সব কল্পকাহিনীর মতো বিজ্ঞান কল্পকাহিনী বা সায়েন্স ফিকশন পড়ারও নেশা ছিল। রুশ বিজ্ঞান কল্পকাহিনী লেখক আলেক্সান্দর বেলায়েভের বাংলা অনুবাদ থেকে শুরু করে মুহম্মদ জাফর ইকবালের বইগুলো থাকতো তালিকায়। মনে আছে ফিহা সমীকরণ পড়তে গিয়ে যখন আবিষ্কার করলাম হুমায়ূন আহমেদও সায়েন্স ফিকশন লিখেছেন, এক অবিশ্বাস কাজ করেছিল নিজের ভেতর।

সময়ের সাথে সাথে যখন সকল ধরনের কল্পকাহিনী থেকে দূরে সরে গিয়ে নন-ফিকশনে ঝুকলাম, স্বাভাবিকভাবেই পাঠ্য তালিকা থেকে সরে যেতে থাকলো সায়েন্স ফিকশনও। তারপরও স্মৃতিতে থাকা সেই সব সায়েন্স ফিকশন বইয়ের কাহিনীকে পাশে রেখে যখন আজকের বাস্তবতার দিকে তাকাই, দ্বিধান্বিত হতেই হয় এই ভেবে যে, কোথায় আমদের বাস? খোদ সেই সায়েন্স ফিকশনের জগতেই নয় তো?

পরিচিত কারো সাথে যোগাযোগ করতে হলে আমাদের ভরসা এখন মোবাইল ফোনে সংরক্ষিত ফোন নাম্বার। স্মার্টফোন আসার পর অগণিত ফোন নাম্বার সংরক্ষণের সুবিধা পাওয়ায়, এখন একজনের ফোন নাম্বার মস্তিষ্কে সংরক্ষণ করে রাখা আমাদের কাছে মস্তিষ্কের ক্ষমতা অপব্যবহারেরই নামান্তর যেন!

কিংবা গুগল আর উইকিপিডিয়ার যুগে কেন কোন কিছু জেনে মনে রাখতে হবে আমাদের? সাথে আবার যুক্ত হয়েছে চ্যাট জিপিটি, জিপিএস, গুগল ম্যাপ; সামনে আমাদের সহায়তার জন্য সহজলভ্য হতে যাচ্ছে আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স ও রোবটের বহর। অর্থাৎ মস্তিষ্ককে আরাম দেয়ার সকল ইন্তেজাম আমরা করে ফেলছি। আর ক’টা দিন ব্যস, আমাদের মস্তিষ্ককে ঘুমের জন্য পাঠিয়ে দিতে সক্ষম হবো সায়েন্স ফিকশনে পড়া সেইসব শীতল ঘরে, যেখানে ঘুমিয়ে থাকা যায় হাজার বছর।

মস্তিষ্ককে বিশ্রাম দেয়ার এতসব চেষ্টার পরও যদি একটু মস্তিষ্ক খাটাই কষ্ট করে, তাহলে কিন্তু আমরা দেখতে পাবো কী নিরন্তর চেষ্টাটাই না এক দল মানবহিতৈষী(!) করে যাচ্ছেন আমাদের মস্তিষ্ককে বিশ্রাম দেয়ার জন্য।

এরই অংশ হিসেবে আপনার সামনে থাকা স্মার্টফোন আপনার সকল কথোপকথন রেকর্ড করছে, ফলে এইমাত্র সামনের মানুষটির সাথে যে বিষয়ে আপনি কথা বললেন, ঠিক সেই সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন চলে আসছে ফোনের পর্দায়।

কিংবা কখনো খেয়াল করেছেন কিনা, নিজের মনেই হয়তো ভেবেছেন যে আপনার এই মুহূর্তে পচা বল সাবান কেনা দরকার, তো সেই ধরনের সাবানের বিজ্ঞাপনও ভেসে আসছে আপনার কাছে?

অর্থাৎ, আমাদের জীবনকে সহজ করার নামে, আমাদের মস্তিষ্ককে বিশ্রাম দেয়ার নামে গুগলগোষ্ঠী (গুগল-ফেইসবুক-টুইটার প্রভৃতি) আসলে আমাদেরকে নিয়ে যাচ্ছে জর্জ অরওয়েলের ১৯৮৪-তে, যেখানে আপনার সার্বক্ষণিক সঙ্গী স্মার্টফোনই কাজ করছে টেলিস্ক্রিন হিসেবে। পার্থক্য হলো, ১৯৮৪ উপন্যাসে ওসেনিয়ার মানুষ জানতো টেলিস্ক্রিনের মাধ্যমে বিগ ব্রাদার তাদের উপর প্রতিনিয়ত নজরদারি চালাচ্ছে; কিন্তু আমরা সেটা জানি না বা জানতে চাই না। ১৯৮৪-তে মানুষ টেলিস্ক্রিনকে ফাঁকি দিতে চেয়েছে, আর এখন আমাদের ভেতর অনেকেই গুগলগোষ্ঠীর এই নজরদারিতে মন্দ কিছু দেখে না। সত্যিই সেলুকাস, কী বিচিত্র এই মানবজাতি!

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যে বিকাশ এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, তাতে অতীত কিংবা ভবিষ্যতে যাওয়ার জন্য টাইম মেশিন আবিষ্কার করে ফেলা ছাড়া সায়েন্স ফিকশনে পড়া আর কোন কিছু ফিকশন থাকবে বলে মনে হচ্ছে না। সেক্ষেত্রে প্রস্তুত থাকা ভালো হবে এমন এক সময়ের জন্য, যেখানে নিরাপত্তার নামে নাগরিকদের শরীরে কিছু একটা প্রবেশ করিয়ে দিয়ে নজরদারিতে রাখা হবে, যেখানে আপনি-আমি রোবটের নির্দেশে চলবো, যেখানে মস্তিষ্ক ব্যবহার না হতে হতে তার চিন্তা করার ক্ষমতা হারাবে। আর খোদা না খাস্তা, সময়ের সাথে সাথে মানব সভ্যতার বিলুপ্ত? বা রোবট কিংবা এআই-এর সাথে সংঘাত? ধ্যাত!

অর্থাৎ, আমরা সম্ভবত পরিপূর্ণ সায়েন্স ফিকশনের জগতে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। সেক্ষেত্রে আমাদের আর সায়েন্স ফিকশনের প্রয়োজন হবে না। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামা যেমন ইতিহাসের সমাপ্তি ঘোষণা করছিলেন, তেমনি ঘোষণা করা যাবে দ্য এন্ড অব সায়েন্স ফিকশন।

তার চেয়ে বরং সায়েন্স ফিকশনের যুগে কীভাবে হিউম্যান/হিউম্যানিটারিয়ান ফিকশনে মনযোগী হওয়া যায়, ভাবুন না!

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।